সিঙ্গাপুর ভ্রমণঃ অভিজ্ঞতায় নতুন মাত্রা…
তানিয়া হোসেন
২০১১ সালের কাউন্ট ডাউন আকাশ থেকে দেখবো বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তাই ওভাবেই ফ্লাইট বুক করি। রাত বারোটায় সিঙ্গাপুরে প্লেন নামবে। ২০১০ সাল ছিল সাফল্যের, জীবনের স্বপ্নপূরণের সিঁড়ির প্রথম ধাপে পর্দাপণ করার। অনেক প্রত্যাশা ও স্বপ্ন নিয়ে সিঙ্গাপুরএায়ারলাইন্সের ভিতরে প্রবেশ করলাম। বসে আছি সিঙ্গাপুর এায়ারলাইন্সের ভিতরে। আমার সারিতে দু’জন জাপানী ছেলে বসে; বয়সে অনেক ছোট হবে বলেই মনে হলো। কিছু সময় কোনো কথাই হয়নি। আধঘন্টা পর একটা ছেলে আমার কাছে কলম চাইলো এবং সেই থেকেই কথার শুরু। কিছুক্ষণ পর জানতে পারলাম, আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই তারা সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র এবং আমি যে বিভাগে পড়াই সে বিভাগেরই।
কথা বলতে বলতে প্লেন সিঙ্গাপুরে নামলো। ছেলেটির বাবা-মা সিঙ্গাপুরে থাকেন তাই সে সিঙ্গাপুর থেকে বিদায় নেবে বলে আমাকে জানিয়েছিল। আমি ছেলেটির সাথে এসকেলেটরে উঠে উল্টোদিকে ফিরে কথা বলছিলাম। ভুলেই গিয়েছিলাম যে, এসকেলেটরের শেষপ্রান্ত চলে এসেছে। শেষপ্রান্তে এসে আমি পুরোপুরি উল্টে পড়ে গেলাম! সবাই আমার দিকে তাকিয়েছিল। আছাড় খেয়েই শুরু হলো আমার সিঙ্গাপুর ভ্রমণ! দু’জনেই কথা বলতে বলতে গেইটের দিকে যাচ্ছি,এমন সময় দু’জন মহিলা একবাক্স চকোলেট নিয়ে আসলেন এবং আমাদের ক্রিসমাস ইভের উপহার দিলেন। সিঙ্গাপুর সরকারের পক্ষ থেকে এই চকোলেট বিতরণের ব্যবস্থা। উন্নত বিশ্বের সাথে উন্নয়নশীল বিশ্বের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো যে, উন্নত বিশ্বের মানুষেরা সবাই মিলে আনন্দ উপভোগ করতে চায়। অন্যের দুঃখে দুঃখিত হয় এবং অপরের দুঃখ লাঘবের চেষ্টা করে। আর আমরা অন্যের কষ্টে আনন্দ পাই, উন্নয়নের পথে যতটুকু সম্ভব তার চেয়ে বেশি বাধা দেয়ার চেষ্টা করি এবং দিনভর মানুষের সমালোচনা করি। আর হিংসা করার বিষয়টি যেন আমাদের সংস্কৃতি হয়েই দাঁড়িয়েছে। এ মানসিকতার পরিবর্তন না করলে বিশ্বে আমরা কোনোদিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। কোনো জাতি আমাদের প্রতি আস্থাশীল হবে না।
২০১১ অনেক আশা আর প্রত্যাশা নিয়েই শুরু করলাম। সারা শহরে আতশবাজি ফুটিয়ে শুরু হলো সিঙ্গাপুরের ২০১১ সাল। আমার জীবনেও এলো সম্ভাবনার আরও একটি বছর। রাত বাজে একটা, পহেলা জানুয়ারি; ২০১১ সাল। সিঙ্গাপুর সম্পর্কে আসলে লেখার কোনো ইচ্ছা ছিল না; তবে বেশকিছু ব্যতিক্রমধর্মী অভিজ্ঞতাই আমাকে লিখতে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। সিঙ্গাপুর সম্পর্কে আমরা সবসময়ই ভালো কথাই শুনে থাকি; তবে দুর্ভাগ্যবশত আমার অভিজ্ঞতা মিশ্র। আমার সাথে সেদিন সিঙ্গাপুরের দু’শো ডলার ছিল। আমি ভাবলাম রাতে ট্যাক্সিতে যে কতো লাগবে তা তো জানি