জোড়া খুনের সূত্রপাত গত বছরঃ এক দশকে ২৩ সাংবাদিক খুন!
শুভাশিস ব্যানার্জিঃ
গত বছর জানুয়ারীতে স্বস্ত্রীক নিহত হন সাংবাদিক ফরহাদ খাঁ। স্বস্ত্রীক সাংবাদিক খুন হওয়ার ঘটনা সম্ভবত সেখান থেকেই সূত্রপাত। সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি আজও। সংগত কারণেই অপরাধীদের শক্তি বেড়ে যাচ্ছে। যার উদাহরণ হচ্ছে স্বস্ত্রীক সাগর সরওয়ার হত্যা। সন্ত্রাসীরা তাদের ক্ষমতার বৃদ্ধি ও প্রয়োগ ঘটালেও, প্রশাসন তাদের অসাড়তার পরিচয় দিয়েই যাচ্ছে।
বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাংবাদিকরা খুন হলেও একটি ঘটনারও বিচার হয়নি। গত এক দশকে ঘটে যাওয়া ২৩ সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের বিচার এখনও ঝুলে রয়েছে। কয়েকটি মামলার ক্ষেত্রে বছরের পর বছর সময় নিয়েও তদন্ত শেষ করতে পারেনি পুলিশ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা, মূল অপরাধীদের পাশ কাটিয়ে চার্জশিট দেয়া, দুর্বল অভিযোগ উত্থাপন এবং চার্জশিটভুক্ত আসামিদের গ্রেফতার না করার অভিযোগ আছে। এমনকি প্রভাবশালী খুনিদের পক্ষ নিয়ে নিহত সাংবাদিকের পরিবারের সদস্যদের ভয়ভীতি দেখানোরও অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। প্রশ্ন উঠেছে নিম্ন আদালতে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা নিয়েও। সর্বশেষ শুক্রবার রাতে নিজ ফ্ল্যাটে নৃশংসভাবে খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনী।
এদিকে একের পর এক সাংবাদিক হত্যা এবং এক দশকে একজন সাংবাদিক হত্যার বিচারও শেষ না হওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সাংবাদিক সমাজ। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, বিচার না পাওয়ায় সাংবাদিক সমাজ সংক্ষুব্ধ হচ্ছে। রাষ্ট্র সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচারে ব্যর্থ হলে ক্ষুব্ধ সাংবাদিকরা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবেন।
এ ব্যাপারে সাংবাদিক, কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, গত এক দশকে একজন সাংবাদিক হত্যারও বিচার না হওয়া রাষ্ট্রের অমার্জনীয় ব্যর্থতা। একটি হত্যাকাণ্ডেরও বিচার হলে এ ধরনের নৃশংস ঘটনা একের পর এক ঘটত না।
গত এক দশকে খুন হয়েছেন যারা : এক দশকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৩ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনী হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এ সংখ্যা ২৫-এ দাঁড়াল। ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি নিজ বাসায় স্ত্রীসহ খুন হন সাংবাদিক ফরহাদ খাঁ। এর আগে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে খুন হন আরও ১৪ সাংবাদিক। ২০০৫ সালের ১৭ নভেম্বর দৈনিক সমকালের ফরিদপুর ব্যুরো প্রতিনিধি গৌতম দাসকে খুন করে এলাকার ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী একটি প্রভাবশালী চক্র। এ চক্রের অনিয়ম, জালিয়াতির বিরুদ্ধে সংবাদ পরিবেশনের কারণে তাকে সন্ত্রাসীরা আগে থেকেই হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল। ২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি খুলনা প্রেস ক্লাবের সামনে সন্ত্রাসীদের বোমা হামলায় নিহত হন দৈনিক সংবাদের খুলনা ব্যুরোপ্রধান এবং প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মানিক সাহা। ২০০৪ সালের ২৭ জুন নিজের অফিসে নিহত হন খুলনার দৈনিক জন্মভূমি সম্পাদক হুমায়ুন কবীর বালু। ২০০০ সালের ১৬ জুলাই দৈনিক জনকণ্ঠের যশোর প্রতিনিধি শামছুর রহমান কেবল যশোরের জনকণ্ঠ কার্যালয়ে খুন হন। ২০০৪ সালের ২ অক্টোবর বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক দুর্জয় বাংলার নির্বাহী সম্পাদক এবং বিএফইউজের তৎকালীন সহ-সভাপতি দীপংকর চক্রবর্তী নিজ বাসায় নিহত হন। ২০০৫ সালের ২৯ মে দৈনিক কুমিল্লা মুক্তকণ্ঠের সম্পাদক মুহাম্মদ গোলাম মাহফুজ নিহত হন। ২০০৪ সালের ২ মার্চ কেরানীগঞ্জে দি নিউ এজের সাংবাদিক আবদুল লতিফ পাপ্পু নিহত হন। এ ছাড়া ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত পেশাগত কারণে খুন হয়েছেন দৈনিক পূর্বাঞ্চলের স্টাফ রিপোর্টার হারুনার