পীরগঞ্জের ফোর মার্ডারঃ আজও উন্মোচণ হয়নি হত্যা রহস্য!
ছাদেকুল ইসলাম রুবেল, গাইবান্ধা প্রতিনিধি,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার নির্ভৃত পল্লী চতরা ইউনিয়নের মায়াগাড়ি গ্রামে দীঘি নিয়ে বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষের হামলায় ৪ ব্যক্তি নিহত হবার পর দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর অতিবাহিত হলেও স্বজনদের কান্না আজও থামেনি। স্মরনকালের ভয়াবহ ও নৃশংস হামলায় নিহতদের পরিববার পরিজনরা অনেকেই এখন মানবেতর জীবন যাপন করছে। সংসারে উপার্জনের একমাত্র ব্যক্তি নিহত হওয়ায় তাদের স্ত্রী সন্তানরা অন্যের বাড়িতে কাজ করছে জঠরের জ্বালা নিবারনে। লোমহর্ষক ওই ঘটনায় যে চার জনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, তারা হচ্ছে–মায়াগাড়ি গ্রামের মৃঃ কপিল উদ্দিনের পুত্র আব্দুর কুদ্দুস(৪৫), মৃঃ ইউসুব আলীর পুত্র নজরুল ইসলাম(৩০), ছয়েছ উদ্দিনের পুত্র সাইদুল ইসলাম(৪০) ও আব্দুস সামাদের পুত্র রেজওয়ান(৩০)। নিহত হবার দিন নজরুলের যে কন্যা সন্তানের বয়স ছিল মাত্র ৭ দিন, সে এখন সাড়ে তিন বছরের শিশু নুরানী। চঞ্চল পায়ে হাঁটি হাঁটি করে বাড়ির উঠানে ঘুরে বেড়ায়। সকলের মনযোগ কাড়ে কাচা-কাচা,ভাঙ্গা-ভাঙ্গা কথা বলে। দু কন্যা সন্তানের জনক নজরুল। বড় মেয়ে ফারজানার বয়স ৯ বছর। স্ত্রী পারভীন ওরফে ভানুর নামে কোন সরকারি ভাতা বা বিধবা ভাতার একটি কার্ডও জোটেনি আজও পর্যন্ত। ভুমিহীন স্বামীর সংসার চালানোর জন্য সে এখন অন্যের বাড়িতে কাজ করে। অনন্যোপায় রেজোয়ানের স্ত্রী তাজমিন বেগম (২২)ভুমিহীন স্বামীর বাস্তুভিটা ছেড়ে একমাত্র সন্তান লাবিব(৮) কে নিয়ে বাবার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বাধ্য হয়ে। আব্দুল কুদ্দুসের স্ত্রী বেগম(৪৫) ২ পুত্র ২ কন্যা সন্তানকে নিয়ে স্বামীর ভিটেকে আকড়ে ধরে আছে। এক সময় তার নামে ভিজিডি কার্ড থাকলেও অনেক আগেই সেটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। পুনরায় তার নামে কার্ড বরাদ্দ দেয়া হয়নি। নিহত অপর ব্যক্তি সাইদুর রহমান। স্ত্রী বিলকিস বেগম এর নামে কোন সরকারি সাহায্য জোটেনি। তিন ছেলের মধ্যে ছোট ছেলের বয়স মাত্র ছয় বছর। জ্যোষ্ঠ পুত্র উচ্চ মাধ্যমিক ফেল করে এখন দিন মজুরী করে জীবিকার তাগিদে।উলে¬খ্য, ২০০৯ ইং সালের এপ্রিল মাসে বিবাদমান দুই দলের বিরোধের জের ধরে গভীর রাতে দীঘির পাড়ে ঘুমিয়ে থাকা ১’শ দলের লোকজনের উপর ভাড়াটে পেশাদার খুনীদের নিয়ে হামলা চালিয়ে ৪ জনকে হত্যা করে। স্মরণযোগ্য যে, বড় আলমপুর ইউনিয়নের সীমানায় ৭ একর ৮৫ শতক এবং চতরা ইউনিয়নের সীমানায় ৩ একর ৫ শতক জমি সহ সর্বমোট দশ একর ৯০ শতক জমির উপর হরিণ সিং দীঘির অবস্থান। টানা অর্ধশত বছর ধরে চতরা ইউনিয়নের মায়াগাড়ি ও আলমপুর ইউনিয়নের বড় আলমপুর গ্রামবাসীর মধ্যে