কোটা আন্দোলন: আমার কিছু প্রশ্ন আছে
শওগাত আলী সাগর: ঠিক দিনক্ষণ মনে না থাকলেও সময়টা যে কম করে হলেও বারো বছর আগে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কেমন করে যেন সরকারি কমিশনের (পিএসসি) একটি বার্ষিক রিপোর্ট হাতে পড়ে। মাঠ পর্যায়ের রিপোর্টারের ক্ষুধা থেকেই আদ্যোপান্ত রিপোর্টটা পড়ে ফেলি। সরকারি চাকরি বাজারের,জনপ্রশাসনে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের ব্যাপারে বেশ কিছু মজাদার তথ্য পাওয়া যায় রিপোর্টটিতে। বার্ষিক প্রতিবেদনটা পড়তে পড়তেই সরকারি চাকরিতে নির্দিষ্ট থাকা কোটা ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু তথ্য চোখে পড়ে। সেই তথ্যগুলোর মূল বিষয়টা ছিলো,বছরের পর বছর ধরে কোটা পূরণ না হওয়ায় বেশ কিছু পদ কখনোই পূরণ করা যায় না। চাকরির দুর্মুল্যের বাংলাদেশে ক্যাডার সার্ভিসে পদ খালি থাকা অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কিন্তু পিএসসির বার্ষিক রিপোর্ট অনুসারে এটিই হচ্ছে বাস্তবতা।
সরকারি চাকরির জন্য নিদিৃষ্ট করে রাখা কোটা ব্যবস্থাটিকে অকার্যকর মন্তব্য করে সেটি সংস্কারের সুপারিশও ছিলো বার্ষিক রিপোর্টটিতে। এরপরেও অনেকবারই পিএসসির বার্ষিক রিপোর্ট হাতে পড়েছে,কৌতূহলী হয়ে পাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখেছি। কিন্তু এই তথ্যগুলোর পরিবর্তন হয়েছে- এমনটি চোখে পড়ে নি। অর্থ্যাৎ ক্যাডার সার্ভিসে কোটা ব্যবস্থাটি নিয়ে খোদ পিএসসিই প্রশ্ন তুলেছে ,আর প্রশ্নটি তুলেছে তারা প্রায় এক যুগ আগে। যদ্দুর জানি, পিএসসির বার্ষিক রিপোর্টটি প্রতিবছরই বের হয়,এটি জাতীয় সংসদের সদস্যদের কাছে পৌছেঁ দেওয়া হয়। সরকারের নীতি নির্ধারকদেরও কাছে যায়। বারো বছর ধরে খোদ পিএসসি যে প্রস্তাবনাটি করে যাচ্ছে নিরবে, সেই প্রস্তাবনাকে দাবি করে তরুন শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছে,বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে যে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে খোদ পিএসসি বারো বছর আগে প্রশ্ন তুলেছে এবং টানা প্রতিবছরই প্রশ্নটি পূণরুচ্চারন করেছে সেটি নিয়ে জাতীয় পর্যায়েও তো নয়ই কোনো পর্যায়েই কোনো কালেই কোনো ধরনের আলোচনা হলো না কেন? আর ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারী ফল পরীক্ষার পরপরই এটি আন্দোলনের ইস্যূ হয়ে উঠলো কেন? বুধবার তরুন শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেই জ্বালাও-পোড়াও ভাংচুরের ঘটনা ঘটাতে শুরু করলো কেন?
