সহিংসতা বন্ধে গুরুত্ব দিতে হবে
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: ইতিহাস কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভালো কিংবা যা কিছু প্রথম। যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ। তাই ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সবসময় গুরুত্ব বহন করে। দার্শনিক জন ল্যাক হন বলেছেন, “ভবিষ্যৎকে জানার জন্য আমাদের অতীত জানা উচিত”।
আজকের সমাজ ও বিশ্বে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেই ব্যথিত হতে হচ্ছে, পেতে হচ্ছে কষ্ট! মুক্তিকামী ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি হত্যাযজ্ঞ, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, ইসরাইল-ইরান যুদ্ধ বিশ্ববাসীকে স্তম্ভিত করেছে। আজ সর্বত্র সংঘাত, হিংসা, প্রতিহিংসা, দ্বেষ ও জিঘাংসা। এগুলো মানবিক আচরণ হতে পারে না। কোনো ধর্মই এগুলো শেখায়নি। এসব আচরণ মানুষের চিত্তকে কলুষিত করে এবং দেহ ও মনকে করে পীড়িত। সুতরাং দেহে যেমন সুষম আহারের প্রয়োজন হয়, তেমনি চিত্তেরও। চিত্তের সুষম আহার হলো সৎচিন্তা এবং নির্লোভ, নির্মোহ ও অহিংস অবস্থায় চিত্তকে নিরাপদে রাখা। আমরা এও জানি, দেহ বা শরীরকে ধৌত করা যায়, কাপড়-চোপড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নও করা যায়, কিন্তু চিত্তকে ধৌত করা যায় না, পরিষ্কারও করা যায় না।
‘অহিংসা’ বলতে বোঝায় হিংসা থেকে দূরে থাকা। প্রশ্ন হচ্ছে, পৃথিবীর অসহিষ্ণুতা, উত্তেজনা, সহিংসতা কী থেমে আছে? মানুষ কেন প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠছে? কেন বার বার সারা বিশ্বে খুনোখুনি, হানাহানি, মারামারি লেগেই রয়েছে? আমরা কী আমাদের ভবিষ্যৎ ক্রমশ অশান্তিতে পরিণত করছি?
প্রশ্ন গুলোর উত্তর খুঁজতে গুরুত্বের দিক দিয়ে পরিবারের সামাজিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে হবে। পরিবারের প্রভাব সমগ্র সমাজ জীবনের ওপর পতিত হয় ও পারিবারিক পরিবর্তন পুরো সমাজব্যবস্থার ওপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং পরিবারের ভিত্তির ওপর সমাজ কাঠামো তৈরি হয় এবং সমাজের মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি রচিত হয়। সে হিসেবে জ্ঞানীরা বলেন, শান্তিময় সমাজ গঠনে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। প্রত্যেকটি পরিবার তার সদস্যদের ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। এমনকি পরিবারভুক্ত সদস্যদের চরিত্র গঠন হয় পরিবার থেকে।
সন্তান পরিবার থেকে শিখতে পারে আদব-কায়দা, শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ববোধ, নীতি-নৈতিকতাবোধ। মানবজীবনের মৌলিক আদর্শগুলো শিখতে পরিবারকে অগ্রগন্য করা হয়। একজন ব্যক্তি তার জীবনকে যেভাবে দেখতে ইচ্ছুক সেটি হলো- তার জীবনদর্শন। অর্থাৎ জীবন যেভাবে চললে একজন ব্যক্তির কাছে ভালো মনে হয় সেটিই সেই ব্যক্তির জীবন দর্শন।
মূলত রাষ্ট্রের বুৎপত্তিই হয়েছে সভ্যতাকে অগ্রগামী ও পরিশীলিত করার জন্য। আর রাষ্ট্র বলতে এমন এক রাজনৈতিক সংগঠনকে বোঝায় যা কোনো একটি ভৌগোলিক পরিসর ও তৎসংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার সার্বভৌম ক্ষমতা সংরক্ষণ করে। রাষ্ট্র সাধারণত একগুচ্ছ প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। এসব প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ হিসাবে সংশ্লিষ্ট ভৌগোলিক সীমার ভেতর বসবাসকারী সভ্যদের শাসনের জন্য নিয়ম-কানুন তৈরি এবং জনস্বার্থে প্রয়োগ করে থাকে।
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রকে ‘সর্বজনীন কল্যাণ সাধনকারী’ এবং ‘মানুষের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য’ সংঘ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। আর রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জনসাধারণকে আইন মেনে চলতে বাধ্য করা, সমাজের শান্তি ভঙ্গকারীদের শাস্তির বিধান করা এবং সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, শ্রেণি ও পেশা নির্বিশেষে সকল শ্রেণির নাগরিকদের অধিকারের সমতা বিধানও রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব এবং আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
ইতিহাস পাঠে জানা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন মহাত্মাগান্ধী। তার আন্দোলন ছিল অহিংস ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন। ১৯১৫ সালে ৯ জানুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে গান্ধী ভারতে ফিরে আসেন। এ দিনটিকে প্রবাসী ভারতীয় দিন হিসেবে পালন করা হয়। ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে মহাত্মা গান্ধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নির্বাহী হন। ইংরেজদের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে তিনিই ভিন্নধর্মী আন্দোলন গড়ে তোলেন- যা অপেক্ষাকৃত বেশি শক্তি সঞ্চয়ে কার্যকরী হয়। তিনি হয়ে উঠেন প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক রাজনৈতিক নেতা। কীভাবে আত্মোন্নতি করতে হয়, আত্মবিশ্বাস জাগাতে হয়, বাধা বিপর্যয়ের সামনা-সামনি হওয়ার সামর্থ্য অর্জন করতে হয়, কীভাবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মনুষ্য পদবাচ্য হতে হয় মহাত্মা গান্ধী রাজনীতিতে সে শিক্ষারই অবতারণা করেন।
