আমার বাবার মুখচ্ছবি!
প্রভাষ আমিন: ডাক্তাররা বলে দিয়েছিলেন আগেই। তবুও নিশ্চিত মৃত্যুর এগিয়ে আসা দেখাটা খুব কষ্টের। সবকিছুই চলছিল কৃত্রিমভাবে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক, শিরায় পুশ করা স্যালাইন। স্যালাইনের ধীর কিন্তু নিয়মিত ফোটা যেন মৃত্যুর ক্ষণ গণনা। স্যালাইনের ফোঁটায় ফোঁটায় যেন জমা হচ্ছিল আমাদের কষ্ট আর অক্ষমতা। ডাক্তাররা খুব সহানুভূতির সঙ্গেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, লিভারের সমস্যাটা হঠাৎ করেই ক্যান্সারে টার্ন নেওয়ায় তাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। যতই সহানুভূতিশীল হোন, ডাক্তারদের অপেক্ষা পেশাদার। আর আমরা যারা তাঁর সন্তান, পরিজন; আমাদের অপেক্ষা মানে বেদনার সঙ্গে লড়াই, চিকিৎসা বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে অভিশাপ আর অলৌকিক কিছুর প্রত্যাশা। আমাদের এই অপেক্ষা, এই কষ্ট, এখন এক বছরের পুরোনো স্মৃতি। গত বছরের ২৬ মে রাত ২টায় আমি নিজ হাতে খুলে দিয়েছিলাম আমার বাবার মুখের অক্সিজেন মাস্ক, তার আগেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। একবছর হয়ে গেছে ভাবতেই অবাক লাগে। অথচ আমার, আমাদের বেদনা তো একটুও পুরোনো হয়নি। এখনও তো চোখ বুঝলেই আমার চোখে ভেসে ওঠে আমার বাবার মুখচ্ছবি।
ডাক্তারদের ধন্যবাদ তারা আমার বাবার শেষ সময়ের কষ্ট কমানোর চেষ্টা করেছিলেন। তারপরও মৃত্যুর আগে যতটা কষ্ট তিনি পেয়েছেন, ততটা কী তাঁর পাওনা ছিল? আমার বাবা বলে বলছি না, সৃষ্টিকর্তার কাছে আরও আনন্দময় মৃত্যু দাবি করতে পারতেন তিনি। শোনা যায় যারা প্রচুর মদ খান বা অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করেন তাদের লিভার সিরোসিস হয়। কিন্তু যিনি জীবনে কোনদিন সিগারেটের স্বাদ নিলেন না, পান-সুপারিতে যার কোন আসক্তি ছিল না, তার কেন লিভার সিরোসিস হবে? প্রাণঘাতী সি ভাইরাস কেন পথ ভুলে আমার বাবার লিভারেই বাসা বাঁধবে? সৃষ্টিকর্তা এ তোমার কেমন বিচার হলো। পুত্রের কলমে বাবাকে একটু মহিমান্বিত করার চেষ্টা থাকতে পারে। তবে শুরুতেই বলে রাখছি আমার বাবা বিখ্যাত বা প্রচলিত অর্থে মহান কেউ ছিলেন না। ছিলেন সামান্য এক স্কুল শিক্ষক। কিন্তু নির্দ্বিধায় বলা যায় আমার বাবা একজন আজন্ম সংগ্রামী মানুষ ছিলেন। সংগ্রামী বলতে যে ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে, তিনি কেমন কেউও ছিলেন না। তবুও জীবনের জন্য, সংসারের জন্য সংগ্রাম করলে তিনিও নিশ্চয়ই সংগ্রামীই হবেন। সেই বিচারে নিশ্চয়ই আমার বাবা সংগ্রামী মানুষ ছিলেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত কিন্তু সভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম। তিনি যখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়েন, তখনই তাঁর বাবা, মানে আমার দাদা সাধারণ এক জ্বরে মারা যান। তারপর ছোট দুই ভাই এবং মাকে নিয়ে গড়া সংসারের জোয়াল চেপে বসে আমার বাবার শিশু কাঁধে। মানুষের জমিতে বদলি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে সংসার চালিয়েছেন তিনি। অনভ্যস্ত হাতে সারাদিন ধান কেটে রক্তাক্ত