জাতীয় আয়কর দিবসের প্রাসঙ্গিক কথা

জাতীয় আয়কর দিবসের প্রাসঙ্গিক কথা

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ যারা নিয়মিত আয়কর দেন তাদের জন্য সেপ্টেম্বর মাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সারা বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব এ মাসেই কর অফিসে জমা দিতে হয়। জনগণকে কর প্রদানে উদ্বুদ্ধ করতে ১৫ সেপ্টেম্বর আয়কর দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। ২০০৮ সাল প্রথম আয়কর দিবস পালন করা হয়। এ বছরও আয়কর দিবস পালনের ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে এনবিআর। সভা, সমাবেশ, র‌্যালিসহ নানা আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের বিদ্যমান আয়কর আইনটি জন্মগতভাবে ব্রিটিশ, দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে ঔপনিবেশিক এবং প্রায়োগিক দিক থেকে জটিল, নিবর্তন ও ফাঁকি প্রতিরোধাত্মক। এ দেশে ভূমি কর বা রাজস্ব আদায়ের প্রথা প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রদান, বিভিন্ন সেবার বিনিময় কিংবা উত্পাদন বা সম্পদ ব্যবহার বাবদ নানা নামে নানা উপায়ে রাজস্ব বা টোল বা সেস আদায়ের প্রথা সেই আদি যুগ থেকে চলে আসছে। তবে আধুনিক আয়কর বলতে যে বিশেষ কর রাজস্বের সঙ্গে আমরা পরিচিত, ভারতীয় উপমহাদেশে তার প্রবর্তন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে, বিদেশি বেনিয়াদের দ্বারা।
এ দেশ ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃত্বে চলে যায়। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে কোম্পানির শাসন চলেছিল মূলত এবং মুখ্যত লাভজনক ব্যবসায়িক দৃষ্টি ও রীতিপদ্ধতিতেই। কোম্পানির স্বার্থে ও সুবিধার জন্য ১৭৬৫ সালে বাংলার কৃষিপণ্যকে বাণিজ্যিকীকরণ, ১৭৭৩ সালে রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাস, ১৮১৩ সালে ভারতে ফ্রি ট্রেড প্রবর্তন এবং ওই বছরই বাংলার মুখ্য শিল্প খাত টেক্সটাইল রপ্তানি বন্ধ, ১৮২০ সালে টেক্সটাইলকে আমদানি পণ্য হিসেবে ঘোষণা, ১৮৩০-এ কলকাতা ডকিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা, ১৮৩৫ সালে ইংরেজিকে অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে ঘোষণা, ১৮৩৮-এ বেঙ্গল বন্ডেড ওয়্যারহাউস অ্যাসোসিয়েশন গঠন এবং ১৮৪০ সালে বেসরকারি খাতে চা-বাগান স্থাপনের মাধ্যমে এ দেশীয় অর্থনীতির স্বনির্ভর সত্তাকে পরনির্ভর করার কার্যক্রম শুরু হয়।
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর এ দেশের শাসনভার ব্রিটিশ সরকারের হাতে যায়। ব্রিটিশ শাসনামলেই শাসকের সঙ্গে শাসিতের দায়দায়িত্ব পালনের প্রশ্ন সামনে আসে এবং ইউরোপীয় শিল্প বিপ্লবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় এ দেশের অর্থনীতি। এ প্রেক্ষাপটেই উত্পাদন, বিপণন ও বাণিজ্যব্যবস্থায় সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে আয়কর আদায়ের যৌক্তিকতা দেখা দেয়। প্রথমে ১৮৬২ থেকে ১৮৬৭ অবধি সীমিত অবয়বে আয়কর আদায় চললেও মাঝে বন্ধ হয় কার্যক্রম। আবার ১৮৮০-এর পর কয়েক বছর পরীক্ষামূলকভাবে তা চলে। সরকার স্থায়ীভাবে কোনো আইন না করে, স্থানীয়ভাবে এসআরও বা সার্কুলার জারির মাধ্যমে আয়কর আদায় কার্যক্রম পরিচালনা করে। আইনি কাঠামোয় ‘ভারতীয় আয়কর আইন’ প্রবর্তিত হয় ১৯২২ সালে। ১৯২২ সালের ভারতীয় আয়কর আইন ১৯৪৭-এ ভারত বিভাগের পর যেখানে ‘ভারত’ লেখা সেখানে ’পাকিস্তান’ প্রতিস্থাপন করে পাকিস্তানে প্রবর্তিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরও, এক যুগেরও বেশি সময় সেই ১৯২২ সালের আয়কর আইন পাকিস্তানের স্থলে বাংলাদেশ প্রতিস্থাপিত হয়ে চালু থাকে। আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ (১৯৮৪ সালের ৩৬ নং অধ্যাদেশ) জারির মাধ্যমে বাংলাদেশে নিজস্ব আয়কর আইন প্রবর্তিত হয় ১৯৮৪ সালে। তবে তখন দেশে জাতীয় সংসদ না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ আয়কর আইনটি অধ্যাদেশ হিসেবে জারি হওয়ায় এর প্রণয়ন ও প্রয়োগযোগ্যতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। এই অধ্যাদেশের