সংসার এবং সমাজে মেধাবী একজন লেখক স্বপন রক্ষিতের মূল্য!
প্রণব মজুমদারঃ নিত্য শিক্ষা আমার সাধ। মেধার স্পর্শে যাওয়া আমার হৃদয়বিলাস। এ বিলাসিতার অভিপ্রায়ে একদিন গিয়েছিলাম তাঁর কাছে। যদিও সে আজ আর নেই। ২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট সে চলে গেছে পরলোকে- অজানা এক দেশে। নাম তাঁর স্বপন রক্ষিত। জীবনের অমিত্মম মুহূর্তে তার নামের সঙ্গে যুক্ত ছিলো ডাক্তার পদবী। হ্যাঁ রামকৃষ্ণ মিশন হোমিও দাতব্য চিকিৎসালয়ের ডাক্তার স্বপন রক্ষিতের কথাই বলছি। বলছি সেই স্বপন রক্ষিতের কথা যার হাত দিয়ে রচিত হতো প্রবন্ধ, কবিতা, গীত, স্মৃতিকথা, সংবাদ-নিবন্ধ আরও কতো কি। শিক্ষাব্রতি স্বপন পত্র পত্রিকা এবং নানা বিষয়ের বই আদি অমত্ম পড়তো। মনে পড়ছে মেধা সম্পন্ন স্বপনের প্রথম স্পর্শ স্মৃতির মুহূর্তটুকু।
১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাস। চাঁদপুর পুরান আদালত পাড়ার পুলিশ সেকশনের পূর্ব পাড়। প্রয়াত ননী দারোগার বাসায় ভাড়া থাকি আমরা। স্বপনরা থাকে কালু হাওলাদারের টিনের ঘরের ভাড়া বাসায়। ক্লাশ এবং বয়সের দিক থেকে ও আমার ৩ বছরের ছোট। ভারি ফ্রেমের চশমাধারি স্বপনের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়। চশমা পড়েন পন্ডিত এবং অধিক মেধাবী ব্যক্তিরা ! এমন ধারণা আমার ছেলেবেলা থেকেই। খোঁজ নিয়ে জেনেছি ছেলেটি জুবলি স্কুলে পড়ে এবং মেধাবী। জুবলি স্কুল মানে চাঁদপুর হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। স্থির চাউনিতে চশমার ওপর দিয়ে তাকায় ছেলেটি। নিজে গণি আদর্শ বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ায় জুবলি স্কুলের ছাত্রদের প্রতি ছিলো আমার বিশেষ দুর্বলতা। এর কারণও অবশ্য ছিলো। আমাদের সময়ে এ বিদ্যাপীঠটি কুমিলস্না বোর্ডের মধ্যে বেশ ভালো রেজাল্ট করতো। একেতো ভালো স্কুলের ছাত্র, তার মধ্যে চোখে আবার চশমা। এই দুই বৈশিষ্ট্যের কারণে স্বপনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য অস্থির হয়ে পড়ি আমি। মাঝে মাঝে ছেলেটির সঙ্গে দেখা হয়। কথা শোনার অজুহাতে একদিন ওর গা ঘেঁষে গেলাম। কিন্তু ছেলেটি মৌণ এবং গৌণ তার চলার গতি। আরেকদিন মুখোমুখি সাক্ষাৎ। এবার দিলাম রীতিমতো ধাক্কা। ও পড়ে গেলো মাটিতে । কিন্তু তেমন প্রতিক্রিয়া নেই। শুধু বললো চশমাটা গেলো কই ? এমন কা– আমিতো ভড়কে গেলাম। ভাবলাম বা বা এতো অহংবোধ ছেলে তোমার ? শারোদীয় দুর্গোৎসব চলছে তখন। বাসার কাছেই জে.এম.