মায়ের কোলও এখন আর নিরাপদ নয়!
মীর আব্দুল আলীমঃ “কেরানীগঞ্জে প্রকাশ্য দিবালোকে মায়ের বুকে গুলি করে শিশুকে অপহরণ” এবং “ক্যাডারদের হাতে তিন লাখ অস্ত্র” এমন শীরোনামে সংবাদ ছাপা হয়েছে ঢাকার ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় দৈনিকে। দুর্বৃত্তরা কতোটা বেপরোয়া এবং সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্যের কাছে দেশের মানুষ আজ কতোটা অসহায় এসব সংবাদ তারই জ্বলন্ত সাক্ষ্য। প্রতিদিন এ ধরনের চলমান সহিংস ঘটনায় দেশের সাধারন মানুষের মধ্যে অতংক বাড়ছে। রাজধানীর উপকণ্ঠ কেরানীগঞ্জে প্রকাশ্য দিবালোকে মা-মেয়ে ও গাড়িচালককে গুলি করে ফিল্মি স্টাইলে ৬ বছরের শিশু পরাগকে অপহরণ করে নেয়ার ঘটনাটি যারপরনাই বিস্ময় ও উদ্বেগের। সিনেমার দৃশ্যের মতো গত ১১ নভেম্বর মায়ের কোল থেকে এ শিশু অপহরণের ঘটনা ঘটে। এ অবস্থায় সুস্থ সমাজ বিনির্মাণ এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে চলমান রাখা যে কোনো সরকারের পক্ষেই কঠিন হয়ে পড়বে। অস্ত্র যেভাবে আসছে সহিংসতা খুন খারাবি আরও বাড়বে। কথায় কথায় অস্ত্র প্রদর্শন চলছে যত্রতত্র। সহিংসতা, দখলবাজি, খুনিখারাবি, টেন্ডারবাজি,ভর্তিবাজি, বখাটেপনাও সর্বপরি চাঁদাবাজি চলছেতো চলছেই। রোধকারা যাচ্ছে না। সরকার দলীয়রাই বেশী করছে এসব। তবে কোথাও কোথাও জামায়েত-শিবির, যুবদল, ছাত্রদলের সোনার ছেলেরাও এ দু:সময়ে কম যাচ্ছে কৈ ! কয়েক বছরে অস্ত্রবাজদের সংখ্যা কমলেও এখন যেভাবে অস্ত্র আসছে তাতে করে অস্ত্রবাজরা মাথা চাড়া দিয়েতো উঠবেই। তারা দাবড়ে বেড়াতে শুরু করেছে। এদের হাতে কারনে অকারনে নির্মমভাবে খুন হচ্ছে নিরিহ মানুষ। শুধু তাই নয় এসবের প্রতিবাদ করায় মা, শিক্ষক এমনকি প্রতিবেশীরাও পর্যন্ত জীবন দিচ্ছে। পত্রিকা গুলো প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন জায়গার এমন সংবাদ ছাপছে। ক্ষমতার দাপট, দলীয় আশ্রয় প্রশ্যয় আর অস্ত্রের জোড়ে সন্ত্রাসী তরুন-যুবকরা ধরাকে সরাজ্ঞেন ভাবতে শুরু করেছে। তাই বাড়ছে এ ধরনের অপরাধ। এ ক্ষেত্রে দলীয প্রশ্রয় বন্ধ করতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে তাদের নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। তারা যেন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত না হয় সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে। তাতে অপরাধ কমবে।
চারদিকে কেবলই অরাজকতা। অবক্ষয় ঘিরে আছে গোটা দেশ। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ সন্ত্রাসের কালো থাবা তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে চলেছে। আমাদের নির্ভরতার জায়গা কমে যাচ্ছে। মায়ের কোলও আজ নিরাপত্তাহীন হয়ে পরেছে। শিশুর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান মায়ের কোল। নিশ্চিত আশ্রয় সেই মায়ের কোলও শিশুর জন্য নিরাপত্তাহীন হয়ে উঠছে কেন ? তাহলে মানুষের শেষ ভরসাস্থল আর রইলো কি ? পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ঘটনার বর্ণনা থেকে জানা যায়, গত ১১ নভেম্বও রোববার সকাল সোয়া ৭টার দিকে কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা পশ্চিমপাড়া এলাকায় শিল্পপতি বিমল ম-লের স্ত্রী লিপি ম-ল তার দুই মেয়ে পিনাকী ও পিয়ালী এবং একমাত্র ছেলে পরাগ ওরফে ভোলাকে সঙ্গে করে প্রতিদিনের মতো এদের স্কুলে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হন। গলির মুখে রাখা তাদের গাড়ির কাছে আসামাত্র মুহূর্তের মধ্যে পশ্চিম দিক থেকে দুটি মোটরসাইকেল এসে গাড়ির পাশে থামে। মোটরসাইকেলের পেছনে বসা দুই যুবক নেমে এসে চালকের কাছে রোগী নেয়ার কথা বলে গাড়ির চাবি চায়। চাবি দিতে অস্বীকার করায় তারা চালকের পায়ে গুলি করে। এ সময় লিপি ম-ল সন্তানদের গাড়িতে না উঠিয়ে জড়িয়ে ধরেন। সন্ত্রাসীরা তার কাছ থেকে পরাগকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। লিপি ম-ল ছেলেকে আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করেন। টানাহেঁচড়ার একপর্যায়ে সন্ত্রাসীরা লিপি ম-লকে গুলি করে। এ সময় পিনাকি চিৎকার করতে থাকলে তাকেও গুলি করে দুর্বৃত্তরা। এরপর শিশু পরাগকে মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে একটি মোটরসাইকেলে দুজনের মাঝে বসিয়ে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। লিপি ম-ল বুকে ও পায়ে, মেয়ে পিনাকি ও চালক নজরুল পায়ে গুলিবিদ্ধ হন।
দেশে হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, ছিনতাই প্রভৃতি অপরাধ আশঙ্কাজনক অবস্থায় অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে। কিন্তু এখন এর মাত্রাটা অনেক বেশী। যা দেশবাসীর মনে অতংক তৈরি করেছে। এর জন্য দায়ী হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং আইনের শিথিল ও নির্বাচিত প্রয়োগ। র্যাব-পুলিশ প্রকৃত অপরাধীদের ধরে আইনে সোপর্দ করার পরিবর্তে লিমনের মতো নিরীহ নাগরিককে গুলি করে পঙ্গু করেছে, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। কাদেরের মতো শিক্ষার্থীকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে নির্যাতন করেছে। প্রকৃত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার মতো সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নেই। সন্ত্রাস দমনের শর্টকাট পদ্ধতি হচ্ছে, বিচারবহির্ভূত হত্যা অথবা গুম করা। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললে আমাদেও দেশের কোথাও না কোথাও খুন-খারাবি, ছিনতাই-অপহরণের খবর দেখতে হয়। পথে-ঘাটে, এমনকি শোয়ার ঘরে ঢুকেও দুর্বৃত্তরা খুন করে নির্বিঘেœ পালিয়ে যায়। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, মানুষ তাহলে নিরাপদ কোথায়? প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে, অপহৃত শিশুটিকে উদ্ধারের জোর তৎপরতা চলছে। আমরাও মনে করি এ সময়ে অপহৃত শিশুটিকে দ্রুত উদ্ধারই সংশ্লিষ্টদের সর্বোচ্চ প্রাধান্য পাওয়া উচিত। দুর্বৃত্তদের দ্রুত পাকড়াও করার আশ্বাসও দেয়া হয়েছে। অবশ্য এরকম আশ্বাস আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রতিটি ঘটনার পরই দেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে তা কতোটা পূরণ হচ্ছে? ক’টা ঘটনায় অপরাধীরা ধরা পড়ছে ?
ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি প্রথম শ্রেনীর দৈনিকের রিপোর্টে বলা হয়েছে সারাদেশে রাজনৈতিক ক্যাডারদের হাতে প্রায় ৩ লাখ অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি এমনকি ছিনতাইয়ের মতো অপরাধেও এসব অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। গোয়েন্দারা এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে দেশব্যাপী কম্বিং অপারেশন শুরুর তাগিদ দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, সন্ত্রাসী ও অপরাধমূলক কর্মকান্ডে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে।বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক অন স্মল আর্মস, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ সেন্টার (বিডিপিসি), ভয়েস বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ কোয়ালিশন ফর চাইল্ড রাইটস (বিসিসিআর) ও ওমেন অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, সারাদেশে অবৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ৪ লাখ এবং এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছয় লাখ। দেশের অবৈধ অস্ত্রের সঠিক পরিসংখ্যান এবং এর ব্যবহারকারী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত উল্লিখিত সংস্থাগুলোর পর্যবেক্ষণ বলা হয়েছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্যাডাররাই প্রায় ৩ লাখ অবৈধ অস্ত্র সিংহভাগ ব্যবহার করছে। এছাড়াও ১২৪টি অপরাধী চক্রের হাতে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। এসব অস্ত্রধারীর ৪০ শতাংশেরই বয়স আঠারোর নিচে। গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানিয়েছে, আসন্ন পৌরসভা, ডিসিসি ও ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক গডফাদাররা স্মল আর্মস সংগ্রহের চেষ্টা করছে। বিশেষ করে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সন্ত্রাসী প্রার্থীদের মধ্যে বিদেশি অত্যাধুনিক ক্ষুদ্রাস্ত্রের পাশাপাশি দেশীয় হালকা অস্ত্র জোগাড়ে গোপন প্রতিযোগিতা চলছে। পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের হাতে যে বিপুল সংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে ছাত্রলীগের ক্যাডারদের সািহংসতা এবং কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা যুবদলের দু’গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধেই তার আংশিক প্রমাণ মিলেছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদেও মতে অবৈধ অস্ত্র রাজনৈতিক ক্যাডার, না ক্রিমিনালদের হাতে রয়েছে সেটি মুখ্য বিষয় নয়। কারণ অস্ত্র যার হাতেই থাকুক তা দিয়ে খুন, ছিনতাই, দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। তাই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে হবে। সন্ত্রাসীদেও হাতে চলে যাওয়া অস্ত্র গুলো উদ্ধার করতে হবে।অস্ত্র উদ্ধার অভিযান সফল করতে হলে অত্যন্ত গোপনে সারাদেশে একযোগে কম্বিং অপারেশন চালাতে হবে। সীমান্তের চোরাপথে অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সকে আরো তৎপর হতে হবে। একই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার করা জরুরি।
এ দিকে ২০০২ সালে যৌথবাহিনীর ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’-এর পর অস্ত্র উদ্ধারে সারাদেশে একযোগে কোনো সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয়নি। পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় ‘ব্লক রেইড’ দিয়ে অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু এক এলাকায় অভিযান চালানোর আগেই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা অন্য এলাকায় সরে গেছে। ফলে দেশব্যাপী অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি বাড়লেও উদ্ধার হয়েছে খুবই সামান্য। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্তÍ এই নয় মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৬৫ জন নিহত এবং ১১ হাজার ৩০২ জন আহত হয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপি’র অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ৭ জন নিহত এবং ৯৩৮ জন আহত হয়েছেন।রাজনৈতিক সহিংসতার এসব ঘটনার প্রায় এক-তৃতীয়াংশে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছাড়াও গত ৯ মাসে রাজনৈতিক ক্যাডাররা কিলিং, দখল, টেন্ডারবাজি, ছিনতাই ও আধিপত্য বিস্তারের প্রায় দেড় হাজার ঘটনায় অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করেছে। এ দিকে র্যাবের দাবি ২০০৪ সালের মার্চে র্যাব প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত ১ হাজার ৮২০টি বিদেশি রিভলবার ও ১৪৮টি দেশি রিভলবার, ১ হাজার ১২৯টি বিদেশি পিস্তল ও ৪৬টি দেশি পিস্তল, ১৫টি এসএমজি, ৫৯টি একে-৪৭ মেশিনগান, ৬৪৪টি রাইফেল, ১৩৬টি ওয়ান শুটার গান ও ৩ হাজার ১০টি এলজিসহ সর্বমোট ৭ হাজার ৬৭০টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বরাবরই বলে থাকেন ফলপ্রসূ উদ্ধার অভিযান চালাতে হলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সমন্বিতভাবে সারাদেশে একযোগে তল্লাশি চালাতে হবে। একই সঙ্গে এ ব্যাপারে যাতে রাজনৈতিক নেতারা হস্তক্ষেপ করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। অবৈধ অস্ত্রধারী ক্যাডারদের ব্যাপারে তদবিরকারী রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধেও সরকারের কঠোর অবস্থান জরুরি। আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র ও আন্ডারওয়ার্ল্ডের আর্মস স্মাগলাররা সীমান্তের চোরাপথ দিয়ে ক্ষুদ্র ও ভারী অস্ত্র বাংলাদেশে নিয়ে আসছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে আড়াই শতাধিক অস্ত্র ব্যবসায়ী গ্রুপ দেশের অভ্যন্তরে অস্ত্র বেচা-কেনায় সক্রিয় রয়েছে। আর এসব অস্ত্র ক্রয়ের প্রতিযোগিতায় সন্ত্রাসীদের চেয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্যাডাররা এগিয়ে রয়েছে। রাজনৈতিক গডফাদারদের ছত্রছায়ায় থাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব অস্ত্রধারী ক্যাডারকে ধরতে পারছে না। হালকা আগ্নেয়াস্ত্রের একটি বড় অংশ লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশ করে। ঢাকা, পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, যশোর, খুলনায় সবচেয়ে বেশি আগ্নেয়াস্ত্র বেচাকেনা হচ্ছে বলে গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছেন। এদিকে সম্প্রতি কালে ঢাকা , রাজশাহী, নারায়নগঞ্জসহ বিভিন্ন এখাকায় বন্দুকযুদ্ধের সময় ক্যাডার অস্ত্র উঁচিয়ে গোলাগুলির মিডিয়ায় প্রকাশিত ছবি দেখে পুলিশ এদের মধ্যে একজনকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে। এসব সন্ত্রাসীদের নানা তারনে গ্রেফতার না হওয়া উদ্দেগজনক বিষয়। পুলিশ অস্ত্রধারী ক্যাডারদের তালিকা জোগাড় করলেও পরে তাদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। রাজনৈতিক ক্যাডাররা তাদের অস্ত্র শুধু রাজনৈতিক সহিংসতায়ই ব্যবহার করে না; ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি ও বিভিন্ন কিলিং মিশনে তা ব্যবহৃত হয়। এমনকি অস্ত্রধারী রাজনৈতিক ক্যাডারদের অনেকেই তাদের অস্ত্র পেশাদার সন্ত্রাসীদের ভাড়া দিচ্ছে। ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তপথে চোরাকারবারিরা আগ্নেয়াস্ত্রের চালান আসছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। গোয়েন্দাদেও মতে, দেশে আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশের ৪০টি পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, তেঁতুলিয়া, টেকনাফ, হবিগঞ্জের জৈন্তা, ছাতক, শেরপুর, আখাউড়া, কুমিল্লার বিবিরবাজার, চৌদ্দগ্রাম, ফেনীর বিলোনিয়া, আমতলী, পেচিবাড়িয়া, পঠিয়া, দিনাজপুর, পার্বত্য চট্টগ্রাম, শ্রীমঙ্গল, ঝিনাইগাতি, কমলগঞ্জ, মাদবপুর, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার, যশোর, ফেনীর ছাগলনাইয়া, নেত্রকোনা, সুন্দরবন ও মংলা অস্ত্র চোরাচালানের প্রধান রুট বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছে। অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার মিডিয়াম্যানরা রাজনৈতিক শেল্টারে রয়েছে। তাদের মাধ্যমেই পলিটিক্যাল ক্যাডাররা অস্ত্র কিনছে। এ কারণে এ কেনা-বেচা অত্যন্ত সংগোপনেই হচ্ছে। রাজনৈতিক ক্যাডারদের পছন্দের তালিকায় পিস্তল ও রিভলবারের মতো ক্ষুদ্রাস্ত্র প্রাধান্য পেলেও কেউ কেউ চাইনিজ রাইফেলও কিনছে।সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, আমেরিকার তৈরির পিস্তল এক থেকে দেড় লাখ টাকা, ম্যাগাজিনসহ নাইন এমএম পিস্তল দেড় থেকে দুই লাখ টাকা, থ্রি টু বোরের রিভলবার (মেঘনাম) দুই লাখ টাকা, উগনী রিভলবার এক লাখ টাকা, মাউজার পিস্তল দেড় লাখ টাকা, ইউএস তাউরাস পিস্তল সোয়া ২ লাখ টাকা, ইতালির পেট্রো বেরোটা পিস্তল ২ লাখ টাকা, জার্মানির রুবি পিস্তল আড়াই লাখ টাকা, ইউএস রিভলবার দেড় লাখ টাকা, চাইনিজ রাইফেল দেড় থেকে দুই লাখ টাকা, ভারতীয় পাইপগান ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা, গুলি প্রতি রাউন্ড দেড়শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে দেশীয় অস্ত্র অনেকটা কম দামে পাওয়া যায়।
