নববর্ষে টুকরো ভাবনা…
সমর পালঃ প্রাক্-পলাশি যুগেও নানারকম উৎসব, লৌকিক পূজা-পার্বণ, ব্রত ও মেলার অনুষ্ঠান বাঙালির সামাজিক জীবনের অচ্ছেদ্য অংশ ছিল। মুর্শিদাবাদের নবাব দরবারের পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকূল্যে বৈশাখের প্রথম দিনে উদযাপিত হতো নববর্ষ উৎসব। এ দিন নবাব ও জমিদারদের নজরানা দেওয়ার প্রথা চালু ছিল। আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব, শুভানুধ্যায়ী, প্রিয়জন ও পরিচিত মানুষদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ ও শুভেচ্ছা বিনিময় চলতো। ঐদিন জমিদারদের পুণ্যাহ বা রাজস্বের বাৎসরিক হিসেব-নিকেশের দিন। পহেলা বৈশাখের পুণ্যাহ, মিষ্টি বিতরণ ও স্বজন-মিলনের ধারাবাহিকতায় আজ আমরা হালখাতা, শুভ মহরত, মেলা এবং নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক আয়োজনের মাধ্যমে বর্ষবরণের উৎসব পালন করে থাকি।
বাংলায় নবতর আঙ্গিকে নববর্ষ উদযাপনের বৈচিত্র্য বিষয়ে ভাবতে গেলে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮১৭ – ১৯০৫খ্রি.) নাম মনে করতে হয়। তাৎকালিক ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে তিনি হিন্দুদের কিছু পূজা-পার্বণ ছেঁটে দিয়ে মাঘোৎসব (১১ মাঘ), নববর্ষ (১ বৈশাখ), দীক্ষাদিন(৭ পৌষ) ইত্যাদি নতুন আঙ্গিকের উপাসনা পদ্ধতি ও উৎসবকলার প্রবর্তন করেন। আমরা জানি যে, ১২৫৭ বঙ্গাব্দ (১৮৫০খ্রি.) থেকে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২ – ১৮৫৯ খ্রি.) তার সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা কার্যালয়ে নববর্ষ অনুষ্ঠান শুরু করেছিলেন। ১ বৈশাখের সে অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮ – ১৮৯৪ খ্রি.) এভাবে –
‘সেই সভায় নগর, উপনগর এবং মফস্বলের প্রায় সমস্ত সম্ভ্রান্ত লোক এবং সে সময়ের সমস্ত বিদ্বান ও ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ আমন্ত্রিত হইয়া উপস্হিত হইতেন। কলিকাতার ঠাকুরবংশ, মল্লিকবংশ, দত্তবংশ, শোভাবাজারের দেববংশ প্রভৃতি সমস্ত সম্ভ্রান্তবংশের লোকেরা সেই সভায় উপস্হিত হইতেন। বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতির ন্যায় মান্যগণ্য ব্যক্তিগণ সভাপতির আসন গ্রহণ করিতেন। ঈশ্বরচন্দ্র সেই সভায় মনোরম প্রবন্ধ ও কবিতা পাঠ করিয়াসভাস্হ সকলকে তুষ্ট করিতেন। পরে ঈশ্বরচন্দ্রের ছাত্রগণের মধ্যে যাহাদিগের রচনা উৎকৃষ্ট হইত, তাহারা তাহা পাঠ করিতেন। যে সকল ছাত্রের রচনা উৎকৃষ্ট হইত, তাহারা নগদ অর্থ পুরস্কার পাইতেন। নগর ও মফস্বলের অনেক সম্ভ্রান্ত লোক ছাত্রদিগকে সেই পুরস্কার দান করিতেন। সভাভঙ্গের পর ঈশ্বরচন্দ্র সেই আমন্ত্রিত প্রায় চারি পাঁচশত লোককে মহাভোজ দিতেন।’