সেনগুপ্ত রোডের মিনার্ভা মেস। এখানে দুর্গাদেবীর পুজা হচ্ছে। মেসের পাশেই বিনোদনী হোমিও হল। এ হোমিও হলের চিকিৎসকের নাম ফণীন্দ্র চন্দ্র দত্ত। তার সহকারি শ্যামল কামিত্ম রক্ষিত। ব্রীজের গোড়ায় সিড়ি বেয়ে বিনোদনী হোমিও হলের ডাক্তার চেম্বারে যেতে হয়। ডাক্তার বাবুর পিছনে একটি ছোট চিলেকোঠা। একটি জীর্ন টেবিল, বেশ পুরানো দু’টি চেয়ার। সেখানে শ্যামল বাবু সাবুদানার মতো হোমিও বড়ির প্যাকেট তৈরি করেন। এ শ্যামল বাবু হচ্ছেন স্বপনের ৪ নম্বর বড় ভাই। আরেকটি ভাঙ্গা চেয়ারে বসে স্বপন রক্ষিত। এখানে সে পড়াশোনা করে। মিনার্ভা মেসের পুজার প্রসাদ বিতরণের দায়িত্বে স্বপনের এ ভাই। ডাক্তার বাবু নেই চেম্বারে। বিকেল তখন। বিজলী মাইক সার্ভিসের ভাড়া করা গগণভেদি শব্দযন্ত্রে ভারতীয় আধুনিক বাংলা গান। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের রেকর্ডে বাজছে ‘আমি তার ছলনায় ভুলবো না, কাজ নেই আজ আমার ভালোবেসে’। সেদিন ছিলো মহাঅষ্টমী। প্রসাদের অজুহাতে ঢুকে পড়ি চেম্বারের ভেতরে। পাটিগণিত অংক করছিল স্বপন। শ্যামল বাবুর গম্বীর প্রশ্ন কি চাই ? – প্রসাদ। এগিয়ে এলো স্বপন। হাত বাড়িয়ে দিলো কলা, নারিকেল কোড়া, খিরাই ও আপেল আর আনাসর। মিষ্টির প্রতি লোভ তাই ক্ষীরের সন্দেশের কথা বলতেই হাত বাড়িয়ে দিলাম। বললাম ২টি দাও। ও আমাকে ৩টি সন্দেশ দিলো। তা পেয়ে একসঙ্গে মুখে নিলাম ঠিকেই। কিন্তু তখন বেশ অপরাধবোধ আমার। বললাম সেদিন তোমাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি। কিছু মনে করোনিতো ? ও বললো না কিছুই হয়নি। সেদিন ওর সঙ্গে চিলেকোঠার জানালা দিয়ে খালে ডাকাতিয়া নদীতে বয়ে চলা জলের তীব্র স্রো্ত লÿ্য করলাম। নাম বলতেই ও বললো আপনিই তাহলে দেয়ালিকার সেই নিয়মিত ছড়া ও গল্প লেখক। সে সময় বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে নিয়মিত দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ হতো। মনে পড়ে আলীমপাড়ার মাহবুবুর রহমান সেলিম ভাইয়ের কথা। সম্ভবত এখন তিনি মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী। তার সুন্দর হাতের লেখায় নিয়মিত বের হতো সে পত্রিকা। পালপাড়ার ফেরদৌস মোবারক, পুরানবাজারের শম্ভু আচার্যী মান্না, নাজিরপাড়ার সেলিম কলিও ছিলেন নিয়মিত লেখক। দেয়াল পত্রিকার লেখক হওয়ায় স্বপনের কাছে আমার কদর বেড়ে গেলো। দেখলাম ওর মনের মধ্যেও কৌতুহলের স্রো্ত বয়ে যাচ্ছে। পরে সংবাদ, ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলার শিশু কিশোর পাতা, কিশোর বাংলা, চাঁদপুর বার্তাসহ বিশেষ দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত স্থানীয় বিভিন্ন ম্যাগাজিনে লেখার সুবাদে সে সম্পর্ক গাঢ়তর হলো।