হাত নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। মায়ের আদরে সব ব্যথা ভুলে আবার পড়তে বসেছেন কুপির আলোয়। শত কষ্টেও পড়াশোনা ছাড়েননি। মানুষের বাড়িতে লজিং থেকে পড়াশোনা করেছেন। লজিং থাকার সেই গ্লানি দেখে তিনি তখনই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তাঁর সন্তানদের কখনোই লজিং থাকতে দেবেন না এবং পরে সরকারি চাকরির সীমিত বেতন দিয়ে কষ্ট করেই চলেছে তাঁর ৪ মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে গড়া বেশ বড় সংসার। আমার মা যাদুমন্ত্রবলে চালিয়ে নিয়েছেন তা, তবু আমাদের কখনো লজিং থাকতে হয়নি।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনস্ত অন্ধ স্কুলে শিক্ষকতা করতেন আমার বাবা। শিক্ষকদের যা বেতন, এখন বুঝি অভাব-অনটন লেগেই থাকতো আমাদের সংসারে। কিন্তু নিজের জীবনে অভাবের যে ভয়াবহতা দেখেছেন, গ্লানি দেখেছেন; হয়তো সে কারণেই তিনি কখনো অভাবের আঁচ আমাদের গায়ে লাগতে দেননি, সব কষ্ট নিজে নিয়ে আমাদের আড়াল করে রেখেছেন। অর্থের অনটন থাকলেও অফুরান ভালোবাসা দিয়ে তা পূরণ করেছেন। তার ভালোবাসায় শুধু আমরা নই, সিক্ত হয়েছে তার অন্ধ অসহায় ছাত্ররাও। বদলির চাকরি হওয়ায় বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়েছে তাঁকে। আমরা কখনো কখনো তাঁর সঙ্গে থেকেছি। তবে বেশিরভাগ সময় আমরা গ্রামের বাড়িতেই থাকতাম। ছুটিতে যখন তিনি বাড়ি আসতেন, তখন সামান্য বিস্কুট, চানাচুর, আম, পেয়ারা ইত্যাদি নিয়ে আসতেন। সেই সামান্য জিনিসই আমরা যে কি অসামান্য আনন্দে ভাগ করে খেতাম। এখন লিখতে বসেও সে আনন্দের ছোঁয়া পাচ্ছি। আসলে আমরা বিস্কুট বা পেয়ারা নয়, কাড়াকাড়ি করে খেতাম বাবার আদর। আমরা সবাই গুটিসুটি মেরে তাকে ঘিরে থাকতাম, যতটা বেশি সময় তার সঙ্গে থাকা যায়। ছোটবেলায় বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানো বা জ্বর হলে তার কোলে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতি এখনও আনন্দ দেয়। তেমন একটি স্মৃতির বিনিময়ে আমি এখন আমার সবকিছু দিয়ে দিতে প্রস্তুত। খুব ছোটবেলায় একবার আমার খুব জটিল একটা অসুখ হয়েছিল। তাতে আমার বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি ছিল। আমার কষ্ট দেখে বাবা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, হায়াত না থাকলে যেন আমাকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কাছে আত্মসমর্পণ করেই বসে থাকেননি তিনি। পিজি হাসপাতালে এনে তিন মাস রেখে মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছিলেন আমাকে। একজন সামান্য স্কুল শিক্ষক গ্রাম থেকে তার ছেলেকে ঢাকায় এনে চিকিৎসা করে বাঁচাতে পারলেও একজন সাংবাদিক হয়ে, ঢাকায় থেকে আমি বাঁচাতে পারিনি আমার বাবাকে। লিভারের সমস্যা ধরা পড়ার পর তিনি আমার ওপর খুব নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন, হয়ে গিয়েছিলেন একদম শিশুর মত। আমাকে দেখলেই অনেক সুস্থ হযে যেতেন। তার সেই বাঁচার আকুতি আর আমার সীমাবদ্ধতা, অক্ষমতা অপরাধবোধ হয়ে এখনও আমাকে কষ্ট দেয়, পোড়ায়। চিকিসা বিজ্ঞান এখনও এত পিছিয়ে কেন?
