শ্লীল নয়, অশ্লীলও নয়!
সৈকত রুশদীঃ
জাতীয় সংসদে সম্প্রতি উচ্চারিত একটি ‘অনার্য’ শব্দ নিয়ে বিতর্কের ঝড় বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়েছে । রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা নোয়াখালীর এই আঞ্চলিক শব্দটি নিয়ে বাংলা ভাষায় সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্র আনন্দবাজার পত্রিকা একটি রাজনীতিমুক্ত অথচ তথ্যবহুল কেতাবী বিশ্লেষণ করেছে ১২ জুন । ধ্বনিগত দিক থেকে ‘চুদুরবুদুর’ শব্দটি শ্লীলতার সীমা লংঘনকারী একই ধরণের কিছু শব্দের কাছাকাছি বলে, সরকারী দলের এক সাংসদের কাছে মনে হয়েছে এই শব্দটিও অশ্লীল । বৃহত্তর বরিশালের এই সাংসদ বিরোধী দলীয় নারী সাংসদের উচ্চারিত নোয়াখালীর আঞ্চলিক শব্দটি জাতীয় সংসদের কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্পীকারের কাছে । নোয়াখালীর মেয়ে হিসেবে স্পীকার সম্ভবত: শব্দটির সাথে পরিচিত বলেই এক কথায় তা খারিজ না করে, পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখার কথা বলেছেন । আনন্দবাজারের প্রতিবেদনটি পড়ার পর মনে হয়েছে স্পীকার শব্দটি কার্যবিবরণী থেকে খারিজ নাও করতে পারেন । কেননা শব্দটির অর্থ হচ্ছে, টালবাহানা, গড়িমসি অথবা বাড়াবাড়ি করা ।
শব্দটি কার্যবিবরণী থেকে বাদ দিলেই বরং খানিকটা বাড়াবাড়ি করা হবে বলে আমার ধারণা । তার কারণ দু’টি । প্রথমত: জাতীয় সংসদে আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার এটি প্রথম নয় । অনেকেই ব্যবহার করেছেন এবং করে থাকেন । বিশেষ করে, সিলেট, চট্টগ্রাম ও বরিশালের অনেক সাংসদের উচ্চারণে শুধু আঞ্চলিক টানই থাকেনা, আঞ্চলিক শব্দও থাকে । এটি তাঁদের সংস্কৃতির প্রকাশ । দ্বিতীয়ত: ধ্বনিগত দিক থেকে অনেক শব্দ। শ্লীলতার মাত্র ছাড়ানো মনে হলেও অর্থের ও ব্যবহারের দিক থেকে তা’ অশ্লীল নয় । অপরদিকে বহু আপাত: শ্লীল শব্দ আছে যা ব্যবহারের কারণে অশ্লীল হয়ে দাঁড়ায় । যেমন, চতুর্থ জাতীয় সংসদে তখনকার সরকার দলীয় জাতীয় পার্টির প্রথম সারির সাংসদ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের দাবি, ‘দুই মহিলার মিলনে কিছু (সৃষ্টি) হয় না !’
বাংলা ভাষাতেই একটি বাগধারা আছে, ‘এক দেশের বুলি, আরেক দেশের গালি !’ তা’ স্পষ্টই টের পেয়েছিলাম ১৯৮৪ সালে লন্ডনে বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত এক অর্বাচীন বালকের প্রশ্নে । তার জিজ্ঞাস্য ছিল, ধ্বনিগত দিক থেকে এতো অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে বাংলাদেশের মানুষের (ব্রিটেনে তখন বাংলাদেশের হাই কমিশনার ফাখরুদ্দিন আহমেদ) বা সংবাদপত্রের (ইত্তেফাক) নাম কেন রাখা হয়েছে ? অথচ, সেদেশের অন্যতম প্রধান টেলিফোন কোম্পানীর নামটি বাংলা ভাষায় মোটেই উচ্চারণের যোগ্য নয় ।
আলোচ্য শব্দটি শ্রুতিমধুর না হলেও আমি ভাষা ও শব্দের ব্যবহারের স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করার পক্ষে নই । তবে, শালীনতার মাত্র ছাড়ানো শব্দের ব্যবহার ও ভঙ্গীর প্রকাশ জাতীয় সংসদে পরিহার করাই শ্রেয়: । বরং ব্যবহৃত শব্দের শ্লীলতার মাত্রার চেয়ে, সাংসদদের আচরণে ও উদ্দেশ্যে শ্লীলতার মাত্রার প্রতি লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন ।
সৈকত রুশদী, কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক ও গবেষক।।
১৩ জুন ২০১৩