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য চলে এলাম ঢাকায়। চাঁদপুরের সাহিত্য এবং শিল্প সংস্কৃতির খবরাখবর ও আমায় নিয়মিত চিঠিতে জানাতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধে যখন চাঁদপুর যেতাম ও খবর পেয়ে চলে আসতো। স্বপনেরা ৬ ভাই। ও সবার ছোট। স্বপন আর সেজ ভাই পৃথিবীতে নেই। বিশিষ্ট তবলাশিল্পী শামিত্ম রক্ষিত সবার বড়। তিনি জোড়পুকুর পাড়ে আলাদা ছোট বাসায় ভাড়া থাকেন। কুমিলস্না রোডে গণি স্কুলের সামনে অবস্থিত মুক্তি হোমিও হলের চিকিৎসক ডাঃ শ্যামল। এই ভাইয়ের চেম্বারের পিছনে মুন্সেফ পাড়ায় সবুর খানের বাসা। ভাড়া বাসায় শ্যামলদার সঙ্গে বিধবা মা ও স্বপন থাকতো। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে স্বপন উচ্চতর শিক্ষার পথে এগুতে পারেনি। গৃহ শিক্ষকতা করে নিজের খরচ চালাতো। উপার্জিত অর্থে শহরের কালী বাড়ী মোড়ের কৃষ্ট ক্যাফেতে সকাল বিকেলের জল খাবার গ্রহণ এবং শামিত্মদা ও শ্যামলদা এই দু’ভাইয়ের ছেলেমেয়ের প্রায় সকল দায়িত্ব ও একাই পালন করতো। এ যেন আশ্রয়ের বিনিময়। শুধু সংসারে নয়, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমাজ জীবনে স্বপন নিজের চেয়ে বেশি ভালবাসতো মানুষকে। নিকট আত্নীয়রা চুষে নিতো ওর মাত্রারিক্ত পরিশ্রম। তার বিপরীতে ও পেতো চরম অবহেলা। ওর শারীরিক অতি অপুষ্টিই শেষ পর্যমত্ম তার অকাল মৃত্যুকে বেগবান করে।
প্রগতিশীল ভাবধারা এবং সুস্থ সাহিত্য সংস্কৃতি এবং সাংবাদিকতাকে সমর্থন করতো বলেই বয়সের ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও ওর সঙ্গে আমি মিশতাম। ষ্টেডিয়াম রোডে শহরের মনোরম লেকের পাড়, লেকভিউ রেষ্টুরেন্ট, প্রেস ক্লাব, পৌর পাঠাগার, বড় ষ্টেশনের ‘ঠোডা’ এবং চিত্রলেখা সিনেমা হলের মোড়ে জয়নালের রেষ্টুরেন্টে আঞ্চলিক, জাতীয় ও আমত্মর্জাতিক নানা বিয়য়ে আড্ডা হতো। বন্ধুবর সাহিত্যিক ও সাংবাদিক নীতিশ সাহা পাক্ষিক শিরোনামের সম্পাদক। সাংবাদিকতার প্রতি তীব্র আগ্রহ দেখে আমার অনুরোধে নীতিশ ওকে কুমিলস্না থেকে প্রকাশিত ট্যাবলয়েড শিরোনাম (যা বহু বছর ধরে জাতীয় দৈনিক) মানে ওর পত্রিকার চাঁদপুর প্রতিনিধি বানিয়ে ফেললো। তাছাড়া স্থানীয়ভাবে পত্র পত্রিকায় ওর লেখা প্রকাশ হতো। কুমিলস্না হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ার সুবাদে নীতিশের সঙ্গে ওর সে সম্পর্ক আমত্মরিক হয়। কষ্ট ও লাঞ্চনায় মরে যাবে তবুও মুখ ফুটে কিছু বলবে না। অমত্মমুর্খি এ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ওর একটা বিশেষ ভাব লক্ষণীয় ছিলো তা হলো কারো সমালোচনা না করা। শত্রম্নকে মিত্র মনে করা ওর জীবনের ধর্ম ছিলো যা আমাদের মধ্যে এখন কোথায় ?
বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ কমরেড এডভোকেট আবদুর রহমান মারা গেলেন। স্বপন চিঠিতে জানালো সে খবর। ও বললো রহমান ভাই বলতেন দেখিস স্বপন আমি মরলে ‘ডেকা সাম্বাদিক পনইবায় আমারে নিয়া লেকবো’। কথা রেখেছি রহমান ভাইয়ের। দৈনিক সংবাদে আমি লিখলাম – সবার প্রিয় আপন কমরেড আবদুর রহমান। সংবাদে উপ সম্পাদকীয় কলামে প্রকাশিত লেখাটি নিয়ে স্বপনের কি উচ্ছাস। ও তা রহমান ভাইয়ের অধ্যাপিকা স্ত্রীকে দেখাতে কোড়ালিয়া রোডের শেষ প্রামেত্ম ওনাদের বাড়ীতে ছুটে গেছে।
অজাতশত্রম্ন সাংবাদিক স্বপনের শেষ ইচ্ছে ছিলো বাস স্ট্যান্ডে একটি চেম্বার দেয়ার। অনেক টাকা লাগবে। অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলার বাণীর সিনিয়র অর্থনৈতিক প্রতিবেদক তখন আমি। আমার কাছে সে জন্য টাকা চায়নি ও। শুধু ব্যক্ত করেছিলো ওর ইচ্ছার প্রকাশটুকু। ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ি বেতন পেলেও তা ছিলো খুবই অনিয়মিত। তবুও ওর রোগী দেখা এবং নিয়মিত লেখালেখি নির্বিঘ্নে করার জন্য এ ব্যাপারে সময় চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু কিছুদিন পর চিঠিতে জানালো ও জন্ডিসে আক্রামত্ম। পরে তা মহাব্যাধিতে রূপ নেয়। ২০০২ সালের শেষ দিকে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস নিয়ে মারাত্নক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বপনকে ভর্ত্তি করা হয়েছে। রোগী স্বপনের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ওর সর্বশেষ অগ্রজ অমল রক্ষিত মানে মনা। ওষুধ আনা এবং ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ ইত্যাদি দিকভ্রামত্ম মনাকেই করতে হচ্ছে। ডাক্তাররা জানান ওর যকৃত স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। কোন খাবারই সে গ্রহণ করতে পারে না। ডাক্তারের নির্দেশ অনুযায়ি আমার গিন্নি ওকে জাউ ভাত এবং মশলা ছাড়া কচি মোরগীর মাংস তৈরি করে দিতো। আমি তা দিয়ে আসতাম। প্রায় এক মাস এখানে চিকিৎসার পর ওকে ভারতে নিয়ে গিয়েও কাজ হলো না। সময় অনেক দুর গড়িয়ে গেছে। নিয়ে আসা হলো চাঁদপুরে। অপুষ্টি এবং অবহেলায় দীর্ঘদিনের জন্ডিসের গুপ্ত জীবানু ওর জীবনকে থামিয়ে দিলো ২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট। সেন্ট্রাল হাসপাতালের বিছানাটি ছিলো ওর শেষ শয্যা। সেল ফোনে অপ্রত্যাশিত ওর মৃত্যু সংবাদ জানিয়েছিলো আমার এক সময়কার ছাত্র এবং ম্বপনের বন্ধু এডভোকেট শ্যামল দাস।
স্বার্থের সংসার জীবনে ভাই এবং তাদের বউদের অযত্ন এবং সমাজ সংসারে স্বপনের মতো মেধাবীদের অবহেলা এ যেন স্বাভাবিক চিত্র ! ৯ বছর পর যখন ওকে স্মরণ করছি তখন অনেক প্রশ্নই উঁকিঁ দিচ্ছে। দেশ ও জাতির প্রয়োজনে কেন স্বপনের মতো ভালো আর মেধাবীদের আমরা বেশিদিন ধরে রাখতে পারছি না ? যে মানুষটি জীবনের অধিকাংশ সময় অপরের মঙ্গলের জন্য লেখা ও চিকিৎসার মাধ্যমে সেবা দিয়ে গেলো তাঁর অকাল প্রস্থান কি মানা য়ায় ? আমি যে মানতে পারছি না।
লেখক সাহিত্যিক ও অর্থনীতি বিষয়ের সাংবাদিক এবং জাতীয় পাক্ষিক অর্থকাগজের সম্পাদক
reporterpranab@gmail.com