না; আরো কিছু আমেরিকান ডলার ভাঙিয়ে নিয়ে যাই। তাই একশো ডলার ভাঙাতে মানিচেঞ্জারে গেলাম। একশো ইউএস ডলারে আমাকে দেওয়ার কথা সিঙ্গাপুরের একশো পঁচিশ ডলার। রিসিটেও তাই লেখা, কিন্তু মানিচেঞ্জারের দায়িত্বে বসা মহিলা আমাকে দিলেন পঁচাত্তর ডলার। আমি তো অবাক? মহিলাকে বলাতে সে রেগে গেল। বললো যে, আমি লুকিয়ে রেখেছি! আমি বললাম, ঠিক আছে, আমাকে চেক করো। চেক করা হলো, টাকা কোথাও নেই! আমি বললাম, এবার তোমাকে চেক করবো। মহিলা বললো, আমাকে তার আগে আমার ক্যাশ চেক করতে হবে। আমি বললাম, ঠিক আছে, মহিলার ক্যাশ এবং কম্পিউটার চেক করা হলো সেখানে টাকা নেই। সবশেষে টাকা পাওয়া গেলো মহিলার পকেটে।
বছরের প্রথমদিন ছিল বলে তার প্রতি আমি কোনো কমপ্লেইন ফাইল করি নাই। অনেক মন খারাপ নিয়ে রওনা হলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে। ট্যাক্সি করে হোটেলে এসে আরেকটা ধাক্কা খেলাম, সেটা হলো- ভুল সময়ে আমাকে বুকিং দেয়া হয়েছে। জামাত নামের একটি ছেলে আমার পক্ষ হয়ে হোটেল বুকিং করে। জামাত সিঙ্গাপুরে একটি ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। জামাতকে আমি কখনো দেখিনি। জামাত হচ্ছে আমার খ্যাতনামা কবি ভাই ড. আবুল হাসনাত মিল্টনের পরিচিত। আমার পৌঁছাবার কথা রাত বারোটায়, কিন্তু আমার বুকিং হয়েছে পরের দিন দুপুর বারোটায়। হোটেলের লবিতে পৌঁছবার পর জানতে পারি যে নিউইয়ারের জন্য কোনো রুম খালি নেই। আমি লবিতে বসে অপেক্ষা করতে চাইলে হোটেলের ম্যানেজার আমাকে বললেন, পাশেই মোস্তফা সেন্টার আছে এবং সেটা চব্বিশ ঘণ্টাই খোলা থাকে। চাইলে আমি সেখানে গিয়ে রাতটা কাটাতে পারি। আমি তাতে রাজি হয়ে গেলাম। হোটেল থেকে মোস্তফা সেন্টারের দূরত্ব পাঁচ মিনিটেরও কম। যাওয়ার পথে এক ভাই আমাকে দেখামাত্রই কালবিলম্ব না করে পিছু নিলেন এবং সাথে সাথে বললেন,”Hey, where are you from? Do you like disco?” আমি বললাম- Do not disturb please!!” বলেই মোস্তফা সেন্টারের প্রধান ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালাম এবং আবারো খেলাম আরেকটি ধাক্কা। ঢুকতেই দেখি দু’জন পুলিশ একজন ভারতবর্ষীয়কে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দোকান থেকে জিনিস চুরির দায়ে সে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। একের পর এক দুর্ঘটনা দেখে আমার তো মন অসম্ভব খারাপ হয়ে গেলো। মনে হচ্ছিল কেঁদেই ফেলি। যাই হোক, ভাবলাম ক্লান্তি দূর করার জন্য এককাপ কফি খাই। কফিশপে কফি কিনে যখনই বাইরের লবিতে বসতে যাবো ঠিক তখনই আরেকজন ভদ্রলোকের সাথে দেখা। উনি গাড়িতে উঠে চলে যাচ্ছিলেন, যখনই আমাকে দেখলেন দেরি না করে এক কাপ কফি কিনে পাশে এসে বসলেন এবং লোভীর মতো আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ক্ষুর্ধাত কুকুরের খাবারের জন্য যেভাবে লালা বের হয় ওনারও ঠিক সেভাবেই যেন লালা বের হচ্ছে!কিছু কিছু নোংরা মানসিকতার মানুষের জন্য অনেক সময় আমরা সমাজের সকলেকেই ভুল বুঝি। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি নোংরা মনের মানুষের চেয়ে ভালো মনের মানুষের সংখ্যাই পৃথিবীতে এখনো বেশি।