ঢাকার মিডিয়ার খবরাখবর থেকে যদ্দুর জানা গেছে, তাতে শিক্ষার্থীদের প্রথম দাবি ছিলো ৩৪তম বিসিএস এর প্রিলিমিনারী পরীক্ষার ফলাফল পূণর্বিবেচনা করা। পিএসসি সেটি মেনে নেওয়ার ঘোষনার সঙ্গে সঙ্গে দাবিটি পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং নতুন দাবি উঠে কোটা ব্যবস্থার বিলুপ্তির। একই সঙ্গে আন্দোলনের চরিত্রও পাল্টে যায় এবং সহিংস রুপ নেয়। আন্দোলনের সহিংসতা বিস্তৃত হয় স্পর্শকাতর কিছু জায়গায় হামলার মাধ্যমে। চারুকলায় মঙ্গলশোভাযাত্রার উপকরনাদিতে আগুন ভাঙচুর, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আপত্তিকর শ্লোগান ইত্যাদি আন্দোলন পরিচালনাকারীদের রাজনৈতিক একটা সম্পৃক্ততার আভাস দেয় সত্য। কিন্তু আমার আলোচনা সেগুলো নিয়েও নয়। কোটা ব্যবস্থা বাতিল করার দাবি নিয়ে আমার কিছু বক্তব্য আছে। কোটা ব্যবস্থা নিয়ে বুধবারের আন্দোলন নিয়েও আমার কিছু প্রশ্ন আছে।
প্রশ্ন হচ্ছে শিক্ষার্থীরা আগে কখনো কোটা ব্যবস্থা নিয়ে তাদের কোনো আপত্তি,উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠার কথা কোনো ফোরামে প্রকাশ করেছিলেন? নিদেনপক্ষে সংবাদপত্রে? বিসিএস পরীক্ষায় কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিকতা নিয়ে কোনো মিডিয়াও জরীপ টরীপ করেছে কখনো? তাহলে একদল রাস্তায় নেমে ভাংচুর শুরু করে দিয়ে বলতে শুরু করলো,’আমরা মেধাবী,কোটা ব্যবস্থা বাতিল করো’। আর সেটাকেই মেনে নিতে হবে- এই বিবেচনার সমর্থক আমি না। কোটা ব্যবস্থার বিগত সময়কার স্বরুপের সঙ্গে এবারকার বেশ কিছু পার্থক্য আছে জানি।কোটার নামে বরাদ্দের পরিমানটা বেশি, প্রিলিমিনারী পরীক্ষায়ও কোটা রাখা হয়েছে- এগুলো আলোচনা এবং বিতর্কের বিষয়। এই দুটোর কোনোটার সিদ্ধান্তইতো বুধবার বা তার আগের দিন হয়নি। তাহলে এই দাবিগুলো বিক্ষোভের ইস্যূ হয়ে উঠলো কিভাবে?
কোটার পরিমান বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত যখন হলো কিংবা প্রিলিমিনারী পরীক্ষায়ও কোটা ব্যবস্থা কার্যকর করার ঘোষনা যখন হলো তখন এই’মেধাবী’রা কোথায় ছিলেন? তখন কি তাদের কাছে এই প্রস্তাবনা বা পদক্ষেপগুলোকে আপত্তিকর বলে মনে হয়েছিলো? তাহলে সে সময় এনিয়ে আন্দোলন গড়ে উঠলো না কেন? আজ যারা এ নিয়ে গলাবাজি বা কলামবাজি করছেন,তারাই তখন এ নিয়ে কথা বলেন নি কেন? বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে যারা দেশের প্রশাসনের হর্তকর্তা হতে চান, তাদের পরীক্ষা পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে- আর তারা তার খবরই রাখবেন না,সেটোতো বিশ্বাস করা যায় না। আর সত্যি সত্যি খবর না রাখলে তাদের প্রশাসনের দায়িত্ব পালনের জন্য যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। কোটা ব্যবস্থার এই পদক্ষেপগুলো ঘোষিত হবার পরপরই এ নিয়ে বিতর্ক তোলা গেলে আজকে এভাবে ভাংচুরের দায়দায়িত্ব তরুন শিক্ষার্থীদের কাধে নিতে হতো না।