অপর এক সংবাদে জানা যায, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্তত দুই ডজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক আগ্নেয়াস্ত্রের মজুদ রয়েছে। ক্যাম্পাস ক্যাডাররা তাদের অস্ত্র মজুদের সবচেয়ে নিরাপদ স্থান হিসেবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো বেছে নিয়েছে। কারণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে তল্লাশি চালাতে হলে আগে প্রক্টরের অনুমতি নিতে হয়। আর অধিকাংশ সময় সেখান থেকে অভিযানের তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে মাঝে মধ্যে অভিযান চালানো হলেও আশানুরূপ অস্ত্র উদ্ধার হয় না। গ্রেপ্তারকৃত ক্যাম্পাস ক্যাডারদের তথ্যানুয়ায়ী মূল দল ও অঙ্গ সংগঠনের অনেক নেতা তাদের অস্ত্র ক্যাম্পাস ক্যাডারদের কাছে জমা রেখে ঝুঁকিমুক্ত থাকেন। প্রয়োজনে সেখান থেকে অস্ত্র নিয়ে কাজ শেষে আবার তা সেখানেই গচ্ছিত রাখেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে অস্ত্র মানুষকে উগ্র কওে, অপরাধ করতে প্রেরনা যোগায়। তাই অস্ত্রেও অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে পাশাপাশি ব্যাপক অভিয্ােনর মাধ্যমে ক্যাডারদেন হাতে চলে যাওয়া অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। আর তাতেই দেশে সহিংসতা, খুনখারাবি কমবে।
পাঠক নিশ্চাই মনে আছে ,বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বাবার কোলে থাকা শিশু নওশীনকে গুলি করে হত্যা করেছিল দুর্বৃত্তরা। সেই ঘটনায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন ‘আল্লার মাল আল্লায় নিয়ে গেছে’ বলে মন্তব্য করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। বর্তমান সরকারের আমলে মায়ের বুকে গুলি করে শিশুকে অপহরণ করেছে দুর্বৃত্তরা তাতে তিনজন আহত হয়েছে । এ ঘটনায় আবার সরকারের কেই না বলে বসেন “আল্লাই রক্ষা করেছেন ; কেউ মারা তো আর যায়নি।” দেশের আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটাতে না পেরে এরই মধ্যে বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারে একজন মন্ত্রী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিদায় নিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নতুন মুখই যোগ হয়েছে কেবল, অপরাধের চেহারা আর বদলায়নি। নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আইনশৃঙ্খলার উন্নতিতে এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোন কাজ দেখাতে পারেননি। সাংবাদিক দম্পতি হত্যার তদন্ত প্রশ্নে তিনি ইতোমধ্যে বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন। অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে তার নিয়োগের যথার্থতা প্রমাণের সুযোগ এখনও চলে যায়নি। ১১ নভেম্বর রোববারের রাজধানীর উপকণ্ঠ কেরানীগঞ্জে ছয় বছরের শিশু পরাগ অপহরণের ঘটনা সুরাহা করে তিনি যোগ্যতার কিছুটা হলেও প্রমাণ করতে পারেন। কেরানীগঞ্জে অপহৃত শিশুকে উদ্ধার এবং অপরাধীদের কঠোর সাজা নিশ্চিত করা গেলে সরকার আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে অন্তত একটি সফলতা দাবি করা সম্ভব হবে। আর দ্রুততম সময়ে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করে অবনতিশীল পরিস্থিতি থেকে এবং অপরাধপ্রবণতার ছোবলমুক্ত হওয়া সম্ভব। মানুষ যেন আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার ওপর আস্থা রেখে রাতে ঘুমোতে যেতে পারে, সকালে কাজে বের হতে পারে সেইটুকু নিশ্চিত করা অবশ্যই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আর যে কোনোভাবেই তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই।
(লেখক-মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, কলামিষ্ট, নিউজ-বাংলাদেশ ডটকমের সম্পাদক।)