আমি পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে লিখছি, আর ঐ মানুষটিও ক্ষুর্ধাত কুকুরের মতো আমার দিকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরেই তাকিয়ে আছেন। আমি কমপক্ষে পাঁচবার টেবিল বদল করেছি তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য; কিন্তু উনি নাছোড়বান্দা। আড়াই ঘণ্টা আমাকে বিরক্ত করার পর আমি পুলিশকে ডাকার সিদ্ধান্ত নিই। ইনফরমেশন থেকে পুলিশের নম্বর আনার সময় দেখি উনি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আমার কথা শুনছেন। আমি চললাম ফোন বুথের দিকে পুলিশকে ফোন করার জন্য; আর তার পরপরই ভদ্রলোকের কোনো চিহ্ন আমি মোস্তফা সেন্টারের কফিশপে দেখলাম না!
ভোর ছ’টার দিকে দেখি চারদিকে সূর্যের আলো দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ বোধহয় কাজের শেষে বাড়ি ফিরছেন, কেউ কেউ বোধহয় কাজের উদ্দেশ্য্যে রওনা হয়েছেন; আমিও হোটেলের দিকে আস্তে আস্তে রওনা হলাম। হোটেলে গিয়ে দেখি জামাত আমার জন্য লবিতে অপেক্ষা করছে। দেখেই সাথে সাথে আমাকে চিনে বললো, আপা কেমন আছেন?
মনে একটু স্বস্তি পেলাম অপরিচিত জায়গায় পরিচিত একজন মানুষকে পেয়ে। সাথে সাথেই ক্লিনাররা সবাই চলে এলেন; রুম পরিষ্কার হয়ে গেল, চেক-ইন করলাম। রুমটা সুন্দর। জামাত আমাকে রুমে দিয়ে বললো দুপুরের পর সে আবার আসবে। দুপুর দু’টার দিকে জামাত আমাকে নিয়ে গেল এক বাঙালি রেস্টুরেন্টে। নাম বাসমতী। পৃথিবীর অনেক দেশের বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টেই খেয়েছি; কিন্তু বাসমতীর খাবারের স্বাদ আজও ভুলতে পারিনি। আতিথেয়তার কোনো তুলনা হয় না। পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলছি, যদি কখনো সিঙ্গাপুর যান, তবে অবশ্যই বাসমতীতে একবার খাবেন। খাবার শেষে চলে গেলাম সানতোসা আইল্যান্ডে। সানতোসা আইল্যান্ড পাঁচ কিলোমিটার বিশিষ্ট একটি আইল্যান্ড, এটি একটি বিনোদনের স্থান। এখানে বীচ আছে, ক্যাসিনো আছে এবং আছে অনেক রকমের রাইড। তেমন বিশেষ কোনো ঘটনা নেই বলেই এখানে সানতোসার বর্ণনা আর করছি না। পরের দিন সকালে আমার কবি ভাইয়ের সিঙ্গাপুরে আসার কথা। কথা ছিল বিকেলে হোটেলের লবিতে দেখা হবে। পরেরদিন মিটিং শেষ করে চলে গেলাম কবি ভাইয়ের হোটেলে। তখন সন্ধ্যা ছ’টার মতো বাজে। রাত বারোটায় আমার ফ্লাইট। কবি ভাই বললেন যে, আমার ছোট বোন আসছে অল্প সময়ের জন্য, রাতের খাবার না খেয়ে সিঙ্গাপুর থেকে যাবে না। ওনার আন্তরিকতায় আমি খুবই মুগ্ধ হলাম। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কোথায় খেতে চাই। আমি কোনোকিছু চিন্তা না করে বললাম- বাসমতীতে খাবো। গেলাম বাসমতীতে; খাবার খেতে। কবি ভাই একের পর এক অর্ডার দিয়েই যাচ্ছেন তার বোনের জন্য। খাবার শেষে রওনা হলাম এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। ট্যাক্সিস্টান্ডে যাবার পথে দেখি নিশিকন্যাদের ব্যবসায়ের স্থান। সিঙ্গাপুরে এ ব্যবসাটা একটু অন্যভাবে পরিচালিত হয়। নিশিকন্যারা বসে থাকে একটি বড় ঢালু সিঁড়িতে। সিঁড়ির সামনে একটি তালাবদ্ধ গেট। তার পাশে আছে একটি ছোট জানালা। খরিদ্দাররা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। নম্বর দেখে মেয়েদেরকে পছন্দ করে পাশের জানালায় দামাদামী করে বনিবনা হলে পেছনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে। একেকবার এর মূল্য বিশ সিঙ্গাপুর ডলার। বিশ ডলার দিয়ে কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে কোনো খাবার পাওয়া যায় না। তবে একটি সুন্দরী নারীসঙ্গী পাওয়া যায়। খরিদ্দাররা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। সিঙ্গাপুরে অনেকদেশ থেকে মানুষ কাজ করার জন্য যান এবং সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে রাতে চার-পাঁচ জন মিলে এক রুমে থাকেন। সাধারণত ত্রিশ-চল্লিশ জনের জন্য একটি গোসলখানা ও বাথরুম থাকে। খুবই কষ্টের জীবন। এই কষ্টের জীবনে এই মেয়েগুলো একটু স্বস্তি দেয়। এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে চলে এলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে কখন হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলো হঠাৎ করে আমার মনে হলো যে, এই নিশিকন্যারা এক ধরনের মানবসেবায় নিয়োজিত। যদিও দেহব্যবসা সামাজিক অপরাধ, ধর্মীয়ভাবে গুনাহ আর সমস্ত রোগ ব্যাধির প্রাণকেন্দ্র। এসব সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও এক শ্রেণীর মানুষের কষ্ট লাঘবের স্থান। যে মূল্যে কোনো ভালো খাবার পাওয়া যায় না তার চেয়েও কমমূল্যে নিজের দেহ বিলিয়ে অন্যের কষ্ট লাঘবের যে চেষ্টা এ নিশিকন্যারা করে থাকে,সেটাকে এক ধরনের মানবসেবাই বলা যেতে পারে। ট্যাক্সি চলে এলো হোটেলে আর আমি আমার লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলাম । যাবার পথে ভাবছিলাম কেনো বাংলাদেশ এসব দেশের মতো নয়। মাত্র তিনঘণ্টা সময় লাগে বাংলাদেশ থেকে ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুরে যেতে; অথচ এসব দেশ কত উন্নত, কত নিরাপদ। চলাচলে কেন বাধাই পেতে হয় না। নিজের দেশের মানুষের কেনো এতো কষ্ট, কেনো এসব দেশের মতন উন্নত নয়? কেনো নিজের দেশে একা ট্যাক্সিতে করে এয়ারপোর্টে যেতে পারি না। কেনো নিজের জন্মস্থানে চলাচল করতে সবচেয়ে বেশি ভয় লাগে? হাজারো প্রশ্ন মনে আসতে থাকে এবং এরই মাঝে ট্যাক্সি চলে আসে সিঙ্গাপুরের চাঙ্গিঁ এয়ারপোর্টের সামনে।
তানিয়া হোসেন: প্রাবন্ধিক।।