আমার বাবা ক্রিকেটপ্রেমী ছিলেন। অবসর নেওয়ার পর সারাদিন বসে বসে টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখতেন। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের সমর্থক, বাসার বাকি সবাই ছিলাম ভারতের সমর্থক। আমাদের প্রতি তার স্নেহ এতটাই প্রবল ছিল যে, অন্যদের সঙ্গে খেলার সময় পাকিস্তানের জয় কামনা করলেও, ভারতে সঙ্গে খেলার দিন চাইতেন ভারতই জিতুক। নইলে যে তার সন্তানরা কষ্ট পাবে। তিনি ধর্মভীরু ছিলেন, কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। কখনোই তার মধ্যে কোন গোঁড়ামি দেখিনি। অবসর নেওয়ার পর পেনশনের টাকায় মাকে নিয়ে হজ্ব করতে গিয়েছিলেন। অনেকে আমাকে বলেছিল, অসুস্থ শরীরে তাকে যেন হজ্ব করতে যেতে না দেই। কিন্তু হজ্ব করতে যেতে না পারার বেদনাটুকু আমি তাকে দিতে চাইনি। হয়তো হজ্বে না গেলে আরও কয়েকদিন বেঁচে থাকতে পারতেন। কিন্তু হজ্ব থেকে ফেরার পরে তাঁর চোখে মুখে আনন্দের, তৃপ্তির যে আভা দেখেছি; আমি চেয়েছি এ আভাটুকু নিয়েই তিনি শেষ জীবনটুকু কাটান। হজ্ব থেকে আসার পর তিনি চেয়েছিলেন আমরা যেন নামাজ পড়ি। ধর্মে আমার অত মতি নেই, তবুও তাকে দেখানোর জন্য হলেও নামাজ পড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার আগেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর আর সুস্থ হননি। বারডেমে জবাব দেওয়ার পর বাবাকে আমরা বাসায় নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু চোখের সামনে তার কষ্ট সহ্য করা সম্ভব নয় বলে কিছুই করার নেই জেনেও তাকে ঢাকা কমিউিনিট হাসপাতলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। সেখানে নেওয়ার পর থেকেই তিনি অচেতন ছিলেন। এরপর আর চেতনা ফিরে পাননি। আমি ডাক্তারদের বলেছিলাম কোনোভাবে একবার তার জ্ঞান ফেরানো যায় কিনা। ডাক্তাররা চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু পারেননি। জামান ভাই (অধ্যাপক কাজী কামরুজ্জামান) জানতে চেয়েছিলেন, আমাদের কোন জমিজমা সংক্রান্ত আলাপ বাকি আছে কিনা। সরি জামান ভাই, তিনি আমাদের জন্য কোন সম্পত্তি রেখে যাননি। আমি জ্ঞান ফেরাতে চেয়েছিলাম একটি না বলা কথা বলতে ‘বাবা, আমরা সবাই আপনাকে খুব ভালোবাসি।’ আমি চেয়েছিলাম আর কটা দিন অন্তত বেঁচে থাকুন তিনি। আমি আমার দাদাকে দেখিনি, আমার সন্তান প্রসূন আমিনও আমার মতই হতভাগা। মাত্র তিন মাসের জন্য আমার বাবা দেখে যাননি আমার ছেলেকে, আর আমার সন্তানও বুঝতেই পারলো না, দাদার আদর কাকে বলে। বাবা আমাদের জন্য বাড়ি, গাড়ি, সম্পত্তি রেখে যাননি। কিন্তু তার আদর্শ রেখে গেছেন। না, আদর্শ মানে গালভরা কিছু নয়। সামান্য নিয়েও সততার শক্তিতে আর ভালোবাসায় কিভাবে সবকিছু কানায় কানায় ভরিয়ে রাখা যায়, এ শিক্ষা তো দিয়ে গেছেন। ছোট্ট একটা জীবন আনন্দময় করার জন্য সততার চেয়ে বড় আদর্শ আর কী হতে পারে।