একই প্রশ্ন করা যায় পিএসসির ভূমিকার ব্যাপারেও। যে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে স্বয়ং পিএসসি ‘সন্তোষ্ট’ নয়,বছরের পর বছর ধরে বার্ষিক রিপোর্টে সংস্কারের তাগিদ দিচ্ছেন,তারা তাদের এই প্রস্তাবনাটিকে বৃহত্তর ফোরামে উত্থাপনের চেষ্টা করলেন না কেন? েকাটা ব্যবস্থার যৌক্তিকতা নিয়ে পিএসসি’র সংশয়ের কারনেই তো প্রতিবছর বার্ষিক প্রতিবেদনে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের আওয়াজ দিয়েছেন তারা। কিন্তু পিএসসি যদি দেশের শিক্ষাবিদদের ডেকে একটি উন্মুক্ত সেমিনার বা আলোচনার আয়োজন করে ‘কোটা ব্যবস্থার’ যৌক্তিকতা নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটাতে পারতো। কিন্তু কোনো মহল থেকেই এ নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা উসকে দেওয়ার চেষআট হয়েছে বলে চোখে পড়েনি। তাহলে হঠাৎ করে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবি এবং সেই দাবিতে সহিংস আন্দোলনের সূত্রপাত কিভাবে ঘটলো? ভালোভাবে যাচাই বাছাই না করে, মতামত বিশ্লেষন না করেই কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্তে পিএসসি যেতে পারে না।তবে ৩৪তম পরীক্ষার ফলাফল পূণমূল্যায়ন বা রিভিউ করার যে সিদ্ধান্ত পিএসসি নিয়েছে সেটা সঠিক বলেই আমি মনে করি।
বিসিএস পরীক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনটি নিয়েও আমার কিছু প্রশ্ন আছে। বিক্ষুব্দ আন্দোলনকারীদের ঢালাওভাবে ‘জামাত-শিবির’কর্মীর তকমা লাগিয়ে দেওয়ার ঘোরতর বিরুদ্ধে আমি। আমি বিশ্বাস করি, বিসিএস এর মতো সোনার হরিন হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশংকায় রাস্তায় নেমে আসা তরুনরা কোনো রাজনৈতিক মিশনের গোপন মিশনারি নন।কিন্তু তাদের আন্দোলনের ক্রাউডের ভেতরে যে কোনো রাজনৈতিক দলের মিশনারিরা ঢুকে গেছে- সেটিও পরিষ্কার। ‘বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতির নামে আন্দোলনটা রাজনৈতিক কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থে ব্যবহহৃত হওয়ার পুরো লক্ষণও দৃশ্যমান।
বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতির যে বিষয়গুলো নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে তার কোনোটাই গোপনে চাপিয়ে দেওয়া নয়। সিদ্ধান্ত গ্রহনের সাথে সাথে সেগুলো মিডিয়ায় এসেছে।কিন্তু কোনো মহল থেকে সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়নি। এখন হঠাৎ করে সহিংস আন্দোলনের ডাক দিয়ে একটি মৌলিক ব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিল করে দিতে সরকারকে চাপ দেওয়াকে কোনো বিবেচনায়ই যুক্তিসঙ্গত বলা যায় না। কাজেই আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে আমরা বক্তব্য, কোটা ব্যবস্থা এক কথায় বাতিল করে দেওয়ার বিষয় নয়। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে আলোচনা তর্ক বিতর্ক হওয়ার দরকার আছে। কোটা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন নতুন নিয়মের সিদ্ধান্ত ঘোষনার পর এতোদিন চুপচাপ থাকতে পারলে এখন রাস্তার ভাংচুরের আন্দোলন বন্ধ রেখে আলোচনার জন্য কিছুটা সময় দেওয়া যাবে না কেন? সরকারি চাকরি কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে রাস্তায়,চারুকলায় ভাংচুর করে,মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিয়ে ,প্রজন্ম চত্বরের নাম পাল্টে দিয়ে আন্দোলন পরিচালনায় আর যাই হউক ‘মেধা’র পরিচয় পাওয়া যায় না। এই বিষয়টা আমাদের ‘মেধাবী’রা যতো দ্রুত অনুধাবন করবেন ততই মঙ্গল।
লেখক: শওগাত আলী সাগর, নতুনদেশ ডটকম এর প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক ।