গল্প: টিপাই
তানজারীন ইফফাত স্বাতী: অভাবের সংসারে দুবেলা খেতে পায়না টিপাই। মা মারা গেছে বয়স যখন দুই। তারপর বাবা তাকে চাচা চাচীর কাছে রেখে নিরুদ্দেশ হলো। কোথায় আজও তা জানেনা টিপাই। তবে লোকের মুখে শুনেছে ভীন দেশে গিয়ে নতুন করে সংসার পেতেছেন বাবা। চাচা চাচী অকথ্য নির্যাতন করে টিপাইকে। সমবয়সী ছেলেরা যখন স্কুলে যায় চাচা তখন তাকে ক্ষেতের কাজে লাগায়। একদিন চুপিচুপি গাঁয়ের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় সে। গম পাবে, টাকা পাবে এই আশায় চাচা কিছু বলেন না। চাচীও মুখ বুজে থাকে। আর টিপাই লেখাপড়া শিখতে চায়।
চাচার হাতে যখন টাকা আসে তখন ভালো খাবারের ব্যাবস্থা হয়। এই যেমন মাঝারী সাইজের মাছ কিম্বা ব্রয়লারের মুরগী। মাঝে মাঝে দুধও আনে। কিন্তু দুধ এত অল্প আনা হয় যে টিপাই ভাগে পায়না। বাড়িতে ও ছাড়াও আছে তিন জন চাচাতো ভাই বোন। ওরাও সবাই ছোট। টিপাই এর চাচার নাম রহীম। রহীম সেই দিন রাতে ভাত খাওয়ার পর বউকে বলে, দুধ কি আছে? রহীমের পাতে দুধ ঢেলে দেয় আমেনা। রহীম আরও চারটা ভাত নিয়ে আয়েস করে খায় আর বলে আজগরকে দাও। টিপাই চাচাতো ভাই আজগরের পাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর খাওয়া শেষ করে উঠে চলে যায়। এই রকম প্রায়ই টিপাই সব কিছু খেতে পায়না। কিন্তু আজ কি হোল চাচী ওকে এক বাটী দুধ এনে দিল। টিপাই এর মুখ খুশিতে ভরে উঠলো। চাচীর মুখও হাসিখুশি। টিপাই দুধ মুখের কাছে ধরতেই আজগর বলল, ভাই দুধ বিড়ালে খাইছে। ঠিক তখনি টিপাই মনের কোথায় যেন একটা শব্দ শুনতে পেলো। মন বলে উঠলো, মা তুমি কোথায়? কত দূরে? আমায় নেবে তোমার কাছে? আমি তোমার কাছে যেতে চাই মা।
এই রকম দিন কাটতে কাটতে টিপাই একদিন বাবার খোঁজে বের হয়। এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে চলে যায়। চাচী বলে, আপদ দূর হয়েছে। চাচা এদিক ওদিক খোঁজ করে দায়িত্ব পালন করে। সবাই তখন বলতে শুরু করে টিপাই ওর বপের মত নিরুদ্দেশ হইছে।
তারপর টিপাই একদিন শহরের গাড়ীতে চড়ে বসে। শহরে এসে দেখে এত বড় দুনিয়া। কোথায় যাবে? যাওয়ার যে যায়গা নেই। এখন ভাগ্য ওকে কোথায় নেবে সেটা যে বিধাতাই জানেন। রেলস্টেশনের রাস্তায় শুয়ে থাকে। দেখে ওর মত কত ছেলে আছে এখানে। কেউ চা পানি বিক্রি করে, কেউ পত্রিকা বিক্রি করে, কেউ বা কুলি। টিপাই বুঝতে পারে ওকেও কাজ করতে হবে। চা বিক্রি করা জামিলুরের সাহায্য চায়। জামিলুর ওকে বলে, তুই এই কাম করবি?
টিপাই বলে, হ করুম।
টিপাই বলে, হ করুম।
এই স্টেশনের বাচ্চাগুলোর মধ্যেও চলছে জীবন সংগ্রাম। এখানে চলে নানা রকম খেলা। টিপাই রেলস্টেশনের ধার ধরে বসে থাকে। যদি কখনও বাবার দেখা পায়!