রেশমা ‘নাটক’ এবং মিডিয়ার পেশাদারিত্ব
শওগাত আলী সাগরঃ
দুটি ভিন্ন পত্রিকা। অথচ দুটির প্রতিবেদনে আলাদা কিছু নেই। বলা হয়েছে ‘অনুসন্ধানী প্রতিবেদন’। কিন্তু প্রতিবেদন দুটি পড়ে ঠিক অনুসন্ধানের কোনো কিছু পাওয়া গেল না। বরং দুটি প্রতিবেদন মোটামুটি একই। ‘ডেইলি মেইল’ এবং ‘সানডে মিরর’- উভয়েই উদ্ধৃতি দিয়েছে ঢাকার ‘আমার দেশ’ নামের বিতর্কিত একটি পত্রিকার।
চোখ রাখি ‘আমার দেশ’ পত্রিকায় কদিন আগে ছাপা হওয়া ওই রিপোর্টের উপর। ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড দুটিতে প্রকাশিত প্রতিবেদন আসলে ‘আমার দেশ’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনটির ইংরেজি অনুবাদ মাত্র। ভিনদেশি কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত পত্রিকার খবরের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত খবরও কি ‘অনুসন্ধানী প্রতিবেদন’ হয়? সাংবাদিকতার পণ্ডিত ব্যক্তিরা ভালো বলতে পারবেন।
তবে প্রতিবেদনটি ‘আলোড়ন’ তুলতে পেরেছে এটা সত্য। একই সঙ্গে বিতর্কও তৈরি করেছে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যেটি করেছে সেটি হল ‘ডেইলি মেইল’ এবং ‘মিরর’ নামের ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড দুটি বাংলাদেশের মিডিয়া, সাংবাদিকতা, মিডিয়ার পেশাদারিত্ব প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। মিডিয়ার দায়িত্ববোধ এবং নৈতিকতাবোধ নিয়েও প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দিয়েছে পত্রিকা দুটো।
সাভারের রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে ১৭ দিন পর উদ্ধার হওয়া এবং অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া রেশমার উদ্ধার ঘটনা দুটি ট্যাবলয়েড পত্রিকাই ‘ভাঁওতাবাজি’ হিসেবে অভিহিতি করেছে। স্পষ্টতই এটি একটি সিন্ডিকেটেড নিউজ। একই সূত্র থেকে পাওয়া একই নিউজ দুটি পত্রিকায় দুজন ভিন্ন রিপোর্টারের নামে প্রকাশিত।
‘মিরর’-এর রিপোর্টার সাইমন রাইট দাবি করেছেন তিনি ঢাকা সফর করেছেন, রেশমার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন। রেশমার মায়ের সঙ্গে রিপোর্টারের একটি ছবিও আছে পত্রিকায়। ‘ডেইলি মেইল’-এর রিপোর্টার এ ধরনের কোনো দাবি তার রিপোর্টে করেননি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডের এ রিপোর্ট ঢাকার অনেকগুলো পত্রিকা বাংলায় অনুবাদ করে হুবহু প্রকাশ করেছে। যে পত্রিকাগুলো বাংলা করে প্রকাশ করেছে তার সবকটিই জামায়াত-বিএনপির রাজনীতির অনুসারী। পত্রিকাগুলোর এ চরিত্রের কথা তা কাউকে বলে দিতে হয় না।
ব্যতিক্রম হচ্ছে ‘প্রথম আলো’। এটি সবসময়ই নিজেদের নিরপেক্ষ হিসেবে দাবি করে থাকে। তাহলে তারা তাহলে জামায়াত-বিএনপিপন্থী মিডিয়ার সঙ্গে সিন্ডিকেটের অংশীদার হল কেন? শাহবাগের গণজাগরণ-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে ‘প্রথম আলো’র ভূমিকার প্রতি যাদের সজাগ দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল তাদের কাছে এ প্রশ্ন হাস্যকর। নিরপেক্ষতার মুখোশের আড়ালে থেকে ‘প্রথম আলো’ যে জামায়াত-বিএনপির দিকে হেলে পড়ছে, সেটি পত্রিকার সচেতন পাঠকদের দৃষ্টি এড়ায়নি।
