গণপরিবহন সংকটঃ সাধারন মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে
এসবিডি নিউজ24 ডট কম,ডেক্সঃ গণপরিবহনে মারাত্মক সংকটের কারণে সাধারন মানুষের ভোগান্তি বেড়েই চলছে। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বাস কাউন্টারগুলোতে যাত্রীদের লম্বা লাইন। লোকাল, গেইটলক বা সিটিং সার্ভিস-কোনো বাসেই পা রাখার জায়গা নেই। সিএনজি অটোরিকশা থাকলেও তা যাত্রী হয়রানির ফাঁদে পরিণত হয়েছে। তবে গত কয়েকদিন ধরে সিএনজি অটোরিকশা চালকদের ধর্মঘটের কারণে সংকট আরো বেড়েছে। নেই ট্যাক্সি ক্যাবও। রিকশা ভাড়াও অনেকের নাগালের বাইরে। তারপরও প্রতিদিন ভোগান্তি মাথায় নিয়ে ভিড়ে ঠাসা যানবাহনে পথ চলতে হচ্ছে লাখো কর্মজীবী মানুষকে। গণপরিবহনের এই দুরবস্থায় হাঁপিয়ে উঠেছেন রাজধানীর মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণী।
নগরীতে প্রতিদিন বাড়ছে মানুষ, কিন্তু বাড়ছে না পরিবহন সেবা। অন্যদিকে যা পাওয়া যাচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল, নিম্নমানের হলেও ভাড়া নেয়া হচ্ছে অনেক বেশী। আবার পুরোনো রং চটা গাড়ী গুলোতে উঠতে গিয়ে অনেক সময় জামা-কাপড়ও ছিড়েছে অনেকের। একে তো পরিবহন সমস্য তার উপর যদি গাড়ীতে উঠে জামা-ছিড়ে যায় তা হলে অনেক সময় অফিস করা দুঃষ্কর হয়ে পড়ে বলে জানান প্রতিদিন বাড্ডা থেকে রাজউকে অফিস করা আব্দুল মান্নান। প্রায় একই রকম অভিযোগ করলেন রায়েরবাগ থেকে রাজধানীতে অফিস করা ওয়াদুদ, মাসুদুর রহমান ও স্বর্ণা। তারা আরো বলেন একে তো যাবাহনের সংকট তার উপর মহাসংকট রায়েরবাগ থেকে মতিঝিলে ঢোকা। রায়েরবাগ থেকে মতিঝিলে আসতে কম পক্ষে দুই থেকে আড়াই লেগে যায়। ফাইওভারের কাজ চলার কারণেই যানজট লেগে থাকে প্রতিনিয়ত। অনেকে যানজটের কারণে হেটে আসতে গিয়েও জামা-কাপড় নষ্ট করেন ভাঙ্গাচুরা কর্দমাক্ত রাস্তায় বেখেয়ালী বেরসিক চালকদের জন্য।
অন্যদিকে সড়ক পরিবহন সমিতির একটি সূত্র জানিয়েছে, পুলিশের নীরব চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ পরিবহন মালিকরা। একটি রুটের জন্য পুলিশকে প্রতি মাসে দিতে হয় ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা। প্রতি মোড়ে থাকা ট্রাফিক পুলিশকে সপ্তাহে দিতে হয় ৬ হাজার টাকা। এসব কারণে দিন দিন পরিবহন খাত অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে এবং ব্যবসায়ীরা ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, রাজধানী ও এর আশপাশে ছয় হাজার বাস-মিনিবাস চলাচলের রুট পারমিট আছে। তবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান শুরু হলে ২০ বছরের পুরোনো এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি মিলিয়ে ২ হাজারের বেশি বাস রাস্তা থেকে উধাও হয়ে যায়। এ সময় গণপরিবহন সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। সব মিলিয়ে রাজধানীতে পর্যাপ্ত গণপরিবহন খাতা কলমে থাকলেও বাস্তবে পাওয়া যায় না। ইতোমধ্যে ৪০টির মতো কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেছে মন্তব্য করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতউল্লাহ বলেন, গত সাড়ে তিন বছরে সাড়ে ৩শ’ নতুন গাড়িও রাস্তায় নামেনি অথচ ১ হাজারের বেশি গাড়ির চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, ছাত্রনামধারী ক্যাডারদের ভাড়া না দেয়া, হরতালে গাড়ি ভাংচুর, বাসচালক ও হেলপারদের মারধর প্রভৃতি কারণে পরিবহন ব্যবসা অলাভজনক হয়ে উঠেছে।
রাজধানীতে বাস সংকটের সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে যানজটের কথা উল্লেখ করেছেন পরিবহন মালিকরা। তাদের মতে, তিন বছর আগেও একটি বাস বা মিনিবাস দিনে ১৭০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার চালানো সম্ভব হতো। কিন্তু বর্তমানে ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটারের বেশি চালানো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ যানজট। এর ফলে প্রত্যেকটি বাস-মিনিবাসের ট্রিপ অর্ধেকে নেমে আসছে। সেই সঙ্গে চাঁদাবাজি, মোটর পার্টসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে মহানগরীতে চলাচলের জন্য নতুন বাস সার্ভিস চালু করতে উদ্যোক্তারা এখন আর খুব একটা এগিয়ে আসছে না।
সড়ক পরিবহন সংশ্লিষ্টদের দাবি, রাজধানীতে গত চার বছরে ৪২টি পরিবহন কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে এসোসিয়েশন অব বাস কোম্পানিজ-এবিসি’র অধীনে থাকা ১৮টি কোম্পানির বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর মে মাসে বন্ধ হয়েছে সাভার-মতিঝিল রুটে চলাচলকারী গ্রেট ওয়াল কোম্পানির ৩০টি গাড়ি। যানজটের কারণে আগের চেয়ে ট্রিপ কয়েক গুণ কমেছে এমন অজুহাতে এই সার্ভিসগুলো বন্ধ হয়ে গেলেও এর পেছনে রাজনৈতিক প্রভাবও কাজ করেছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। পরিবহন নেতাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দ্বন্দ্বের কারণে কিছু পরিবহন কোম্পানি বিভিন্ন রুটে গাড়ি চালাতে পারছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাপান কিংবা অন্যান্য দেশ থেকে উন্নতমানের গাড়ি আমদানি এখন পুরোপুরি বন্ধ। হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া ২০০৪ সালের পর ভালোমানের বাস কেউ আমদানি করতে পারেনি। বেশি যাত্রী পরিবহনের স্বার্থে ছোট বাস আমদানি নিরুৎসাহিত করতে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে অনেক আগেই। যার ধারাবাহিকতায় ৪০ থেকে ৫৬ সিটের বাস আমদানি করার পক্ষে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দফতর ও সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠন করা হয় ঢাকা রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি-আরটিসি। এই কমিটির ওপর নির্ভর করে রাজধানীতে নতুন পরিবহন অনুমোদনের পুরো বিষয়টি। তবে কিছুদিন যেতে না যেতেই কমিটির বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ ওঠে। রাজধানীতে চলাচলের জন্য চীন ও ভারত থেকে যারা গাড়ি আমদানি করতে রাজি হন তারাই শুধু আরটিসির অনুমোদন পান বলে অভিযোগ রয়েছে। এর পেছনে আর্থিক বাণিজ্যসহ রাজনৈতিক কারণ রয়েছে বলে দাবি করেন পরিবহন ব্যবসায়ীরা।
সরকারের নীতিগত কারণে যানবাহন সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে মন্তব্য করে এসোসিয়েশন অব বাস কোম্পানিজ-এবিসি’র সভাপতি রফিকুল হক খান কাজল বলেন, সরকারের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট নয়। যানবাহন সংকটসহ পরিবহন খাতের বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে সরকারের কাছে একাধিকবার দাবি উত্থাপন করেও কোনো লাভ হয়নি।