এবার টিপাইমুখ প্রকল্প চায় ভারত
কাজী মাহফুজুর রহমান শুভ,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ ট্রানজিট ট্রান্সশিপমেন্টের মোড়কে ভারতের ত্রিপুরায় খাদ্য নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ শুরু হওয়ার পরে এবার টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে এগুচ্ছে ভারত। চলতি মাসে নৌপথে ত্রিপুরার উদ্দেশ্যে খাদ্য শস্যের প্রথম চালান পাঠায় ভারত। এখন টিপাইমুখ বাঁধ করতে অব্যহতভাবে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে আসছে। এ বিষয়ে দেশের রাজনৈতিক দল গুলো বলছে, সরকারের নতজানু নীতির কারণেই ভারত একতরফাভাবে টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এবং এরই মধ্যে টিপাইমুখ বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে চুক্তি সইও করেছে। ভারতের সঙ্গে কূটনীতিতে এখন অনেক দিক থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। তারপরও তাদের প্রতি সহানুভূতি বা নমনীয়তা দেখিয়ে কোন লাভ নেই বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। আশুগঞ্জের পাশাপাশি এখনই ভারত নৌ ট্রানজিটের মাধ্যমে শেরপুরের সুতারকান্দি ব্যবহারের সুযোগ চাইছে। ভারতের প্রস্তাবের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সরকারকে জানিয়েছে, ভারতের সঙ্গে বিদ্যমান নৌ-প্রটোকল অনুসারে আশুগঞ্জের পাশাপাশি শেরপুর থেকে সুতারকান্দি পর্যন্ত ভারতীয় পণ্য পরিবহনে কোনো বাধা নেই। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরই ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে আঞ্চলিক সম্পর্কের ওপর জোর দেয়। শুরু হয় ট্রানজিট দেয়ার বিষয়ে আলোচনা কিন্তু ট্রানজিট নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো রায় আসার আগেই ভারতের ত্রিপুরার জন্য খাদ্য আমদানির সুযোগ দিল বাংলাদেশ। এ বিষয়টিকে মানবিক বিবেচনায় করা হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ’৭১ সালের পারিবারিক-রাজনৈতিক সম্পর্কের জের ধরে দুদেশের মধ্যে অমীমাংসিত বহু ইস্যু নতুন করে সামনে আসে। ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট ইস্যুতে স্পষ্ট ব্যাখ্যায় না যাওয়ার আগেই দেশটিকে বিশেষ সুযোগ দেয় বাংলাদেশ। কিন্তু এটি এমন এক সময় দিল যার মাত্র একমাস আগেই ভারতীয় সংসদে সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ দুদেশের মধ্যে অমীমাংসিত থাকা স্থলসীমান্ত চুক্তিটি অনুমোদনের জন্য তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু ত্রিপুরার মতো ভারতের অন্য আর একটি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্য আসামের দুই এমপি সেই চুক্তিটি অনুমোদনের জন্য তোলার আগেই মন্ত্রীর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করেন। এমনকি দেশটির প্রধান বিরোধী দল বিজেপি তাদের দেশের দুই মন্ত্রী পদত্যাগ না করা পর্যন্ত এতে অনুমোদন দেবে না বলে জানায়। পরে অবশ্য দুই মন্ত্রী পদত্যাগ করে কিন্তু এখনো বিলটির ব্যাপারে বিজেপি নতুন করে আর কিছু বলেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক বলেন, আমাদের কূটনীতিকে আরো সচল ও চতুর হতে হবে। বাংলাদেশের কূটনীতিকে আরো অনেক দূর যেতে হবে। আরো উন্নতি করতে হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষ ও অভিজ্ঞ কূটনীতিকদের কাজে লাগাতে হবে। আমাদের কর্মকর্তাদের পড়াশোনা এবং গবেষণা নেই। তার প্রভাব পড়ছে নেগোশিয়েশন করার বেলায়। কোনো অসুস্থ কূটনীতিককে বা অবসরপ্রাপ্ত বয়স্ক কূটনীতিককে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো দেশে দায়িত্ব দেয়া যাবে না।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, তিতাস এখন খুন হয়ে যাওয়া একটি নদী। রেলব্রিজ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আখাউড়া সড়কের তিতাস সড়ক ব্রিজের মধ্য দিয়ে সিমেন্টের বস্তা, বাঁশের খুঁটি, ইট-বালু ও মাটি ফেলে নদীর ওপর আড়াআড়ি বাঁধ দেয়া হয়েছে। মাঝে মধ্যে শক্ত করে পুঁতে দেয়া হয়েছে পাকা খুঁটি। তিতাসপারের বাসিন্দারা এ বিষয় নিয়ে ক্ষুব্ধ। তার কণ্ঠে নদী হারানোর হাহাকার। বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, পরিস্থিতি দেখে মনে হয় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জন্য তো নয়-ই, বরং ভারত তাদের নিজের দেশের মধ্যেও পণ্য পরিবহনের জন্য মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে ফেলে এভাবে একটি নদীতে বাঁধ দিত না। তিনি এসব বাঁধের বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের মারুফ রহমান বলেন, তারা তিতাসসহ নদী-খালে বাঁধ দেয়ার বিপক্ষে স্থানীয়ভাবে জনমত তৈরির চেষ্টা করছেন। এরই মধ্যে তারা স্থানীয় মানুষকে নিয়ে মানববন্ধনের আয়োজন করেছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর টিপাইমুখে বাঁধ দেয়ার ভারতীয় পদক্ষেপকে আন্তর্জাতিক পানি আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করে বলেন, ফারাক্কার মতোই এ বাঁধের কারণেও মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। এ নিয়ে বারবার আমরা সতর্ক করলেও সরকার ভারতের সঙ্গে কোনো কার্যকর আলোচনা করেনি। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক পানি আইন অনুযায়ী এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে উজানের দেশকে ভাটির দেশের সঙ্গে আলোচনা করতে হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশকে কয়েকবারই আশ্বস্ত করেছেন, বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কোনো পদক্ষেপ তারা নেবেন না। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল, ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে একটি কোম্পানি গঠনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এ ব্যাপারে মহাজোট সরকারকে কোনো প্রতিবাদ জানাতেও দেখিনি। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, টিপাইমুখের বিষয়ে সরকার নতজানু নীতির পরিচয় দিয়েছে। প্রতিটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রকে তার নিজের দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া দায়িত্ব। কিন্তু টিপাইমুখের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এখানে বাংলাদেশ দুর্বল কূটনীতির শিকার হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এদিকে টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতে ভারত সরকারও বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, টিপাইমুখ বাঁধ আমাদের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। আমাদের দেশের সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা না করে গদি রক্ষার জন্য বেশি ব্যস্ত থাকে। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও দুই দল দু’ধরনের রাজনীতি করছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির হাতে দেশের জাতীয় স্বার্থ নিরাপদ নয়। তাই জণগণের উচিত এদের দিকে না তাকিয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় উদ্যোগী হওয়া।