রেশমা ইস্যুতে ‘প্রথম আলো’ নিজেই যেন নিজের অবস্থান খোলামেলা করে দিল। রেশমাকে নিয়ে শুরু থেকেই যে একটা গুঞ্জন তৈরি হয়েছিল, জামায়াত-বিএনপিপন্থীরা সে গুঞ্জনটাকে নানাভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়েছে– সেটাকে একটা গ্রহণযোগ্যতা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে ‘প্রথম আলো’।
রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধারের পরপরই রেশমাকে নিয়ে কিছু সন্দেহ এবং গুঞ্জনের জন্ম দেয় আমাদের মিডিয়া। ‘এত ফ্রেশ লাগছে কেন, কাপড়চোপড় এত পরিষ্কার কেন, হাতের নখ ছোট কেন, কোথাও আঘাত লাগেনি কেন’ এ ধরনের প্রশ্নের অবতারণা করে রেশমা উদ্ধারের ঘটনা সম্পর্কে একটি সন্দেহ তৈরি করে দেয় মিডিয়া। স্বভাবগতভাবেই কৌতূহলী বাঙালির কৌতূহল মিডিয়া দক্ষতার সঙ্গেই উসকে দিতে পেরেছে।
কিন্তু কেবল এ কাজ করেই চুপ হয়ে যায় ঢাকার মিডিয়া। কোনো মিডিয়াই সে কৌতূহল নিবৃত্ত করার বা সঠিক উত্তরটি খুজেঁ বের করার প্রয়োজন বোধ করেনি। অথচ সেটি ছিল নৈতিক এবং পেশাগতভাবে মিডিয়ার কর্তব্য। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ’ওয়ার্ড অব মাউথ’ ও সামাজিক যোগাযোগের নানা মিডিয়ায় অপ্রপচারের শীর্ষে নিয়ে যায় জামায়াত-শিবির আর জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কর্মীরা। একটা গুজব, একটা গুঞ্জন নিভৃতে ডালপালা ছড়াতে থাকে।
মূলধারার মিডিয়ার নিরবতা কাজে লাগায় অপপ্রচারে শীর্ষস্থানে থাকা জামায়াত-বিএনপি গ্রুপের মুখপাত্র ‘আমার দেশ’। তারা তাদের ‘অনুসন্ধানী(?)’ প্রতিবেদনে দাবি করে, রেশমার ঘটনা ছিল সাজানো নাটক। মিথ্যাচার আর প্রোপাগাণ্ডা চালানোর কারণে কুখ্যাতি পাওয়া এবং রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার কারণে ‘আমার দেশ’-এর রিপোর্টটি বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে পারেনি। ফলে সেটি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা বা বিতর্ক হয়নি। তারপরই ওদের রিপোর্টের ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয় লন্ডনের ট্যাবলয়েড পত্রিকা ‘ডেইলি মেইল’ এবং ‘সানডে মিরর’-এ।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে দুটি ব্রিটিশ পত্রিকাই ‘অনুসন্ধানী’ শব্দটি ব্যবহার করেছে। অনুবাদের ক্ষেত্রেও ঢাকাই মিডিয়াগুলো ‘ব্রিটিশ পত্রিকার অনুসন্ধানী রিপোর্টে’ তকমা লাগিয়ে এক ধরনের সেনশেসন তৈরির চেষ্টা করেছে। কিন্তু দুটো রিপোর্ট মনোযোগ দিয়ে পড়লে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে এগুলোতে কোনো ধরনের অনুসন্ধান নেই।
‘আমার দেশ’, ‘মিরর’ আর ‘ডেইলি মেইল’-এ প্রকাশিত রিপোর্টগুলো এক হাতে তৈরি বলে সবকটি রিপোর্টে একই ধরনের অসঙ্গতি ও দুর্বলতা চোখে পড়ে। চোখে পড়ে একই ধরনের মিথ্যাচার। ‘মিরর’ এবং ‘ডেইলি মেইল’-এর রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, রেশমা উদ্ধারের আগের দিন নাকি রানা প্লাজার আশপাশের বাসিন্দাদের তাদের বাড়িঘর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চব্বিশ ঘণ্টার জন্য টেলিভিশনে সংবাদ প্রচার নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু এ ধরনের কোনো ঘটনা সে সময় ঘটেছে বলে ঢাকার কোনো মিডিয়ায় খুজেঁ পাওয়া যায়নি। এমনকি যে ‘প্রথম আলো’ বিতর্কিত এই রিপোর্টটি বাংলা করে ছেপেছে তারাও সে সময় এ ধরনের কোনো সংবাদ দেয়নি।