বাংলা সনের উদ্ভবকাল নিয়ে নানা মুনির নানা মত। প্রতিটি মতামত যেন যৌক্তিকভাবেই আলোচনা-পর্যালোচনা ও তথ্য বিশ্লেষণের ফল। কেউ বলেন সপ্তম শতাব্দীর গোড়ায় মহারাজ শশাঙ্ক ; কারো কারো মতে গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ (১৪৯৩ – ১৫১৯ খ্রি.) ; আবার কারো যুক্তিতে মোগল সম্রাট আকবর (১৫৫৬ – ১৬০৫ খ্রি.) চালু করেছেন বাংলা বছর। ব্যাপকভাবে প্রচলিত ধারণা এই যে, হিজরি চান্দ্রবছর থেকে আকবর বাংলা সৌরবছর চালু করেছেন। অথচ আকবরের বিশিষ্ট অমাত্য ও সভাপণ্ডিত শেখ আবুল ফজল আল্লামীর (১৫১ – ১৬০২ খ্রি.) আইন-ই-আকবরী (১৫৫৭) গ্রন্হে ৯৯২ হিজরি বা ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে আকবর কর্তৃক ইলাহী সন প্রবর্তনের কথা থাকলেও বাংলা সন প্রচলনের বিষয়টি অনুপস্হিত।
আমরা আরো জানি যে, আকবরের সাম্রাজ্য লাভের বছর অর্থাৎ ৯৬৩ হিজরি (১৫৫৬ খ্রি.) থেকে তৎকালীন ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ফসলি সন চালু করা হয়। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ থেকে ফসলি সনের আরম্ভ। যেমন – ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১৪১৯ ফসলি সনের শুরু হয়েছে। বাংলা ও ফসলি সনের মধ্যে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধান।ইলাহী, ফসলি, আমলি ইত্যাদি সনের হিসেবও আকবরের সময় চালু হয় বলে আমরা জানি। বৃহত্তর ঢাকা, নোয়াখালি, কুমিল্লা ইত্যাদি অঞ্চলে প্রাচীনকালে পরগণাতি সন চালু ছিল বলে প্রমাণিত। বাংলা, বিলায়তি, আমলি, ফসলি, পরগণাতি ইত্যাদি সনের হিসেবে অতি সামান্য পার্থক্য লক্ষ করা যায়, যা নানা হিসেবের তারতম্যে ঘটেছে বলে মনে করা যৌক্তিক। আপাতত সে বড় আলোচনায় যাচ্ছি না।
কোন্ হিজরি সনে বাংলা সনের প্রবর্তন ঘটেছে সে বিষয়ে বাদানুবাদ থাকলেও ব্যাপক প্রবাদ এই যে, সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছে। নগেন্দ্রনাথ বসুর (১৮৬৬ – ১৯৩৮ খ্রি.) বিশ্বকোষে (২১শ ভাগ, কলিকাতা, ১৩১৭, পৃ. ১৮) পাই –