মূলত ‘বৈদান্তিক’ দর্শন-ই হচ্ছে অহিংসবাদী দর্শন। অহিংস মতবাদে বিশ্বাসী একজন সাধারণ মানুষ অসাধারণ এক আন্দোলনের সূচনা করে বিশ্ববাসীর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। প্রথাগত রাজনীতির বিপরীতে এমন এক দর্শন উপস্থাপন করেছেন যার জন্য মানবসভ্যতা ভিন্ন উচ্চতায় জায়গা পেয়েছে। মানবীয় ক্রমবিকাশ জৈবস্তরীয় নয়; নিশ্চিতরূপেই তা হল নৈতিক, চারিত্রিক ও আধ্যাত্মিক ক্রমবিকাশ। মানবজাতিকে নৈতিক আহ্বান জানিয়ে মহাত্মা গান্ধী শুদ্ধতম শক্তির পথ দেখিয়ে গেছেন। সেই বহমান পথেই মানব জাতির সত্যিকারের মুক্তি হতে পারে। অসাম্প্রদায়িক মনোমানসিকতা অকৃত্রিম মানবপ্রেম মহাত্মা গান্ধীর চরিত্রভূষণ ছিল।
মহাত্মাগান্ধী জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই মহাত্মা হননি। এ জন্য অবিরাম সাধনা করতে হয়েছে। নির্মোহ সেই সাধনায় ছিল বীরত্ব। অগ্রজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান্ধীজীর সব কাজ সমর্থন করেননি, তবে তিনিই তাকে ‘মহাত্মা’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। মোহনদাস করমচাঁদ হয়ে উঠলেন মহাত্মাগান্ধী। করুণাপূর্ণ হৃদয়ের মানুষ হিসেবে তিনি বহু ঝঞ্ঝাট স্বীকার করেছিলেন। তার জীবন ছিল সময়ের বাস্তবতায় বিঘ্নপূর্ণ।
বিশ্ব থেকে হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি, অসহিষ্ণুতা ও রক্তপাত বন্ধে বিশ্ববাসীকে সচেতন করতে প্রতিবছর ২ অক্টোবর বিশ্ব অহিংস দিবস পালন করা হয়। ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে প্যারিসে ইরানী নোবেল বিজয়ী শিরিন এবাদী তার একজন হিন্দি শিক্ষকের কাছ থেকে দিবসটির ব্যাপারে একটি প্রস্তাবনা গ্রহণ করেন। পরে ২০০৭ সালে ভারতীয় রাজনীতিক সোনিয়া গান্ধী জাতিসংঘে সিদ্ধান্তটি পেশ করেন। ২০০৭ সালের ১৫ জুন জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ২ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। উল্লেখ্য, এই দিনটি ভারত স্বাধীনের অবিসংবাদী পথপ্রদর্শক মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন। ‘সংঘাত নয়, ঐক্যের বাংলাদেশ গড়ি” প্রতিপাদ্যে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস ২০২৪ পালিত হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অনেক অর্জনের মধ্যেও সহিংসতা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়ন ও জঙ্গিবাদের মতো ভয়াবহ পরিবেশ বিরাজমান। একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন নিয়ে এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করলেও স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরও সেই স্বপ্ন এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন বা এমএসএফ জানিয়েছে, চলতি বছর সেপ্টেম্বরে ধর্ষণসহ নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতার ঘটনা আগস্টের তুলনায় অনেকাংশে বেড়েছে, যা উদ্বেগজনক। সেপ্টেম্বরে ২০৮টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, যা আগের মাসের তুলনায় ৭০টি বেশি। এ মাসে ধর্ষণের ঘটনা ৩৫টি; সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১১টি; ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা রয়েছে দুটি। ধর্ষণের শিকার হয়েছে পাঁচ প্রতিবন্ধী শিশু ও কিশোরী। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ১২ অক্টোবর (সোমবার) প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এমএসএফ মনে করে, নারী-শিশুদের প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা, তা দৃশ্যমান হচ্ছে না।
সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আইনজীবী সুলতানা কামালের সই করা প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও এ মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা বন্দুকযুদ্ধ ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনাও রয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতায় হতাহত বাড়ছে। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে হুমকি ও হামলা তথা সাংবাদিকতা এবং মত প্রকাশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিংসতার ধারাবাহিকতা রয়ে গেছে। পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে ধর্মীয় অজুহাতে সংস্কৃতির ওপর হামলার ঘটনা। এসব ঘটনা বাড়ায় এমএসএফ গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সেপ্টেম্বরে বিএনপির দলীয় কর্মীদের মধ্যে সংঘাত লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতার ৪৮টি ঘটনায় সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৬২৪ জন। তাদের মধ্যে পাঁচজন নিহত ও ৬১৯ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে চারজন বিএনপির ও একজন ট্রলিচালক। চার আওয়ামী লীগের কর্মী দুষ্কৃতকারীর পিটুনিতে নিহত হন। দেশে বেড়েছে গণপিটুনি। এ ধরনের ৩৩টি ঘটনায় প্রাণ গেছে ২৪ জনের।
বাংলাদেশের অনেক অর্জনের মধ্যেও থেমে নেই সহিংসতা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়ন ও জঙ্গিবাদের মতো ভয়াবহ ঘটনা। একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন নিয়ে এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করলেও স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরও সেই স্বপ্ন এখনো সেটি বাস্তবায়িত হয়নি!