রিপোর্টের একমাত্র সোর্স হচ্ছে রেশমার কথিত সহকর্মী যে দাবি করেছে প্রথম দিনেই তাকে আর রেশমাকে একসঙ্গে উদ্ধার করা হয়েছে। মাত্র একজন ব্যক্তির বক্তব্য দিয়েই কোনো ‘অনুসন্ধানী’ সাংবাদিকতা হয় কি না তা আমার জানা নেই। রিপোর্টে এনাম হাসপাতালে রেশমার চিকিৎসা নেওয়ার কথা বলা হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য নেই। এ থেকেই রিপোর্টের উদ্দেশ্য পাঠকের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।
রিপোর্টটিতে শিশির আবদুল্লাহ নামের একজন ‘অনুসন্ধানী’ সাংবাদিকের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কে এই শিশির আবদুল্লাহ? ঢাকার সাংবাদিক বন্ধুদের কেউই তার সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য দিতে পারেননি। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিশির আবদুল্লাহর আসল নাম ‘কদরউদ্দিন’। শিবিরের দীর্ঘদিনের কর্মী এ কদরউদ্দিন ‘বাশেঁর কেল্লার’ সক্রিয় কর্মী। শিশির আবদুল্লাহ নাম নিয়ে তিনি আমার দেশ-এ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছেন। দেখা যাচ্ছে, রেশমা নিয়ে ‘অনুসন্ধানের’ নামে ‘আমার দেশ’ আর বিএনপি-জামায়াতপন্থীরাই আসলে এ অপপ্রচার চালাচ্ছে।
লন্ডনের ট্যাবলয়েডগুলো পয়সা খরচ করে খবর বানায়– এটা নতুন কোনো তথ্য নয়। ‘মিরর’-এর আলোচিত রিপোর্টার সাইমন রাইট সাজানো খবর বানাতে গিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং তাকে সে দেশ থেকে বহিঃষ্কার করা হয়েছিল। মন্দ সাংবাদিকতার কলঙ্কতিলক পরা সাইমন রাইট দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ আয়োজন প্রশ্নবিদ্ধ করতে ৩৫ হাজার পাউন্ডে চুক্তি করা এক ব্রিটিশ তরুণকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন ইংল্যান্ড ফুটবল টিমের ড্রেসিংরুমে। যোশেফ নামের ওই তরুণের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল সে ইংল্যান্ড ফুটবল টিমের ড্রেসিংরুমের বর্ণনাসমেত তাকে সাক্ষাৎকার দেবে।
কিন্তু কেপটাউনের পুলিশ দুজনকেই গ্রেফতার করে। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সব মিডিয়ার শিরোনাম হয়েছিলেন সাইমন রাইট। তার অতীত এবং ‘আমার দেশ’-এর চরিত্র, দুটো একসঙ্গে মিলালেই রেশমাকে নিয়ে অপপ্রচারের একটি কারণ সম্পর্কে উপসংহার টানা যায়।
রেশমাকে নিয়ে বিতর্কটি রেশমা নামের গ্রামের সাধারণ এক গার্মেন্টকর্মীকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, আদৌ করেছে কি না সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। কিন্তু আমাদের মিডিয়ার নৈতিকতা ও পেশাদারিত্বে যে প্রচণ্ড চপেটাঘাত করেছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেই নেই।
শওগাত আলী সাগর : কানাডা থেকে প্রকাশিত ‘নতুনদেশ ডটকম’-এর প্রধান সম্পাদক।