তৃতীয় শক্তির খোঁজখবর

তৃতীয় শক্তির খোঁজখবর

সাযযাদ কাদিরঃ তৃতীয় শক্তির কথা প্রথম শুনি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ (১৮৭৬-১৯৪৮)-র এক বক্তৃতা প্রসঙ্গে। ১৯৪০ সালে দেয়া সেই বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, “There are two powers in the world; one is the sword and the other is the pen. There is a great competition and rivalry between the two. There is a third power stronger than both, that of the women.”  (‘পৃথিবীতে দুই শক্তি; একটি তলোয়ারের, অন্যটি কলমের। দু’টিতে তীব্র প্রতিযোগিতা ও রেষারেষি। তবে ওই দু’টির চেয়েও জোরালো শক্তি আছে, সে শক্তি নারীর।’) তৃতীয় শক্তির কথা এরপর শুনি একাত্তরের ২৫শে মার্চে এ দেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা অভিযান শুরু হওয়ার পর বিদেশী পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে। সেখানে নিবন্ধকার মন্তব্য করেছিলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ও জুলফিকার আলি ভুট্টো দু’জনেই ভুলে গিয়েছিলেন – দেশে তাঁরা ছাড়াও একটি তৃতীয় শক্তি আছে। সে শক্তি সামরিক বাহিনী।’ এরপর তৃতীয় শক্তির কথা শুনি ১৯৮৩ সালে, শিশু একাডেমীতে আয়োজিত এনজিও-সম্মেলনে এক বক্তার বক্তব্যে। তিনি বলেছিলেন, ‘দেশে এনজিগুলো-ই তৃতীয় শক্তি। আগামীতে আমরাই বসবো রাষ্ট্রক্ষমতায়।’ প্রথম দুই শক্তি বলতে তিনি বুঝিয়েছিলেন রাজনৈতিক দল ও সামরিক বাহিনীকে। তারপর থেকে তৃতীয় শক্তির কথা নানা ভাবে শুনছি নানা মহলের কাছ থেকে। সমাজতন্ত্র, জনগণতন্ত্র, শোষণ-বঞ্চনামুক্ত সমাজ, মার্কস এঙ্গেলস লেনিন স্তালিন মাও হোজা তিতো চে কাসত্রো শাভেজ প্রমুখের কথা বলে – এমন ছোট-ছোট দলগুলো তৃতীয় শক্তি হতে চায় জোট বেঁধে। অন্যদিকে ইসলাম-নির্দেশিত রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করে পুণ্যপবিত্র সমাজ-জীবন প্রতিষ্ঠায় উৎসাহী ছোট-ছোট দলগুলো নিজেদের তৃতীয় শক্তিই ভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শর্তে। দু’টি জোটই সামনে দেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে। তাঁরা ভাবেন, ‘আমরা যেদিকে যাবো সেদিকেই জয়, আমাদের ছাড়া কারও জয় নয়’। তাঁদের ওই চিন্তার প্রভাব ওই দুই দলের ওপর আছে। তাই দুই দলই জোটে বদ্ধ করতে চায় তাদের। সাধ্যমতো করেছেও। তবে এর বাইরেও আছে আরও দল-বল। দুই দলের দলছুটেরা মাঝে-মধ্যে ঐক্যপ্রয়াসী হয়, এক মঞ্চে ওঠে। জোট গড়তে চায়, মোর্চা বানাতে চায়। গত তদারক সরকারের সময় কিছু তৎপরতা চোখে পড়েছে তাদের। আবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ঘিরেও একটি শক্তি উঠতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়েছে ওই সময়। এজন্যই তর্ক হয় – তৃতীয় শক্তি বলে কখনও কোনও কিছুর গড়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে কিনা। অবশ্য এবার আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে এ শক্তির কথা প্রচার হচ্ছে জোরেশোরে, বেশি-বেশি করে।
এ শক্তি নতুন কিছু নয়। নানা দেশে এ নামে আছে নানা শক্তি। আয়ারল্যান্ডে আধাসামরিক বাহিনী পরিচিত তৃতীয় শক্তি হিসেবে। ফ্রান্সে চতুর্থ প্রজাতন্ত্রের সময় গড়ে ওঠা এক জোট পরিচিতি পেয়েছিল তৃতীয় শক্তি নামে। মিয়ানমারে ২০১০ সালের নির্বাচনে সেনা ও সুচি বিরোধী দলগুলোর জোট অভিহিত হয়েছে ওই নামে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসন অবসানের শেষ দিকে পরিবর্তন-বিরোধী এক জঙ্গি গোষ্ঠী মেতেছিল নৃশংস নাশকতায়। তাদের বলা হতো তৃতীয় শক্তি।
তবে আমাদের এখানে তৃতীয় কেন, প্রথম বা দ্বিতীয় শক্তিও নেই। এখানে শক্তি একটাই – জনশক্তি। এ শক্তি কথিত সকল শক্তিকেই গদিতে উঠিয়েছে, আবার হিড়-হিড় করে নামিয়েও দিয়েছে! সকল দম্ভীর দর্পই চূর্ণ করেছে এ শক্তি, ভবিষ্যতেও করবে।

অতিথি লেখক