বেচারা আইজিপি কোথায় যাবেন?

বেচারা আইজিপি কোথায় যাবেন?
ছবি: প্রভাষ আমিন।

প্রভাষ আমিন: ‘পুলিশ কাজ করলেও সমস্যা, না করলেও সমস্যা। নীরবে কাজ করলে বলে, পুলিশ কোনো কাজই করে না, পুলিশ ব্যর্থ। আর পুলিশ যখন সরবে কাজ করে তখন বলে, ঢাকঢোল পিটিয়ে কাজ করছে। এগুলো আসল কাজ করার জন্য করছে না। তাহলে আমরা যাবো কোথায়? : আইজিপি’।
…..>
আহারে আইজিপির জন্য আমার মায়াই লাগছে। বেচারা পড়েছেন উভয় সঙ্কটে। নীরবে কাজ করবেন না সরবে? আর যাবেনই কোথায়? মাননীয় আইজিপি আপনাকে কোথাও যেতে হবে না। প্রিয় বাংলাদেশেই থাকুন। নীরবে কাজ করবেন, না সরবে; সেটা আপনার ব্যাপার। বিড়াল সাদা না কালো, সত্যি বলছি, তা নিয়ে আমাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই; আমরা শুধু জানতে চাই, বিড়াল ইদুর মারে কিনা। আপনি নীরবে করুন আর ঢাকঢোল পিটিয়ে করুন, আমরা নিশ্চিন্তে, নিরাপদে ঘুমাতে চাই। ঘাড়ের ওপর শিরশিরে অনুভূতি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে, রাস্তায় হাটতে গেলেই চারপাশের সবাইকে সন্দেহ করতে করতে আমরাও ক্লান্ত।
…..>
চট্টগ্রামে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যার পর আমরা সবাই জঙ্গীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিয়ে কঠোর অভিযানের দাবি করেছিলাম। কিন্তু সেই অভিযান যে এমন ঢাকঢোল পিটিয়ে, জঙ্গীদের আত্মগোপনে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে, সাধারন মানুষের মনে আতঙ্ক আর ঈদের আগে পুলিশের জন্য সফল বাণিজ্যিক সাঁড়াশি অভিযান হয়ে আসবে, পুরো বুঝতে পারিনি। যদিও অভিযানের শুরুর দিনেই সাধারন মানুষের হয়রানি এবং পুলিশের ঈদ বাণিজ্যের আশঙ্কার কথা তুলে ধরেছিলাম এই কলামেই। কিন্তু বাস্তবতা যে আশঙ্কার চেয়েও ভয়ঙ্কর হবে, তা বুঝিনি। সৎ পুলিশ অফিসার বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যার পর পুলিশের প্রতি দেশজুড়ে সহানুভূতির যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, তার গতি উল্টো দিকে ফেরাতে পুলিশ মাত্র তিনদিন সময় নিয়েছে। বাবুল আক্তারের কান্না আমাদের যতই আপ্লুত করুক, এখন পুলিশ মানেই আতঙ্ক। পাঁচদিনে ১২ হাজারেরও বেশি লোককে আটক করে দারুণ সফল ঈদ বাণিজ্যিক সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। পুলিশের দাবি অনুযায়ী গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে মাত্র ১৪৫ জন জঙ্গী। তাহলে বাকিরা কারা?
…..>
সাঁড়াশি অভিযান মানে খুঁজে খুঁজে সাঁড়াশি দিয়ে চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের তুলে আনা। পুলিশের আরেকটি অভিযান আছে, চিরুণি অভিযান। তবে এবারের অভিযানটি সাঁড়াশি হলেও আসলে এর নাম হওয়া উচিত ছিল বেড়জাল অভিযান। এই অভিযানে পুলিশ যাকে হাতের কাছে পাচ্ছে, তাকেই ধরছে। এই বেড়জাল অভিযান পুলিশের অদক্ষতা আর গোয়েন্দা তথ্যে অপ্রতুলতার প্রমাণ। ১৪৫ জঙ্গী ধরার জন্য ১২ হাজার সাধারন মানুষকে ধরা নিশ্চয়ই পুলিশের দক্ষতার প্রমাণ নয়। পুলিশের অদক্ষতা নিয়েও আমার আপত্তি নেই। তারা বেড়জাল দিয়ে নির্বিচারে মানুষ ধরুক। কিন্তু যত দ্রুত সম্ভব যাচাই বাছাই করে নির্দোষ মানুষদের ছেড়ে দিলেই হতো। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। নির্বিচার গ্রেপ্তারের বিপরীতে চলছে ঢালাও বাণিজ্য। ৫৪ ধারা নিয়ে আদালতের নির্দেশনা থাকায় পুলিশকে একটু কষ্ট করে ডিপফ্রিজে থাকা বিভিন্ন মামলা খুঁজে বের করতে হচ্ছে। আর গ্রেপ্তার করা ব্যক্তি বিএনপি-জামাত হলে তো কথাই নেই। কোনো না কোনো একটা সহিংসাতার মামলা তো পাওয়া যাবেই। বিভিন্ন মামলার আসামীদের ধরা তো পুলিশের নিয়মিত দায়িত্ব। তবে এই হাজার হাজার আসামীকে এতদিন ধরা হয়নি কেন? তারা কেন আয়েশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কোনোরকমে সাতদিনের সাঁড়াশি অভিযানে লুকিয়ে-চুরিয়ে থাকতে পারলেই কি তাদের আর ধরা হবে না?
…..>
আইজিপি প্রশ্ন করেছিলেন, তাহলে আমরা যাবো কোথায়? তিনি যদি একটু কষ্ট করে পুরান ঢাকার আদালতপাড়ায় যেতেন, তাহলেই দেখতে পেতেন, সেখানে সংযমের এই মাসে কত অসংযম, কত কান্না, কত হাহাকার। সন্তান ইফতারির টেবিলে বসে আছে, কিন্তু বাবা ইফতার কিনতে গিয়ে আর ফেরেননি। মা বসে আছেন সন্তানের অপেক্ষায়। দুদিন পর পরীক্ষা, কিন্তু তাকে পড়ার টেবিল নয় যেতে হচ্ছে কারাগারে। ধরার পর পাঁচ লাখ টাকা থেকে দর কষাকষি শুরু হয়েছে। দেড় লাখ টাকা দেয়াও হয়েছে। কিন্তু তাও মুক্তি মেলেনি। বাংলাদেশে এখন সততার মাপকাঠি হলো, টাকা নিয়ে কাজ করে দেয়া। কিন্তু পুলিশ টাকা নিয়েও আসামী ছাড়ছে না। আবার রাস্তায় ধরে ছিনতাইকারীর মত পকেট সার্চ করে যা পেয়েছে, তাই নিয়ে ছেড়ে দেয়ার ঘটনাও আছে। ইদানিং ছিনতাইকারীরাও মানুষকে রিকশা ভাড়া দিয়ে দেয়। পুলিশ নাকি তাও দেয় না। টাকা দিতে দেরি হলে কোনো মামলায় ঢুকিয়ে দিলেই বিপদ। তখন আর টাকা নিয়েও ছাড়তে পারে না। তখন দর কষাকষি হয়, দুর্বল ধারার মামলায় দেয়ার। আইজিপি সাহেব নিজে তো যেতে পারবেন না, কাউকে পাঠালেই তিনি পেয়ে যাবেন এইসব বেদনার ছবি। মাননীয় আইজিপি, আগেই বলেছি আপনারা নীরবে না সরবে অভিযান চালাবেন, তা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে আমি একটা জিনিস বুঝি, যে দেশে পুলিশ যত কম দৃশ্যমান, সে দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তত ভালো।
…..>
বাবুল আক্তারের স্ত্রীর মৃত্যুর পর সবাই জঙ্গীবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চেয়েছিল। এখন সবাই দিন গুণছে, কবে সাতদিন শেষ হবে, কবে বন্ধ হবে এই বেড়জাল ঈদ বাণিজ্য অভিযান।
[লেখক: সাংবাদিক।]

সৌজন্যে: আমাদের অর্থনীতি।

অতিথি লেখক