ধারা-উপধারা বা বিধানগুলো মূলত ১৯২২ সালের মূল আইনেরই ধারাবাহিকতায় দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দেয়া প্রেসক্রিপশনের আলোকে তৈরি। বাংলাদেশে বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশের ভাষা ও গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, বছর বছর অর্থ আইনে যেসব শব্দগত সংযোজন-বিয়োজন অনুমোদিত হয়েছে, তা ধারণ করা ছাড়া ১৯২২-এর মূল আইনের ভাব, ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গিগত তেমন কোনো পরিবর্তন বা সংস্কার দেখা যায় না। যুগোপযোগী করার সেই সব সাময়িক প্রয়াসে আইনের কিছুটা পরিশীলিত রূপ প্রতিফলিত হলেও প্রতিবছর কর নির্ধারণ, শুনানি, বিচার-আচারে কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বা এখতিয়ার, কর অবকাশ, নিষ্কৃতি বা ছাড় কিংবা বিশেষ সুবিধাবলির ধারা-উপধারা সংযোজন-বিয়োজনের ধারাবাহিকতা বিচার- বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রেই করারোপ, আদায় ও করদাতার অধিকার, কর অবকাশ নিষ্কৃতি ও সুবিধাসংক্রান্ত মৌল দর্শন হয়েছে কখনো বা বিভ্রান্ত, কখনো বিকৃত ও ক্ষেত্রবিশেষে বিস্মৃত। যুগের সঙ্গে সংগতি রেখে কর নির্ধারণ ও আদায়সংক্রান্ত বিধানগুলো সহজ-সরল অর্থাৎ করদাতাবান্ধব করার পরিবর্তে ক্ষেত্রবিশেষে আরও জটিল হয়েছে এবং এ দেশের আর্থিক জীবনায়নের সংস্কৃতির সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গির সংস্কার ও সমন্বয় যেন কাক্ষিতই থেকে গেছে।
আয়কর আইনের ভাষা হবে সহজবোধ্য, জটিলতা পরিহারী এবং এর প্রয়োগ হবে স্বাচ্ছন্দ্যে সর্বজনীন ব্যবহার উপযোগী। করদাতা যেন নিজেই নিজের আয়কর ফরম পূরণ, কর নির্ধারণ এবং সরাসরি তা দাখিলে সক্ষম হন। অর্থনীতির বিভিন্ন পর্যায়ে অবস্থানরত আয়করদাতারা যেন অভিন্ন আচরণে আইনগতভাবে আয়কর দিতে স্বতঃস্ফূর্ততা বোধ করেন। কর আহরণে করদাতা ও আহরণকারীর মধ্যকার দূরত্ব যত কমে আসবে, যত বেশি করদাতা কর নেটের আওতায় আসবে, তত কর রাজস্ব আহরণে সুষম, সহনশীল ও দায়িত্ববোধের বিকাশ ঘটবে। করদাতা ও আহরণকারীর মধ্যে স্বাগত ও স্বেচ্ছাধর্মী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনজনিত এ পরিস্থিতিতে করদাতাকে তাড়া করে ফেরার স্পর্শকাতরতার অবসান ঘটবে।
তবে সবকিছুই নির্ভর করবে আয়কর আইনের ভাষা আর দৃষ্টিভঙ্গিতে কার্যকর ও কল্যাণপ্রদ পরির্বতন আনার ওপর। আর সে প্রত্যাশা পূরণে সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এ জন্য করদাতাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে ‘ট্যাক্স পেয়ারস এডুকেশন’ এবং কর প্রদানে উদ্বুদ্ধ করতে একটি সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি বিশেষভাবে গুরত্বপূর্ণ।
এই গুরুত্ব উপলব্ধি করেই ১৫ সেপ্টেম্বরকে জাতীয় আয়কর দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আয়কর রিটার্ন ফরম সহজ ও সরল করা হয়, সহজ-সরল ভাষায় আয়কর রিটার্ন ফরম পূরণ নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়, প্রতিবছর প্রতি জেলায় ও ছয়টি সিটি করপোরেশন এলাকায় পাঁচজন সেরা (তিনজন সর্বোচ্চ ও দুজন সর্বাধিক সময় ধরে কর প্রদানকারী) করদাতাকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যবস্থা চালু করা হয়। ২০০৮-এর ১৫ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো জাতীয় আয়কর দিবস পালন করা হয়। এ সময় করদাতাদের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে কর প্রদানকে উত্সাহিত করতে দেশব্যাপী প্রতিটি থানা ও জেলা সদরে স্বতঃপ্রণোদিত করদাতাদের টিআইএন প্রদান এবং ন্যূনতম পরিশোধিত কর গ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।
প্রত্যাশা সবার, কর দেয়ার ক্ষেত্রে গণসচেতনতা ও আগ্রহ সৃষ্টি হলে কর আইনের সংস্কার ও প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে জনমত তৈরি হবে। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আইনের প্রতি সৃষ্ট শ্রদ্ধাশীল পরিস্থিতিতে আইন প্রয়োগে বেগ পেতে হয় না, আর আইনের অবজ্ঞার আকাক্ষাও জাগে না।

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।


প্রধান সম্পাদক