রাজিব হায়দার হত্যাকাণ্ডের রহস্য পুরোপুরি উন্মোচন করা যায়নিঃ সংবাদ সম্মেলনে ডিবি পুলিশের যুগ্ম কমিশনার

রাজিব হায়দার হত্যাকাণ্ডের রহস্য পুরোপুরি উন্মোচন করা যায়নিঃ সংবাদ সম্মেলনে ডিবি পুলিশের যুগ্ম কমিশনার

নিজস্ব প্রতিনিধি,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ রাজধানীর পল্লবীর পলাশনগরে নিজ বাসার সামনে ব্লগার রাজিব হায়দার হত্যাকাণ্ডে জামায়াতের ইসলামীর অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির জড়িত। এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃত ৫ জন তাদের ‘বড় ভাইদের’ নিদের্শে রাজিবকে হত্যা করে। হত্যাকারীরা মনে করেছে এটা তাদের ইমানী দায়িত্ব। তবে হত্যারহস্য পুরোপুরি উন্মোচন  করা যায়নি বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম। ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে ২ মার্চ (শনিবার) সকাল সাড়ে ১১টায় এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, হত্যার ঘটনায় জড়িত আরও ২/৩ জনকে গ্রেফতার করা যায়নি। তাদের গ্রেফতার করা গেলে পুরো রহস্য উদঘাটন করা যাবে। এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃত ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপ (২২), মাকসুদুল হাসান অনিক (২৩), এহসান রেজা রুম্মান (২৩), নাঈম সিকদার ইরাদ (১৯) ও নাফিস ইমতিয়াজ(২২) ছাত্রশিবের রাজনীতির মতাদর্শে বিশ্বাসী। তাদের কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দুটি চাপাতি, চারটি ছোরা, একটি বাইসাইকেল,  এক জোড়া রিবুক কেডস, ৭টি বিভিন্ন মডেলের মোবাইল সেট ও একটি স্কুলব্যাগ উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতাররা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্র।

 

