৪৫ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ ।। কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ আতঙ্কে
বিশেষ প্রতিনিধি,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার লক্ষাধিক মানুষের ঘুম ভাঙে বেড়িবাঁধ ভাঙন আতঙ্কে। রাজাখালী, মগনামা ও উজানটিয়া ইউনিয়নের প্রায় ৪৫ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধের কারণে তাদের দিন কাটে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল পেকুয়ার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। গৃহহারা হয়েছিল ৫০ হাজার মানুষ। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল অগণিত বসতবাড়ি, চিংড়িঘের, কৃষি ফসল ও অস্থাবর সহায় সম্পত্তি। পেকুয়া উপকূলীয় এলাকার মানুষ বছরের প্রায় ৬/৭ মাস বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াই করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন। বেড়িবাঁধ এমন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে যে, সব সময় চরম আতঙ্কে তাদের দিন কাটে। প্রায় দিনই অতিরিক্ত জোয়ারের পানি বসতবাড়িতে ঢুকে পড়ে। প্রায় রাতে ঘুমের মাঝে বড় বড় ঢেউয়ের শব্দে অনেকের ঘুম ভেঙে যায়।
বদরখালী এলাকার হাজি নুরুল কাদের (৭৩) জানান, সাগর অনেকদূরে ছিল। বেড়িবাঁধ ভেঙে আমাদের মসজিদের কাছে চলে আসছে। নতুন বাঁধ না হলে এই বর্ষায় মসজিদ নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পরে। ১৯৯১ সালের তুফানে এই এলাকায় হাজার হাজার মানুষ, গরু-ছাগল, হাস-মুরগি, পশুপাখি মারা গেছে। বেড়িবাঁধের পারে পারে সব মানুষের কবর। সেদিনের বিভীষিকা মনে হলে এখনো ভয় লাগে। বেড়িবাঁধ এখন যেভাবে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে ১৯৯১’র চাইতে ছোটখাটো ঝড় এলেই মৃত্যুর সংখ্যা আগের চেয়ে বেশি হবে। সেদিন কুতুবদিয়া দ্বীপের হাজার হাজার লাশ এখানে ভেসে এসেছিল। চারদিকে শুধুই লাশ আর লাশ! আগের ভয় কাটেনি। সামান্য সিগনাল শুনলেই ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নেই। কিন্তু আশ্রয় কেন্দ্রের সংকটে অনেকেই দূর-দূরান্তের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে চলে যাই। কয়েক মাস আগেও সুনামি হবে শুনে সবাই ঘরবাড়ি থেকে পালিয়ে চলে যাই অন্যত্র। একই এলাকাবাসী জাহাঙ্গীর আলম জানান, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের দিন যখন ৭ নম্বার সিগন্যাল দিয়েছে আমি তখন ছিলাম সাগরে। আমার বাবা আমার জন্য ভাত নিয়ে আসেন। আমার সঙ্গে আমার ভাই ছিল। ঝড় শুরু হলে নৌকা ডুবে যায়। তারা দুজনই মারা যান। তখন অনেক মানুষ, বসতবাড়ি, মসজিদ-মাদ্রাসা সাগরে ভেসে গেছে। বর্তমান যেখানে বসতবাড়ি গড়ে উঠেছে সেখানেও সাগরের পানি আসছে। মগনামা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ইউনুছ চৌধুরী জানান, বর্ষা এলেই কাকপাড়া পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। আবার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়; আবার ভেঙে যায়। এর কারণ প্রতিবারই টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মিত হয় না। এ ছাড়া বাঁধ নির্মাণ কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়।
মগনামা ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল মোস্তফা জানান, ১৯৯১ সালে পেকুয়ায় পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র ও টেকসই বেড়িবাঁধ থাকলে এত মানুষের প্রাণহাণির ঘটনা ঘটত না। বর্তমান বেড়িবাঁধের অবস্থা নাজুক। সাধারণ পূর্ণিমার জোয়ারে অনেক গ্রাম প্লাবিত হয়ে যায়। কাকপাড়া পয়েন্টে ১ কিলোমিটার, শরৎঘোনা পয়েন্টে ১ কিলোমিটার, পশ্চিমকূল এলাকায় ৫ চেইন বেড়িবাঁধ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। জরুরিভিত্তিতে এসব এলাকায় টেকসই বাঁধ দেওয়া না হলে পুরো মগনামা যে কোনো দিন তলিয়ে যেতে পারে।
উজানটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান এ টি এম শহিদুল ইসলাম চৌধুরী জানান, উজানটিয়ার মানুষ ১৯৯১ সালের চেয়ে বর্তমানে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। অরক্ষিত বেড়িবাঁধের ফলে এলাকাটি যে কোনো দিন অতি জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। এই ইউনিয়নের প্রায় ৩৪ কিলোমিটার এলাকায় বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউনিয়নের করিয়ারদিয়ায় দেড় কিলোমিটার ও গোদারপাড় এলাকায় দেড় কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ছাড়া পুরো এলাকার উপকূলীয় এলাকা কার্যত অরক্ষিত। পেকুয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জানান, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়েছে। এ কারণে বেড়িবাঁধ যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায় পানি ধারণ করতে পারছে না। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ চরম হুমকির মধ্যে বসবাস করছে। রাজাখালী, মগনামা ও উজানটিয়া ইউনিয়নের প্রায় ৪৫ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হলে পেকুয়া উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুর-ই খাজা আলামীন বলেন, কুতুবদিয়া ও পেকুয়ার বয়স্ক মানুষের সঙ্গে কথা বলে যতটুকু জানতে পেরেছি উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তন এসেছে। সাগরের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। জোয়ারের পানি আগের চেয়ে উঁচু। মগনামা থেকে উত্তর দিকে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। বাঁধপ্রতি বছরই ভাঙছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কয়েক বছর যাবৎ বাঁধ করবে বলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। এ কারণে সাগরের লোনা পানি ফসলিজমিতে প্রবেশ করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। আগে উপকূলীয় এই এলাকায় প্রচুর ঝাউ ও প্যারাবন ছিল। বনদস্যুরা তা কেটে উপকূলকে অরক্ষিত করে ফেলেছে। সে কারণেও সাগরের পানি সরাসরি বেড়িবাঁধকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর গাছপালা ছিল; তা ব্যাপকহারে উজাড় করা হয়েছে। রাজাখালীর প্রান্ত থেকে উজানটিয়া ও মগনামার শেষ পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার এলাকায় আমরা প্রায় সাড়ে ৪ লাখ ম্যানগ্রোভ চারা লাগিয়েছি। গাছ বড় হচ্ছে। আগামী ৫ বছরে আবারো উপকূল সবুজে ছেয়ে যাবে। উপকূল রক্ষা হবে।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাইনুদ্দিন জানান, মগনামায় বেড়িবাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। সরকারি বরাদ্দ এলে সহসাই বাঁধ সংস্কারের কাজ শুরু করা হবে।