সম্প্রতি ‘আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস’ উপলক্ষে দি হাঙ্গার প্রজেক্টের উদ্যোগে আয়োজিত এক অনলাইন আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, “সাংবিধানিক আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশে এখনো একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ গড়ে ওঠেনি।” সহিংসতা পরিহার ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার আহ্বানে দি হাঙ্গার প্রজেক্টের অনুপ্রেরণায় গঠিত প্ল্যাটফর্ম পিস ফ্যাসিলিটেটর গ্রুপ (পিএফজি), সুজন, ইয়ুথ এন্ডিং হাঙ্গারসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের নেতারা এই অনলাইন সভায় যুক্ত হন।
বক্তারা আরও বলেছেন, “আমরা ভিন্ন ধর্ম কিংবা ভিন্নমতাদর্শের হতে পারি, কিন্তু আমরা সবাই এক পরিবারের সদস্য। ১৯৭১ সালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করে আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জনে এবং দেশে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।”
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতিশীল করতে ও সামাজিক ন্যায়বিচারকে প্রতিষ্ঠিত করতে রাজনৈতিক দলগুলোর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান জরুরি। সৌহার্দ্যপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো বিকল্প নেই। সমাজের মধ্যে যদি শান্তি, সম্প্রীতি ও অহিংস মূল্যবোধের চর্চা ঘটানো সম্ভব না হয়, তাহলে আগামী দিনের বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতি মুখ থুবড়ে পড়বে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে সংঘাতের রাজনীতি পরিত্যাগ করে অহিংস আন্দোলনকে বুকে ধারণ করে সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। একই সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা করতে হবে।
সার্বিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক অহিংস দিবসটি পালন করার জন্য মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনকে কাজে লাগানো ইউএনয়ের চমৎকার একটি কৌশল। ভারতের স্বাধীনতার প্রতি গান্ধীর উৎসর্গ এবং তাঁর কৌশলগুলি বিশ্বের সর্বত্র নাগরিক ও মানবাধিকার উদ্যোগের মূল ভিত্তি। এটি সেই দিন যখন বিশ্বব্যাপী প্রত্যেকে এমন এক ব্যক্তির জন্মদিন উদযাপন করে যিনি ‘অহিংসা’ ধারণাটি এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করেছিলেন।
পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপটি হচ্ছে সমাজ। সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতার সংকট, দারিদ্র্য, ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা, গতানুগতিক আমলাতন্ত্রের চর্চা,দুর্নীতির প্রসার,নেতৃত্বের সংকট, নাগরিক অসচেতনতা, কর্তৃত্বমূলক ক্ষমতা কাঠামো, প্রভৃতি। সর্বস্তরে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি, শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি প্রতিরোধ, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, স্বশাসিত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, উগ্রবাদের বিস্তার রোধ, গণমুখী সেবা উদ্ভাবন, স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা, আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়ন,সামাজিক নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিতকরণ, যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের মাধ্যমে সমাজের কাঠামো মজবুত রাখা জরুরি।
গণমানুষের জন্য কল্যাণকামী, ক্রিয়াশীল ও অপরিহার্য সংঘ হচ্ছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের সফলতা ও ব্যর্থতা পাশাপাশি থাকলেও এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
ইতিহাস বারবার ফিরে ফিরে আসে কিংবা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। সহিংসতা শুধু ধ্বংস করে, সৃষ্টি করে না। সহিংসতা, দ্বন্দ্ব, হানাহানি জাতি হিসেবে আমাদের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছে। তাই আমাদের এগিয়ে যেতে হলে এই দ্বন্দ্ব- হানাহানির অবসান ঘটাতে হবে। গণতান্ত্রিক, শোষণমুক্ত, ন্যায় বিচার ভিত্তিক সম্প্রীতি গড়ে তুলতে হবে। গুম, খুন, অপহরণসহ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে তৎপর হতে হবে। সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, আজকের পৃথিবী, আগামীর ভবিষ্যৎ। আমরা শান্তি চাই। আমরা চাই অহিংস পৃথিবী।।
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: সিনিয়র সাংবাদিক।।