৩৬ ঘন্টার হরতালের প্রথম দিনঃ বিচ্ছিন্ন সহিংসতা,সারাদেশে গ্রেফতার ৩৮২, আহত ৫৭৮
বিশেষ প্রতিনিধি,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ ১৮ দলীয় জোটের ডাকা ৩৬ ঘণ্টা হরতালের প্রথম ১২ ঘণ্টা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশবাসী পালন করেছে বলে দাবি করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘প্রথম দিনের হরতালে ঢাকা মহানগরীসহ সারাদেশে ৩৮২ জনের অধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। একই সময় আহত হয়েছেন ৫৭৮ জন নেতাকর্মী। এছাড়া ৫ জনকে ভ্রাম্যমাণ আদালত ১ বছর করে সাজা দিয়েছে।’ ২৭ মার্চ (বুধবার) বিকেলে নয়া পল্টন কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন। মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা আজ আওয়ামী হিংস্রতা ও বর্বর দুঃশাসনে বিপর্যস্ত। দেশের মানুষ আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিহিংসা এবং ভয়াবহ নির্যাতন-নিপীড়নের কারণে প্রতিটা মুহূর্ত আতঙ্কের মধ্যে অতিবাহিত করছে।’ ‘বিরোধী দল দমনে সরকারের দ্রুত বিচার আইনে মিথ্যা মামলা দায়েরসহ ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সাজা প্রদান এবং নেতাকর্মীদের আটক, গুম, খুন, অপহরণ এখন প্রাত্যহিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশে আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে আরো বলতে চাই, ‘আপনাদের দুঃশাসনের মাত্রা যতই বৃদ্ধি পাবে ততই আপনাদের ধবংস অনিবার্য হয়ে উঠবে’- বলেন মির্জা ফখরুল। তিনি আরও বলেন, ‘আমি পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের কর্তৃক এযাবৎকালের নৃশংস হামলায় নিহতদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং আহত নেতাকর্মীদের আশু সুস্থতা কামনা করছি। এছাড়া সারাদেশে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত দ্রুত বিচার আইনে মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা প্রত্যাহার এবং গ্রেফতারকৃতদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তির জোর দাবি জানাচ্ছি।’ মির্জা ফখরুল বলেন, ‘গত ২৫ মার্চ সংবাদ ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে দ্রুত বিচার আইনে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত বিরোধীদলীয় সব নেতাকর্মীর অবিলম্বে মুক্তি, সারাদেশে সরকারের নির্দেশে পরিচালিত গণহত্যার প্রতিবাদে ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে এবং ব্যর্থ, অযোগ্য স্বেচ্ছাচারী সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বুধবার সকাল থেকে সারাদেশে টানা ৩৬ ঘণ্টার হরতাল আহ্বান করেছিলাম। দাবি পূরণে সরকার ব্যর্থ কিংবা গড়িমসি করলে আগামীতে একই দাবিগুলো সামনে নিয়ে আমরা আরও কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবো এবং এর সব দায়-দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘বুধবার সকাল থেকে শুরু হওয়া দেশব্যাপী টানা ৩৬ ঘণ্টার হরতালের ১ম দিন অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করায় ১৮ দলীয় জোট নেতা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে দেশবাসীকে আন্তরিক অভিনন্দন, কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’ বিএনপি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, ‘দেশে হত্যা, গুম, অপহরণ এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা দায়ের, রিমান্ডের নামে নির্যাতন এবং জুলুম নির্যাতনের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে- যে বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে ইতোপূর্বে একাধিকবার আমরা আপনাদের অবহিত করেছি। ক্রমবর্ধমান হত্যার ঘটনায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিটি মানবাধিকার সংস্থা তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে দেশের বিদ্যোৎসমাজ, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা সোচ্চার হলেও এই ফ্যাসিস্ট সরকার কখনোই তা কর্ণপাত করেনি। এখন দেশে পুলিশ ও র্যাব যেভাবে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে তা সরাসরি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে চালানো হচ্ছে বলে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাদের গুলিতে গৃহবধূরাও ঘরের মধ্যে নিহত হচ্ছেন।’