উল্লেখ্য, ১৫ ফেব্রুয়ারি পল্লবীর পলাশনগরে নিজ বাসার সামনে ব্লগার রাজিব হায়দার অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন। এ ঘটনায় পল্লবী থানায় নিয়মিত মামলা  হয়। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পরপরই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী ব্লগার রাজিব হায়দারের বাসায় গিয়ে তার পরিবারকে সমবেদনা জানান।  এ ঘটনায় থানা পুলিশের পাশাপাশি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য (পশ্চিম) বিভাগ ছায়া তদন্ত শুরু করে। তদন্তের ধারাবাহিকতায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালিত হয়।  মনিরুল ইসলাম বলেন, গ্রেফতারকৃতরা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামাজকক্ষে নামাজ পড়তে গিয়ে একে অপরের সঙ্গে পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হয়। সেই সূত্রে তারা ইসলামিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করত এবং ইন্টারনেট থেকে বিভিন্ন তথ্য শেয়ার করত। তারা জানায়, তাদের গ্রুপের এক বন্ধু একসময় ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। সেই বন্ধুটি তাদেরকে ইন্টারনেটের বিভিন্ন ব্লগের ঠিকানা দেয় এবং সেইসব ব্লগ হতে ডাউনলোড করা তথ্য তাদের মধ্যে সরবরাহ করে।  এ বন্ধু গ্রুপের সদস্যরা এইভাবে ‘থাবা বাবা’সহ বিভিন্ন ব্লগারের লেখার সাথে পরিচিত হয়। একপর্যায়ে তার সম্পর্কে রটানো বিভিন্ন গুজবে বিশ্বাস করে ‘থাবা বাবা’ নামধারী ব্লগারকে সনাক্ত করে তাকে উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য পরিকল্পনা করে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে পল্লবী’র পলাশ নগর এলাকার নিজ বাসার সামনের রাস্তায় এ উগ্রপন্থী ও ধর্মান্ধদের হাতে ‘থাবা বাবা’ নামধারী ব্লগার রাজিব হায়দার নিহত হন। গ্রেফতারদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, তারা সবাই আলোচনা সাপেক্ষে ব্লগার রাজিবকে হত্যার পরিকল্পনা করে। তারা রাজিবের ব্লগে এবং ফেসবুকে ঢুকে  রাজিব সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে। এভাবে রাজিবের বন্ধুদের পরিচয় ও ছবি দেখে ফেসবুকে রাজিবকে সনাক্ত করে। তারা নিয়মিতভাবে রাজিবের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট সার্চ করে  এবং শাহবাগ গণজাগরন আন্দোলন শুরু হবার পর তারা রাজিবের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে জানতে পারে রাজিব শাহবাগে আসবে। তখন তারা তাকে সনাক্ত করার জন্য একটি গ্রুপ যার নাম “ইনটেল গ্রুপ” এবং সনাক্ত পূর্বক সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য অপর গ্রুপ যার নাম “এক্সিকিউশন গ্রুপ” গঠন করে।  ইনটেল গ্রুপের সদস্য হচ্ছে এহসান রেজা রুম্মান, মাকসুদুল হাসান অনিক, নাঈম সিকদার ইরাদসহ আরও দু’জন এবং এক্সিকিউশন গ্রুপের সদস্য হচ্ছে ফয়সাল বিন নাঈম ও মাকসুদুল হাসান অনিকসহ আরও একজন। ইনটেল গ্রুপের সদস্যরা হত্যাকান্ডের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে তথ্য সংগ্রহ ও রেকি করবে। গ্রেফতারদের মধ্যে ফয়সাল বিন নাঈমের বাড়ি মাতুয়াইল, ঢাকা এবং অনিকের বাড়ি- কেরানীগঞ্জ। তারা দু’জনই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেট্টিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। নাঈম কোডা কলেজ, ঢাকা থেকে এইচ এস সি পাশ করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, অপর দিকে অনিক ম্যাপল লিফ থেকে ও লেভেল এবং এ লেভেল পাশ করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। রুম্মানের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলায় ও ইরাদ এর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এবং তারা দু’জনই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র। নাফিস ইমতিয়াজ সান সাইন গ্রামার স্কুল থেকে ও লেভেল এবং এ লেভেল পাশ করে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ’তে ভর্তি হয় এবং বর্তমানে সে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তার বাড়ি সন্দ্বীপে। ইনটেল গ্রুপের সদস্যরা ৯ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ যায় এবং ‘থাবা বাবা’ নামধারী ব্লগার রাজিবকে খোঁজা শুরু করে। এর ২/১দিনের মধ্যেই থাবা বাবা’র বন্ধুদেরকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে ব্লগার রাজিবকে চিনতে পারে। রাজিবকে চেনার পর ইনটেল গ্রুপের সদস্য এহসান রেজা রুম্মান শাহবাগ থেকে সাইকেলযোগে বাসে উঠা রাজিবকে অনুসরন করে মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্ত্বর পর্যন্ত যায়। প্রথম দিন রাজিবের বাসা চিহ্নিত করতে পারেনি। এরপর আবার তাকে একইভাবে অনুসরণ করে রাজিবের পল্লবী পলাশনগরের বাসা চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। রাজিবের বাসা চিহ্নিত করার পরে কয়েকদিন ধরে ইনটেল গ্রুপের সদস্যরা তাকে রেকি করা শুরু করে এবং বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে। তারা রাজিব কখন বাসায় আসে, কখন বের হয়, কার সঙ্গে ঘোরাফেরা করে এবং কি ধরনের কাজ করে সমস্ত বিষয় সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে।  ইনটেল গ্রুপের সদস্য মাকসুদুল হাসান অনিক হত্যাকাণ্ড সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অস্ত্র কেনা ও অন্যান্য খরচ বাবদ টাকা দিয়ে সাহায্যে করে থাকে। অনিক নিজেই বাড্ডা নতুন বাজারের একটি দোকান থেকে ৩০০০/- টাকা দিয়ে চাপাতি ও ছোরা কিনে। তথ্য সংগ্রহ ও যাবতীয় প্রস্তুতি শেষে ঘটনার দিন সবাই মিলে সাইকেলে ও বাসে চড়ে বিকাল ৪টার দিকে পল্লবীর পলাশ নগরের রাজিবদের বাসার গলিতে অবস্থান নেয় এবং স্কুল ব্যাগ, ক্রিকেটের ব্যাট ও বল ইত্যাদি সাথে থাকে। আসামিরা সবাই মিলে গলিতে ক্রিকেটও খেলে এবং রাজিবের বাসায় ফেরার অপেক্ষায় থাকে। সন্ধ্যার দিকে রাজিব যখন তার বান্ধবী তানজিলাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে পল্লবীর বাইশটেকি হয়ে তার বাসার দিকে যাচ্ছিল তখন ইনটেল গ্রুপের সদস্যরা তাকে অনুসরন করে এবং বাসার গেইটের কাছাকাছি পৌঁছার পর এক্সিকিউশন গ্রুপের সদস্যদের ফয়সাল বিন নাঈম দীপ তাকে চাপাতি দিয়ে রাজিবের ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করার উদ্দেশ্যে ঘাড়ে কোপ দেয়। কোপে আহত হয়ে রাজিব অনুচ্চ শব্দে চিৎকার করে দেয়ালে পড়ে যায়। তারপর ফয়সাল রাজিবকে চাপাতি দিয়ে এলোপাথারি কোপাতে থাকে এবং অনিকও তার হাতে থাকা ছোরা দিয়ে এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। আসামিরা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে দৌড়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে এবং হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি চাপাতি রাস্তার মোড়ের পানের দোকানের সামনে ফেলে যায়। রাজিবকে হত্যা করার সময় নাঈমের এলোপাথারি কোপের একটি কোপ অনিকের পায়ের জুতায় লেগে পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের কিছু অংশ কেটে যায় এবং অনিক রুম্মানের সাথে কাকরাইল এসে জুতাজোড়া খুলে জাতীয় চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদপ্তরের পুকুর পাড়ে ফেলে যায়। অনিক গ্রেফতার হবার পর তার সহায়তায় ওই জুতাজোড়া উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার আসামিরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যাবার সময় হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত আরও একটি চাপাতি ও চারটি ছোরা শেরেবাংলা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের রাস্তার পাশের ড্রেনের মধ্যে ফেলে যায়। তাদের সহায়তায় সেগুলো উদ্ধার করে মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়।  এ হত্যাকাণ্ডে আসামিরা একটি সাইকেল ও দু’টি স্কুল ব্যাগ ব্যবহার করেছে, যা তাদের দেখানো মতে উদ্ধার করে জব্দ করা হয়।

নিজস্ব প্রতিনিধি