উক্ত হরিণ সিং এর দীঘির দখলদারিত্ব নিয়ে বিরোধ। গত চলি¬শ বছর ধরে টানা বিরোধে এর আগে দশ জনেরও বেশি প্রাণ হারিয়েছে। পঙ্গুত্ব বরণ করেছে অর্ধশত। ১’শ দল নামে অভিহিত ময়াগাড়ি গ্রামের ভুমিহীন সমিতিরি সাথে পার্শ্ববর্তী বড় আলমপুর গ্রামের ২৪ দল নামে পরিচিত একটি মহলের কয়েকদফা সংঘর্ষও হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ১’শ দলের লোকজন উক্ত দীঘিটি দখল করে মাছ চাষ করে। দিবারাত্র সেখানে পাহারারও ব্যাবস্থা করেছিল তারাই। ঘট্নার রাতে এরা ২৫/৩০ জনের একটি দল দীঘির পাড়ে টিনের চালার নিচে ঘুমিয়ে পড়ে। গভীর রাতে পাহারারত ঘুমন্ত এই দলটির উপর ২৪ দলের লোকজন সহ ভাড়াটে কিছু পেশাদার সন্ত্রাসী অতর্কিত লোমহর্ষক হামলা চালায়। এতে অন্তত বিশ জন আহত হয়। আশংকাজন অবস্থায় রাতেই ১২ জনকে রংপুর মেডিকেলে ভর্তি করা হলে কর্তব্যরত ডাক্তার ৪ জনকে মৃত ঘোষণা করেন। পরদিন মায়াগাড়ি গ্রামের মৃত তোফাজ্জল হোসেনের পুত্র কামরুজ্জামান বাদী হয়ে ৪১ জনকে আসামী করে পীরগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। এ ব্যাপারে তোলপাড় শুরু হলে উর্ধ্বতন র্কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহের উদ্দেশ্যে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অযুহাতে তড়িঘড়ি করে পীরগঞ্জ থানার পুলিশ ৬ জনকে গ্রেফতার করে। এরা হচ্ছে-মায়াগাড়ি গ্রামের আব্দুর রহিমের পুত্র মোনাজ্জল হোসেন(৩২), ভাড়াটে হিসেবে কিলিং মিশনে অংশ নেয়া পেশাদার সন্ত্রসী রামনাপুর ইউনিয়নের বড় মজিদপুরগ্রামের মৃঃতোফাজ্জল হোসেন পুত্র বাবলু ডাকাত(৪৫), সয়েকপুর গ্রামের বাদশা মিয়ার পুত্র দুলু(৩৫), মৃতঃ সমস উদ্দিনের পুত্র সাবু মিয়া(৪৮), রইচ উদ্দিনের পুত্র শহিদুল ইসলাম(২৯) ও মৃতঃ ছমির উদ্দিনের পুত্র লালু মিয়া(৩৫)। পরে চার্জশীট থেকে এদের নাম বাদ দেয়া হয়। পীরগঞ্জ থানার তদানিন্তন ওসি জাহাঙ্গির হোসেন মোট ৪৬ জনের নামে আদালতে চার্জশীট প্রদান করেন। চার্জশীটভুক্ত ১০ জন আসামীর নামে এখনও গ্রেফতারি পরওয়ানা রয়েছে। এরা এলাকাতেই অবস্থান করে। অথচ রহস্যজনক কারনে পীরগঞ্জ থানার পুলিশ এদের গ্রেফতারে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এদিকে গ্রেফতারি পরওয়ানা মাথায় নিয়ে ফোর মার্ডার মামলার আসামীরা নানাভাবে বাদী পক্ষকে হুমকি ধমকিও দিচ্ছে। রাতের আধাঁরে দীঘির মাছ ধরছে। এমনকি মাঝেমধ্যে মারধরও করছে। ফলে আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে হরিণ সিং দীঘির আশপাশের এলাকা। এক সময় দীঘির পাড়ে জমজমাট বাজার ছিল। দোকানপাট ছিল ভরপুর। দিবারাত্র সেখানে লোকজনের পদভারে মুখরিত ছল। বর্তমানে সেই স্থান বিরানভুমিতে পরিণত হয়েছে। দিনের বেলাতেই চারিদিকে শুনশান নিরবতা। কোথাও কোন জন মানুষের সাড়া শব্দ নেই। রোজ সন্ধ্যার পর তা এক নির্জন ভুতুড়ে মৃতঃ পুরীতে পরিণত হয় !