বাবা মারা গেছেন, একবছর হয়। অথচ মনে হয়, এই সেদিনের ঘটনা। বাবার সঙ্গে আমাদের খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল এমন নয়। তিনি কখনো আমাদের শাসন করেননি। তবুও কেমন যেন একটু ভয়ই পেতাম তাঁকে, নিজেদের অপরাধের কারণেই হয়তো। কিন্তু গত একবছরে বুঝতে পেরেছি, বাবা আমাদের কতটা ছিলেন। আমাদের মাথার ওপরে পরম নির্ভরতার সেই ছায়াটি আর নেই। মাঝে মাঝে একা, একদম একা হয়ে যাই। সবকিছু ফাঁকা, অর্থহীন মনে হয়। বুকের ভেতরে দলা পাকানো কষ্ট দুমড়ে মুচড়ে দেয় সবকিছু। বাবা যখন মারা যান, তখনও এতটা কষ্ট পাইনি, পাইনি মানে কষ্ট পাওয়ার অবকাশ পাইনি। কিন্তু গত একবছরে তার অভাব যতটা তীব্রভাবে অনুভব করেছি, ততটা জীবনে আর কখনো, কোনো কিছুর জন্য করিনি। আমি আমার মানিব্যাগে সবসময় বাবার একটি ছবি রাখি, তাকে স্মরণ করবো বলে নয়। যখন খুব মন খারাপ থকে বা বিপদ আসে তাঁর ছবিটির দিকে তাকলে সাহস পাই। তার সেই স্নেহমাখা মুখচ্ছবি নিমেষেই মুছে দেয় সব বেদনা, সাহস দেয় সামনে এগিয়ে যাওয়ার। সারা জীবন তিনি কষ্টই করেছেন। যখন তাঁর দুই ছেলে সংসারের হাল ধরার মত সবল, যখন তিনি অবসর জীবন শুরু করলেন, তখনই তিনি চলে গেলেন চিরবিশ্রামের দেশে। মৃত্যুর পর মানুষ কোথায় যায় জানি না। তবে এপারের কর্মের জন্য যদি ওপারে কোনো পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকে, তবে আমার বাবা নিশ্চয়ই তা পেয়েছেন। কারণ তিনি সারাজীবন সৎভাবে জীবনযাপন করেছেন, মানুষের উপকার করার চেষ্টা করেছেন, কারো কোনো ক্ষতি করেননি।
প্রিয় পাঠক, একান্ত ব্যক্তিগত কথা লিখে আপনাদের বিরক্তি উৎপাদনের জন্য ক্ষমা চাইছি। আসলে আনন্দ ভাগ করলে দ্বিগুণ হয়, কষ্ট ভাগ করলে কম হয়। হয়তো এ জন্যই আমার একার বেদনা আপনাদের সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইলাম। তাতে যদি বাবাকে হারানোর ব্যথা কিছুটা হলেও কমে। কিন্তু দেখুন কী অদ্ভুত বৈপরীত্য, আমি কিন্তু বাবা হারানোর ব্যথা একটুও কমাতে চাই না। আমি সারাজীবন এ বেদনা বয়ে বেড়াতে চাই।
প্রভাষ আমিন: সাংবাদিক।।
৪ জুন ২০০১।
(লেখকের প্রথম বই ‘স্বাধীনতা আমার ভালো লাগে না’ থেকে নেয়া)
বি.দ্র. ১৬ জুন ‘বিশ্ব বাবা দিবস’। দিবসটি উপলক্ষে এসবিডি নিউজ24 ডট কম পাঠকদের জন্য লেখাটি পুণঃমুদ্রণ করা হলো।