ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহঃ বহুবিদ জ্ঞানের অধিকারী
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ
আমাদের জীবনকে সুন্দর করে সাজাতে স্মরণীয় বরণীয় আলোকিত বড় মাপের মানুষদের জীবন অনুকরণীয় আদর্শ। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তেমন একজন বড়মাপের মানুষ। ভাষাবিজ্ঞানের প্রায় সব ক্ষেত্রেই স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন তিনি। ২৪টি ভাষা তিনি আয়ত্ত করেছিলেন, ১৮টি ভাষার ওপর তার অসাধারণ পান্ডিত্য ছিল। আজ (১৩ জুলাই) তাঁর ৪৪তম প্রয়াণ বার্ষিকী। ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৮৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ঢাকা হলের পাশে সমাহিত করা হয়। ভাষাক্ষেত্রে তাঁর অমর অবদানকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে ঐ বছরই ঢাকা হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় শহীদুল্লাহ হল। জীবনভর ভাষা ও সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ জ্ঞানতাপসকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স’, ফরাসি সরকার ‘নাইট অব দ্য অর্ডারস অব আর্ট লেটার্স’ এবং বাংলাদেশ সরকার একুশে পদকসহ (মরণোত্তর) বহু পুরস্কার, পদক ও সম্মাননায় ভূষিত করে। এছাড়া ও তিনি আদমজী সাহিত্য পুরস্কার ও দাউদ সাহিত্য পুরস্কার কমিটির স্থায়ী চেয়ারম্যান, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সম্পাদক ছিলেন।
বহু ভাষাবিদ, গবেষক, লোকবিজ্ঞানী, অনুবাদক, পাঠক সমালোচক, সৃষ্টিধর্মী সাহিত্যিক, কবি, ভাষাসংগ্রামী এবং দেশপ্রেমিক ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। জাতিসত্তা সম্পর্কে মুহাম্মদ শহিদুল্লাহর স্মরণীয় উক্তি ছিল “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙ্গালি।” ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার পেয়াারা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মফিজ উদ্দিন। আর মা হরুন্নেছা খাতুন। ছোটবেলায় ঘরোয়া পরিবেশে তিনি উর্দু, ফারসি ও আরবি ভাষা আয়ত্ত করেন। মূলত তাঁর মেধার পরিচয় পাওয়া যায় শৈশবেই। বাড়িতেই তাঁর পড়ালেখাই হাতেখড়ি। এরপর ভর্তি করা হয় গ্রামের পাঠশালায়। মুহম্মদ শহীদুল্লাহর দশ বছর বয়সে হাওড়ার মধ্য ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে পাস করার পর হাওড়ার জেলা স্কুলে ভর্তি হলেন ১৮৯৯ সালে। বার্ষিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করায় তাকে রূপার পদক দেয়া হয়। এন্ট্রান্স পাশের সময় থেকেই মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বিভিন্ন ভাষার প্রতি অতি উৎসাহী ও আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং একাধিক ভাষা শিক্ষা শুরু করেন। ১৯১৫ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত চব্বিশ পরগণার বশিরহাটে আইন ব্যবসা করেন। ১৯১৯ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের সহকর্মী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পাশাপাশি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯২২ থেকে ১৯২৪ সালে পর্যন্ত আইন বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কলকাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন অধ্যাপক হিসেবে। ১৯২৬ সালে তিনি প্যারিস যান। সেখানকার সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বে পড়ালেখা করলেন। আসামি, উড়িয়া, মৈথিলি, হিন্দি, পাঞ্জাবি, গুজরাটি, মারাঠি, কাশ্মীরি, নেপালি, সিংহলি, তিব্বতি, সিন্ধি ইত্যাদি ভাষা আয়ত্ব করেন। প্যারিস থেকে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জার্মানি যান। ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করে আবার এলেন সোরবোন। বাংলায় ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ (আদি কবিতা সংকলন) নিয়ে গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। বাংলা ধ্বনিতত্ত্বে ডিপ্লোমা নিয়ে ১৯২৮ সালে দেশে আসেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একাধিক ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারতেন। কর্মজীবনের ফাঁকে ফাঁকে তিনি পড়তেন। তিনি যে গভীর জ্ঞানের সন্ধান লাভ করেছিলেন তারই দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন সাহিত্যে। ১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও রিডার হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখান থেকে ১৯৪৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পর তিনি বগুড়া আযিযুল হক কলেজে প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৩ সালে তিনি পুণরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ফরাসি ভাষার খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও পালি বিভাগে যোগদান করে ১৯৫৮সালে অবসর গ্রহণ করেন। বিভিন্ন ভাষায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র দখল ছিল অসাধারণ ও অসামান্য। উর্দুভাষার অভিধান প্রকল্পেও তিনি সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। পরে পূর্ব পাকিস্তানি ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্পের সম্পাদক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে যোগ দেন। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির ইসলামি বিশ্বকোষ প্রকল্পের অস্থায়ী সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক গঠিত বাংলা একাডেমির পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন। তার নেতৃত্বে বাংলা পঞ্জিকা একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত রূপ পায়।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সবসময়-ই সাহিত্য কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। এম.এ পাশ করার পরই তিনি বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সম্পাদক হন। ১৯৪৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন। তিনি উর্দু অভিধান প্রকল্পেরও সম্পাদক ছিলেন। ভাষার প্রতি ভালোবাসা ছিলো তাঁর অপার। অনুরাগ ছিলো জ্ঞানের প্রতি। তাইতো অনেকগুলো ভাষা আর অনেক বিষয়ে ছিলো দখলদারি। প্রবল আগ্রহ আর নিষ্ঠাগুণেই হয়ে ওঠেন তিনি বহু ভাষাবিদ পন্ডিত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অনেক বই লিখেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ
ভাষা ও সাহিত্য।
বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত।
দীওয়ানে হাফিজ।
রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম।
বিদ্যাপতি শতক।
বাংলা সাহিত্যের কথা (২ খন্ড)।
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ।
বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান।
প্রকৃত জ্ঞানী কখনোই নিজেকে কোনও গোষ্ঠী বা গন্ডিতে সীমিত রাখেন না। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল না থাকলেও স্বীয় চেষ্টার তিনি জ্ঞানের অন্বেষণ করে গেছেন সারা জীবন। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন – “যে জাতি তার ভাষাকে শ্রদ্ধা করে না সে জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়”। তিনি যে গভীর জ্ঞানের সন্ধান লাভ করেছিলেন তারই দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গনে। বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত ও প্রাচ্যে অন্যতম সেরা ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই দেশের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য যে ক’জন মানুষ জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তাদের মধ্যে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ অন্যতম। তাঁর এই ভূমিকার ফলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ অনেক প্রশস্ত হয়েছিলো।
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।