‘চিঠি’ যেন হারিয়ে না যায়
ইন্টারনেট কিংবা মোবাইল। তাৎক্ষণিক যোগাযোগের এই যুগে ডাক বিভাগের গুরুত্ব যে অনেক কমে এসেছে তা বলাই বাহুল্য। তারপরও সামাজিক যোগাযোগ এবং ব্যবসা বাণিজ্যে ডাক ব্যবস্থা এখনও অপরিহার্য। সেই গুরুত্ব তুলে ধরতেই ৯ অক্টোবর বিশ্ব জুড়ে পালিত হয় বিশ্ব ডাক দিবস। এ উপলক্ষে বাংলাদেশেও ডাক বিভাগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
১৮৭৪ সালে ডাক ব্যবস্থা প্রবর্তন হয়। এরপর থেকে সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বিশ্ব ডাক ইউনিয়নে যোগ দেয় ১৯৭৩ সালে। বাংলাদেশের মানচিত্র সম্বলিত গাঢ় লাল,নীল ও বেগুনী রঙের ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়। এর মূল্য ছিলো ১০ পয়সা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হত্যাকান্ডকে প্রেক্ষণে রেখে রক্তলাল ছাপের ওপর হলুদ লেখা ঢাকা ইউনিভার্সিটি গাঢ় সবুজ রঙের ডাকটিকিট। এর মূল্য ছিলো ২০ পয়সা। বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট নকশাকার শিল্পী বিমান মল্লিক। যুদ্ধকালীন সময়ে বর্হিবিশ্বে সেই ডাকটিকিটগুলো হয়ে উঠেছিল জনমত সংগ্রহের বিরাট অস্ত্র।
ডাকটিকিট একটি দেশ বা জাতির ইতিহাস,ঐতিহ্য,সভ্যতা,সংস্কৃতি প্রকাশের অতি উত্তম ও সহজ মাধ্যম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন সময়েই ২৯ জুলাই বাংলাদেশর প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তাঞ্চল থেকে ডাকটিকিট প্রকাশ করে ডাকবিভাগ মুক্তিযুদ্ধে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক প্রকাশিত মুক্তাঞ্চলে স্বাধীন ডাকব্যবস্থা চালু করা ডাকটিকিটের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। এরকম উদ্যোগ বিশ্বের অন্য কোথাও হয়নি।
বর্তমানে সারা বাংলাদেশে বিভাগীয় (ডিপার্টমেন্টাল) ডাকঘরের সংখ্যা ১ হাজার ৬০০টিরও বেশি। ৮ হাজারেরও বেশি রয়েছে এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল ডাকঘর। বর্তমানে ডাক বিভাগের সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা ১৭ হাজার ও ভারপ্রাপ্ত লোকবল ২৪ হাজার।
ইউরোপের ২২টি দেশের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ১৮৭৪ সালের ৯ অক্টোবর সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে গঠিত হয় ‘জেনারেল পোস্টাল ইউনিয়ন’। এর লক্ষ্য ছিল বিশ্বের প্রতিটি দেশের মধ্যে ডাক আদান-প্রদানকে অধিকতর সহজ ও সমৃদ্ধশালী করার মধ্য দিয়ে বিশ্বজনীন পারস্পরিক যোগাযোগকে সুসংহত করা।
এক সময় এ জেনারেল পোস্টাল ইউনিয়ন ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন বা ইউপিইউ নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৬৯ সালে জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ডাক ইউনিয়নের ১৬তম অধিবেশনে প্রতি বছরের ৯ অক্টোবর বিশ্ব ডাক ইউনিয়ন দিবস নির্ধারণ করা হয়। ১৯৮৪ সালে জার্মানির হামবুর্গে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ডাক ইউনিয়নের ১৯তম অধিবেশনে বিশ্ব ডাক ইউনিয়ন দিবসের নাম বিশ্ব ডাক দিবস বদলে যায়। বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ওই সংস্থার সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।