‘এখন ১৩১৬, অথচ হিজরি সন ১৩২৭।২৮ হইতেছে। মুসলমানি পঞ্জিকাকারের মতে হিজরি হইতে ১০ কম করিয়া ধরিয়া আকবর বাদশাহ এই বাঙ্গালা সন প্রচলিত করেন। কিন্তু এ কথা প্রকৃত বলিয়া মনে হয় না। আকবর ৯৬৩ বাঙ্গালা সনে বা ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন, কিন্তু আমরা ৯৪৫ বাঙ্গালা সনের হস্তলিপি দেখিয়াছি। এরূপ স্হলে বাদশাহ আকবরের পূর্ব হইতেই এই অব্দ প্রচলিত ছিল, স্বীকার করিতে হইবে। হিজরি সন চান্দ্রবর্ষ, আর বাঙ্গালা সন সৌরবর্ষ ;চান্দ্রবর্ষ সৌরবর্ষাপেক্ষা কোনো বর্ষে ১০ দিন, কোনো বর্ষে ১১ দিন কম হইয়া থাকে। বর্তমান বর্ষে বাঙ্গালা সনে ও হিজরি সনে ১১ বর্ষ ৩ মাস ১০ দিনের কিছু বেশি প্রভেদ হইতেছে। সুতরাং হিজরি সনের কোন্ অব্দ হইতে বাঙ্গালা সন পৃথক হইয়া আসিয়াছে ? প্রথমে দেখিতে হইবে, প্রতি বর্ষে ১০ দিন হইলে কত বর্ষে ১১ বর্ষ ৩ মাস ১০ দিন হয়।
(১১১২৩০ +৩৩০ +১০) / ১০ = ৪০৬ বর্ষ পূর্বে অর্থাৎ ৯১০ হিজরি সনে বাঙ্গালা সনে মিল হয়। এদিকে আবার দেখি যায় যে, কোনো কোনো বর্ষে ১১ দিন কম। তাহা হইলে গড়পড়তা আরও ৫।৬ বর্ষ বাড়িয়া যায়। এরূপ স্হলে আরও পিছাইয়া গিয়া ৯০৩।৪ হিজরি সনে বাঙ্গালা সনের আরম্ভ ধরিতে হয়। এদিকে এদেশে প্রবাদও আছে, গৌড়াধিপ সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ দেশীয় প্রচলিত সৌরমাসের সহিত সামঞ্জস্য রাখিবার জন্য চান্দ্র হিজরি সনকে সৌর বাঙ্গালা সনে পরিণত করেন।
অস্তিমান বিভিন্ন মত আলোচনা ও বিশ্লেষণমূলক পর্যালোচনা করলে মনে হয় আলাউদ্দিন হোসেন শাহের (১৪৯৩ – ১৫১৯ খ্রি.) ৯০৩ থেকে ৯২৬ হিজরি মধ্যে কোনো সময়ে বাঙ্গালা সনের প্রকাশ ঘটেছে। তবে এ সম্পর্কে প্রকৃত গবেষণাব্রতী পণ্ডিতজনই শেষকথা বলতে পারেন।
বাংলার নববর্ষ আমাদের দৈন্যক্লিষ্ট জীবন-সংগ্রামে নবতর চেতনা আর বোধের সম্মিলন ঘটিয়েছে যুগে যুগে। শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মী তথা আপামর জনসাধারণ বাংলার নববর্ষ উদযাপনে প্রাণের আবেগ-ভালোবাসার ভাণ্ডার যেন উজাড় করে দেয়। বৈশাখের কমনীয়, করাল ও নানা রূপ ছুঁয়ে থাকে তাদের মনের আকাশ। রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১ – ১৯৪১ খ্রি.) তার বৈশাখী হাহাকার প্রকাশ করেন এভাবে –
চক্ষে আমার তৃষ্ণা ওগো, তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে।
আমি বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন, সন্তাপে প্রাণ যায় যে পুড়ে।
আমাদের জীবনে দুঃখ-সুখ-শোক-অশান্তির ঝড় আছে ,পর্যুদস্ত ছন্নছাড়া উদোম ভিটেয় দাঁড়িয়ে তবু স্বপ্ন আঁকা বুকে খাড়াপায়ে দাঁড়াবার জোর খুঁজে এ দেশের মানুষ। যুগ যুগ ধরে চিরায়ত বাংলায় উত্থান-পতনের ডামাডোলেও ঘুরে দাঁড়াবার দ্রোহচেতনা জাগায় নববর্ষ। আমাদের নববর্ষ যে ভাবেই সৃষ্ট হোক না কেন, এ দেশের বৈশাখ রক্তের পরমাণুতে মিশে ঐতিহ্যের গর্ব উচ্চারণ করুক অনন্তকাল।
সমর পালঃ সাবেক তথ্য সচিব।