রশীদ খোকন, খুলনার দৈনিক অনির্বাণের রিপোর্টার এসএম নাহের আলী, সরদার শুকুর হোসেন, ঝিনাইদহের বীর দর্পণ পত্রিকার মীর ইলিয়াস হোসেন দিলীপ, দৈনিক জনবাণীর রিপোর্টার বেলাল হোসেন, যশোরের দৈনিক রানারের গোলাম মাজেদ, রাঙামাটির এনটিভি প্রতিনিধি জামালউদ্দিন, খুলনায় দৈনিক সংগ্রামের বেলাল হোসেন, নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় দৈনিকের সাংবাদিক আহসান আলী, মৌলভীবাজারের ফারুক আহমেদ, নীলফামারী থেকে প্রকাশিত নীলসাগরের সাংবাদিক কামরুজ্জামান, গাইবান্ধার ফরিদুর রহমান রঞ্জু এবং সাতক্ষীরায় শ ম আলাউদ্দিন। ১৯৯৮ সালের ৩০ আগস্ট যশোরের দৈনিক রানার সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল এবং ১৯৯৬ সালের ৮ জুন সাতক্ষীরার পত্রদূত সম্পাদক শ ম আলাউদ্দিন হত্যা ছিল চাঞ্চল্যকর সাংবাদিক হত্যার ঘটনা।
একটি মামলারও বিচার হয়নি : অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত এক দশকে সাংবাদিক হত্যার কোনো বিচার হয়নি। সাংবাদিক দম্পতি ফরহাদ খাঁ হত্যা মামলার তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে আপত্তি তুলেছেন তার একমাত্র মেয়ে আইরিন পারভীন খান। তিনি সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, মামলায় খুনের পরিকল্পনাকারীদের বাদ দিয়ে শুধু হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দুই কিশোরকে আসামি করা হয়েছে। এমনকি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবুল খায়ের মাতবর এ বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে তাকেও ভয়ানক পরিণতি বরণ করতে হবে বলে হুমকি দেন। মামলার চার্জশিট হলেও এখন পর্যন্ত বিচার শুরু হয়নি। ২০০৬ সালের ২৮ আগস্ট গৌতম দাস হত্যা মামলা ঢাকার দ্রুত বিচার আদালতে স্থানান্তর করা হলেও এখন পর্যন্ত বিচার শেষ হয়নি। সর্বশেষ ৮ ফেব্রুয়ারি মামলার শুনানির পর আবারও ১৬ ফেব্রুয়ারি শুনানির পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। হুমায়ুন কবির বালু হত্যাকাণ্ডের আট বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত তদন্ত শেষ হয়নি। উন্মোচিত হয়নি খুনিদের মুখোশ। ফলে বিচার কাজও শুরু হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালী মহল এবং পুলিশ এ মামলা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করার কারণেই মামলার তদন্ত শেষ করা হচ্ছে না।
মানিক সাহা হত্যা মামলার বিচার আট বছরেও শেষ হয়নি। খুলনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটির বিচার এখনও চলছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালী মহলের মদদে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত কয়েক জনকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে পুলিশ। গত ১১ বছরেও শেষ হয়নি শামছুর রহমান কেবল হত্যার বিচার। পাঁচ বছর ধরে মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। একইভাবে ১৩ বছরেও শেষ হয়নি সাইফুল আলম মুকুল হত্যা মামলা। মামলার চার্জশিটভুক্ত সব আসামি রয়েছে জামিনে। অনেকে এ মামলা কবর দেয়ার জন্য সরকার, এমনকি মিডিয়াকে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ পরিবারের সদস্যদের। অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেও বিচার সম্পন্ন কিংবা হত্যাকারীর শাস্তি হওয়ার কোনো রেকর্ড পাওয়া যায়নি। অতীতের অভিজ্ঞতায় সর্বশেষ সাগর সরওয়ার এবং মেহরুন রুনী দম্পতি হত্যার বিচারও হবে কি-না তা নিয়ে সাংবাদিক সমাজ সংশয়ে আছে। একই সঙ্গে পেশাগত দায়িত্ব পালন নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে আতঙ্ক।
অবিলম্বে এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার করা না গেলে, আমাদের ধরেই নিতে হবে, দেশে আইন-শৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। যে দেশের সরকার সাধারণ জনগণের প্রাণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না, সেই দেশের কাছে মানুষ কী আশা করবে। এই লজ্জা কার? কেন সরকারের এই ব্যর্থতা? প্রশাসন কাদের কাছে জিম্মি? এই প্রশ্ন গুলোই এখন উকি দিচ্ছে জনমনে। আমরা এর প্রতিকার চাই।
শুভাশিস ব্যানার্জিঃ সম্পাদক,এসবিডি নিউজ২৪ ডট কম।