প্রযুক্তির কল্যাণে বর্তমানে পারস্পরিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর হওয়ার কারণে আমাদের দেশে ডাক ব্যবস্থা প্রায় বিলুপ্তির পথে। কিন্তু উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ এখনো তাদের ডাক বিভাগকে কাজে লাগিয়ে অনেক জনকল্যাণমূলক কাজ সম্পন্ন করে থাকে।
মানুষ চিঠি লেখে প্রিয়জনের কাছে ডাকে পাঠায়। আজকের পরিবর্তিত বিশ্বে মানুষের চিঠি লেখা কমলেও, বন্ধ হয়নি। মোবাইল-ইন্টারনেটের কারণে হয়তো এনালগ ডাকের চাহিদা কমেছে। তারপরও পরিবর্তিত হয়েছে ডাকের রূপ।
ডাকঘরের সেবায় ডিজিটালাইজেশনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গ্রাম এলাকার ৮ হাজার ডাকঘরকে ই-সেন্টারে রূপান্তরের জন্য একটি প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে।
১৯৭১ সাল। সময়টা ছিলো নতুন একটা দেশকে বিশ্বের সামনে পরিচয় করিয়ে দেয়ার। জর্জ হ্যারিসন,রবি শংকররা কনসার্ট করে,আর কূটনীতিকেরা তৎপরতা চালিয়ে বিশ্বের সামনে পরিচিত করতে চাইছিলেন বাংলাদেশকে। সেই সময়ে,আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে,দেশকে পরিচিত করতে এসেছিল নতুন এক অস্ত্র—ডাকটিকিট।
প্রাচীনকাল থেকেই যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে চিঠিপত্র ছিলো মানুষের অন্যতম হাতিয়ার। যখন ডাকঘর ছিলো না তখন মানুষ পোষা পাখি বা প্রাণী অর্থাৎ কবুতরের মাধ্যমে চিঠিপত্র আদান-প্রদান করতো। আগেকার দিনে রাজা বাদশারা এই নিয়ম অহরহ পালন করতো। ইংল্যান্ডে ১৬৬০ সালে সরকারিভাবে জেনারেল প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ভারতীয় উপমহাদেশে কলকাতায় ১৮৬৮ সালে জেনারেল পোস্ট অফিস চালু হয়।
১৮৪০ সালে ইংল্যান্ডে ডাকটিকেট প্রচলন হয়। আগাম ডাক মাসুল দেয়ার জন্য ছোট ছোট কাগজ ছাপিয়ে চিঠির খামে ব্যবহার করার রীতি প্রবর্তন করেন রোনাল্ড হিল নামক একজন ইংরেজ ভদ্রলোক। মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ছবি ছিলো সেই ডাক টিকেটে।
৮০-৯০ এর দশকে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকরণের ফলে পোস্ট অফিসের মান কিছুটা উন্নত হয়েছে। বর্তমানে মোবাইল ফোনের অবাধ প্রচলনের ফলে ব্যক্তিগত চিঠিপত্র লেখার অভ্যাস মানুষ প্রায় ভুলেই গেছে বা বোঝা মনে করে। শুধু দাফতরিক চিঠিপত্র ছাড়া এখন আর কোনো চিঠি তেমন লেখা হয় না।
চিঠি বা পত্র লেখার রীতি আমাদের সংস্কৃতির একটি অংশ। কাগজ আবিষ্কারের আগে মানুষ গাছের পাতায়,গাছের ছালে,চামড়ায় ধাতপ পাত্রে ইত্যাদি জায়গায় লিখে রাখতো।
অনেকের ধারণা পাতায় লিখতো বলে এর নামকরণ করা হয়েছে পত্র। চিঠি সাহিত্যেরও একটি অংশ। মানব মনের ভাবাবেগ অন্যের নিকট সুন্দর এবং নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় চিঠির মাধ্যমে।
চিঠির মাধ্যমে মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা,রুচি এবং ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। একটি জাতির সংস্কৃতি অন্য জাতির নিকট তুলে ধরা যায় চিঠি বা পত্রের মাধ্যমে। সুলিখিত চিঠি উন্নত সাহিত্য হিসেবে বিবেচিত। যেমন-রবীন্দ্রনাথ নাম ঠাকুরের ‘ছিন্ন পত্র’।
হাজার বছরের,সংস্কৃতি আমরা চিঠির মাধ্যমে লালন করতে পারি। একজন ব্যক্তি,জাতি,গোষ্ঠীর চিন্তা,মনন প্রভৃতি চিঠির মধ্যে লুকিয়ে আছে। আজ অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে সেই চিঠি বিলুপ্তির পথে। আমাদের সমাজ থেকে এই চিঠি যেন হারিয়ে না যায় সে দিকে সকলের দৃষ্টি দেয়া উচিত।
[শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।]
jsb.shuvo@gmail.com