ককটেল বিস্ফোরণ, যানবাহন ভাংচুর, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া এবং অগ্নিসংযোগের মধ্যদিয়ে বুধবার শেষ হলো বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের ডাকা ৩৬ ঘন্টা হরতালের প্রথম দিন। আটক নেতাকর্মীদেম মুক্তি, গণহত্যা বন্ধ এবং তত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে টানা ৩৬ ঘন্টা হরতালের ডাক দেয় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দল। গত সোমবার ১৮ দলীয় জোটের সভা শেষে বিএনপির মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই হরতাল কর্মসুচির ঘোষনা করেন। হরতালের রাজধানী থেকে দুরপাল্লার কোন বাস ছেড়ে যায়নি। তবে ট্রেন, লঞ্চ এবং বিমান চলাচল ছিল স্বাভাবিক। কমলাপুর স্টেশন থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানের উদ্দেশে নির্ধারিত সময়ে ট্রেনগুলো ছেড়ে গেছে। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা অধিকাংশ ট্রেন কমলাপুর স্টেশনে নির্ধারিত সময়ে পৌঁছেছে। তবে যাত্রীদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম। একই চিত্র ছিল লঞ্চ এবং বিমান চলাচলে। হরতালে নগরীতে বাস চলাচল করেছে খুবই কম। তবে যেগুলো চলাচল করেছে তাতে যাত্রীর সংখ্যা ছিলনা বললেই চলে। হরতালের কারনে বুধবার রাপথে প্রাইভেটগাড়ি চলচল করেনি। এক প্রকার ফাঁকা রাজপথে রিকসার বিচরন ছিল লক্ষনীয়। নগরীর অধিকাংশ মার্কেট এবং রাস্তার দুই পাশের দোকানপাঠ ছিল বন্ধ। তবে কিছু কিছু এলাকার ফুটপাতের দোকানপাঠ খোলা দেখা দেলেও তাতে ক্রেতা ছিল না। হরতালে রাজধানীতে নাশকতা প্রতিরোধে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে অতিরিক্ত পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়। ব্যবস্থা করা হয়েছে নিয়মিত টহলেরও। হরতালে ভোগান্তি: হরতালের কারণে মঙ্গলবার নগর বাসিকে চরম ভোগান্তির পোহাতে হয়েছে। রাজধানীর আজিমপুর, আসাদ গেট, শ্যামলী, টেকনিক্যাল, গাবতলী, ফার্মগেট, বৃহত্তর মিরপুর, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুড়ে দেখা গেছে দুর্ভোগের চিত্র। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাসের অপেক্ষায় আফিসগামীদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। একই চিত্র ছিল বিকিলের দিকে। যারা অতি কষ্ট করে অফিফে পৌঁছতে পারছেন তাদের বাড়ি ফিরত পোহাতে হয়েছে চরম দুর্ভোগ। নগরীঘুরে বেশ কয়েকজন ভোগান্তিতে পড়া জনসাধারণের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হরতালের আগের দিন পরিবহন মালিকরা রাস্তায় গাড়ি চালানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাদের ঘোষণার প্রেক্ষিতে অনেরক মানুষ অফিস করা বা ব্যক্তিগত কাজের জন্য রস্তায় বের হন। তবে রাজপথে অন্য হরতালের চেয়ে গাড়ির সংখ্যা অনেক কম থাকায় তাদের ভোগান্তিতে পরতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভোগান্তি পোহানো মানুষগন পরিবহন মালিকদের সমালোচনা করেছেন। হরতালের শুরুতেই রাজধানীর গ্রিনরোডের গ্রিন হাসপাতালের সামনে সকালে পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে হরতালকারীরা। তবে এতে কেউ হতাহত হয়নি। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে এক জনকে আটক করে। তবে আটককৃত ব্যক্তি নিজেকে মাছ ব্যবসায়ী দাবি করেন। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় থানা ছাত্রদলের উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের হয়। এ সময় মিছিল থেকে পিকেটাররা ৩টি পিকআপ ভ্যান ভাঙচুর ও একটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তবে আশপাশের লোকজন সঙ্গে সঙ্গে আগুন নিভিয়ে ফেলেন। সবুজবাগ থানা ছাত্রদলের উদ্যোগে একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি কদমতলীর ইত্যাদি খেলার মাঠের সামনে থেকে বের হয়। এ সময় মিছিলকারীরা ৩টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। পরে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচ থেকে একটি মিছিল বের করে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। এ সময় পুলিশ তাদের ধাওয়া দিলে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। গুলশানের ইকবাল টাওয়ারের কাছে ছাত্রদলের ব্যানারে একটি ঝটিকা মিছিল বের করা হয়। মিছিলের একপর্যায়ে পরপর ৫টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ঘটনার পর তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয় এবং পুরো এলাকায় তল্লাশি শুরু করে। এসময় সরকারি তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আল আমিনসহ ছাত্রদলের দুই কর্মী রুপম ও মোহাম্মদ আলীকে আটক করে পুলিশ। হরতালের সমর্থনে রাজধানীর খিলগাঁও, মিরপুর, যাত্রাবাড়ি, তেজগাঁওসহ বিভিন্ন স্থানে ছাত্রদল, সেচ্ছাসেবক দল ও শিবির ঝটিকা মিছিল বের করে। রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্থানে ককটেল বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে।