নারী-ক্ষমতায়ন ও ভাষা ব্যবহার
নূর কামরুন নাহার:
উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে শুরু করে উন্নত বিশ্ব পর্যন্ত নারী ক্ষমতায়ন একটি বহুল আলোচিত বিষয়। বিশ্বের নীতিনির্ধারকদের কাছে যখন এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, নারীর উন্নয়ন ব্যতীত একটি বাসযোগ্য উন্নত বিশ্ব গড়া সম্ভব নয় তখনই জন্মলাভ করলো নারী ক্ষমতায়ন ধারণাটি। নারী ক্ষমতায়নের সোজাসাপ্টা অর্থ দাঁড়ায় নারীর ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করা। নারী মধ্যে তার নিজস্ব ক্ষমতার জাগরণ ঘটানো। নারীর সুপ্ত প্রতিভা এবং শক্তির আবিষ্কার এবং তা উন্নয়নের কাজে ব্যবহার। নারীর এই ক্ষমতায়ন প্রত্রিয়ার সাথে ভাষার রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। ভাষার সাথে নারীর অধস্তন অবস্থানের রয়েছে সুদূরপ্রসারী প্রভাব। ভাষা ব্যবহারের সচেতনতা এবং ভাষায় দুবল ও অবদমিত করে রাখা থেকে নারীকে ভাষার শৃ্খংল থেকে মুক্ত করার মধ্য দিয়েই ঘটতে পাওে নারী ক্ষমতায়ন। এ ধরণের প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক যে নারী ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়ার সাথে ভাষার সম্পর্ক কি? ভাষা কিভাবে নারী ক্ষমতায়ানকে প্রভাবিত করে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে বিষয়টি পরষ্পর সমন্ধযুক্ত নয় এবং ভাষা নারী ক্ষমতায়নে কোন ভূমিকা রাখে না।
নারী ক্ষমতায়নের সাথে ভাষার রয়েছে নিবিড় ও গভীর সম্পর্ক। ভাষা যে কোন দেশের এবং জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। ভাষা একটি বিশাল ও ব্যাপক বিষয়ও বটে। ভাষার উৎপত্তি, বিবর্তন ও ব্যবহারের সাথে ব্যাপক কিছু জড়িত থাকায় স্বভাবতই ভাষার ব্যবহার বিশে¬ষণ, ভাষার গতিশীলতা ও পরিবর্তনের ধারার বিষয়টি জটিল ও বহুমাত্রিক। মূলত একটি ভাষার বিকাশে জড়িয়ে থাকে একটি জাতি তথা দেশের ইতিহাস ও বিবর্তন। এ বিষয়টির আলোচনা অপ্রয়োজনীয় যে ভাষার শক্তি অমিত। ভাষা যেমন মানুষকে জাগরিত করতে পারে, তেমনি নির্মাণ করতে পারে, তেমনি ভাষা মানুষকে, তার চেতনাকে বিলুপ্ত করতে পারে এবং ধ্বংসের মাধ্যমে ধূলায় মিশিয়ে দিতে পারে। ভাষার সাদামাটা কাজ হচ্ছে মনের ভাব প্রকাশ করা অথাৎ আমরা যা বলতে চাই বা যা বুজি তা ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করি এই প্রকাশের জন্য ভাষায় ব্যবর্হত হয় কিছু সাংকেতিক চিহ্ন। ভাষার মাধ্যমে আমরা যে মনোভাব প্রকাশ করি ,কোন একটা বিষয় বা বস্তু সম্পর্কে যা বোঝাই তা আমাদের মধ্যে একধরণের চিত্রকল্প এবং প্রতিকল্প তৈরি করে। তাই এটি অনস্বীকার্য যে ভাষা আমাদের বোধ-বিবেচনা, শিক্ষায়-মননে প্রতিমূর্তি তৈরি করে। এক কথায় আমাদের বোধে যে কোন জিনিসের প্রতিচ্ছবি, প্রতিমূর্তি ভাষার মাধ্যমেই নির্মিত হয়। ভাষা যেহেতু আমাদের মনের মধ্যে, বোধের মধ্যে যেকোন বিষয়ের প্রতিবিম্ব স্থাপন করে, যে কোন বিষয়ক ধারণাকে স্পষ্ট করে অন্যভাবে আমাদের চিন্তাশক্তির মধ্যে নির্দিষ্টতা আনে তাই ভাষার দ্বারা তৈরি চিত্রকল্প বা প্রতিমূর্তি থেকে এবং তার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা স্বাভাবিক ভাবেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। নারী বিষয়ক আমাদের যে ধারণা তা আমরা আমাদের প্রত্যক্ষণ,প্রাত্যেহিক জীবনের অভিজ্ঞতা এবং ভাষার দ্বারা তৈরি ধারণা এবং প্রতিমূর্তি গ্রহণ করি। নারী বিষয়ক ধ্যান ধারণা সৃষ্টিতে তাই ভাষার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আমাদের চিন্তার ভাষা যেহেতু প্রতিমূর্তি তৈরি করে তাই নারীর একটা প্রতিমূর্তিও ভাষা আমাদের মধ্যে তৈার করে ইচ্ছে করলেই যা থেকে থেকে আমরাও বেরিয়ে আসতে পারি না।
আমরা যেমন ইতিহাসের ভাষাকে, বিজ্ঞানের ভাষা বা সাহিত্যের ভাষাকে আমাদের বোধে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে গ্রহণ করি তেমনি নারীর জন্য ব্যবহৃত ভাষাও আমাদের চেতনায় ভিন্নভাবেই প্রোথিত হয়। নারীর জন্য ব্যবর্হত যে ভাষা তার মধ্যেই আমরা নারীকে খুঁজে নেই অন্যভাবে একজন নারী এবং তার সামাজিক বিষয়াবলীকে তার জন্য ব্যবহৃত ভাষাগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমেই আমরা বোঝার চেষ্টা করি। আর একটু সহজ করে বলা যায়, ভাষা নারীকে যেভাবে নির্মাণ করে সেভাবেই নারী আমাদের চেতনায় ধরা দেয়। ভাষাই আমাদের নারী বিষয়ক ধারনা গুলো নির্দিষ্ট করে দেয়। তাই নারী বিষয়ক ধারনা অ।নেকাই তার জন্য ব্যবর্হত ভাষা নির্ভর। সুতরাং বিষয়টি অনেকটাই স্পষ্ট যে নারীর জন্য ব্যবহৃত ভাষাগুলোই আমাকে ধারনা গ্রহন করতে শেখায় নারী কি? তার বৈশিষ্ট্য কি? সে কোন ধরণের সামাজিকীকরনের মাধ্যমে সমাজে তার স্থান নির্ধারন করেছে। আর এ কারণেই ভাষা কর্তৃক নির্মিত নারী বিষয়ক ধ্যান-ধারণার মধ্যেই নারীর প্রতি বৈষম্যের মূল বিষয়টি প্রোথিত। যুগ যুগ ধরে মূলত নারী বন্দী হয়ে পড়ে আছে ভাষার ছকে। তার সত্ত্বাকে তার অস্তিত্বকে ভাষার মাধ্যমে অবদমিত ও অধস্তন করে রাখা হয়েছে। ভাষাই নারীকে পশ্চাদপদতার জালে আটকে রেখেছে। ভাষাই নারীকে উপস্থাপন করেছে দুর্বল, অসহায়, অবলা করে। নারীর জন্য ব্যবহৃত ভাষাই নারীকে ছোট করে রেখেছে, অন্তরীণ করে রেখেছে।
সমাজে নারীর জন্য প্রচলিত রয়েছে বেশ কিছু শব্দ যা নারীর ইমেজকে প্রতি মূহূর্তে ক্ষুন্ন করে চলছে। তার কয়েকটিকে আমরা একটু বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখতে পারি কিভাবে শব্দ নারীকে অবদমিত করেছে এবং তাকে অসন্মানিত করে তেদালা হয়েছে। নারীর জন্য খুব প্রচলিত কিছু শব্দ যেমন ডাইনী,শাকচুন্নী, পতিতা, এমন কিছু নেতিবাচক শব্দ রয়েছে যা শুধুমাত্র নারীর জন্য ব্যবহৃত নয় এ সকল শব্দের কোনো পুরুষবাচক শব্দ নেই। নারীর জন্য খুব প্রচলিত দু‘টি শব্দ ‘ছলনাময়ী’ ও ‘রহস্যময়ী’। যে দু‘টি শব্দের মাধ্যমে নারীকে আড়াল করা হয়েছে। আঁধারে ঢেকে রাখা হয়েছে। নারীকে চঞ্চলমতি, প্রতারক করে সমাজে তার পরিচয় বদ্ধমূল করে দেয়া হয়েছে। নারীর মনকে ঢেকে রাখা হয়েছে রহস্যের আঁধারে, অস্পষ্ট করে তোলা হয়েছে সাধারণ্যে।
আমাদের প্রবাদ প্রবচন যা বাংলা ভাষার এক অমূল্য সম্পদ এবং যা ভাষার ইহিতাস ঐতিহ্য সমাজ এবং সংস্কৃতি এবং লোকাচারকে তুলে ধরেছে তার মধ্যেও নারীর যে রুপ এবং প্রতিমূর্তি নির্মিত হয়েছে তা কোন ভাবেই নারীর জন্য সন্মানজনক নয়। এবং এসকল প্রবাদপ্রবচনে নারীকে দুর্বল, হীন ,অকমন্য, নির্ভবশীল ,কুটিল এবং কর্মহীন করে দেখানো হয়েছে যেমন- বউ জব্দ কিলে ,হলুদ জব্দ শিলে। মেয়ে মানুষ পরের ভাগ্যে খায় নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য এবং নারীর মালিকানা যে পুরুষের তাতে নারীর বলার কোনো অধিকার নেই এমন অপমানজনক বিষয়ও রয়েছে এসব প্রবাদ প্রবচনে যেমন-নাও ,ঘোড়া নারী যে চড়ে তারি। নারীর নিজের কোনো শক্তি নেই তার সকল বল ভরসা পুরুষ- ‘পুরুষের বল টাকা , নারীর বল শাখা’। সতী সাধ্বী থাকা শুধু নারীর জন্য প্রযোজ্য পুরুষের সতত্তি নিয়ে তেমন কোনো মাথা ব্যথা নেই সমাজের। নারীর সতীত্বই হলো তার আসল জিনিসÑ পিয়াজ, ধোয়া ,নষ্ট নারীÑচক্ষে আনে অশ্র“বারি। সতী নারী গঙ্গা জল ,অসৎ নারী বদ্ধ জল। ণারীর সকল অশান্তির মূলে- ভাই বড় ধন ,রক্তের বাঁধন যদিও পর হয় নারীর কারণে। মেয়ে সন্তানকে নিচু চোখে দেখে Ñকথায় কথায় কথা বাড়ে মথনে বাড়ে ঘি /বাপে পুত বাড়ায় মায়ে বাড়ায় ঝি । এভাবে নারীকে নানাভাবে দেষের মধ্যে রেখে তাকে অবদমিত করে রাখা হয়েছে।
‘‘নারী মন ঈশ্বরও বুঝতে পারে না’’ প্রচলিত এ ধরনের সস্তা কথায় নারীদের নানাভাবে হেয় ও একপেশে করে রাখা হয়েছে। প্রকৃত সত্য আসলে কি? মন তো সত্যিই এক রহস্যের আঁধার আর তা প্রতিটি মানব মনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একজন পুরুষ কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে তার চারপাশের. তার চলার পথের, অচেনা বাদই দিলাম তার অতি চেনা পুরুষ বন্ধুদের প্রত্যেকের মনের সবটুকু সে পড়তে পারে? অথবা তাদের মন কোন রহস্যের আলো-আধাঁরে খেলা করে না? খুব বিশে¬ষণ, খুব গবেষনার প্রয়োজন হবে না এ বিষয়টি খুব সাধারণ বোধেই অতি স্পষ্ট যে মানুষের মনই দুর্জ্ঞেয়, দুর্বোধ্য। অথচ শুধুমাত্র নারীর জন্য এ ধরনের ভাষা ও শব্দের ব্যবহার করে নারীর সহজাত বৈশিষ্ট্যাবলীকে গলাটিপে হত্যা করে তাকে অকারনে জটিল, অস্পষ্ট করে উপস্থাপন করে এককোনে আবদ্ধ রাখা হয়।
মুর্খ থেকে শুরু করে অতি উচ্চশিক্ষিত, নিম্নশ্রেনী থেকে শুরু করে অতি উচ্চশ্রেনী পর্যন্ত বহু ব্যবহৃত একটি ভাষা হচ্ছে ‘‘আরে, মাইয়্যা মানুষের কথা বাদ দে’’ অথবা‘‘ মেয়ে মানুষের কথা রাখতো’’। প্রায়শ ব্যবহৃত এ ধরনের ভাষায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে মেয়েদের বোধশক্তি, বৃদ্ধি বিবেচনার কোন মূল্য নেই। তাদের কথাও আবার ধরতে আছে নাকি! এই যে নারীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব এবং তাদের ভাবনা ও চিন্তাকে হালকা করে উপস্থাপন করে তাদেরকে সমাজের কাছে বিশ্বাসের অযোগ্য ও গভীরতাহীন করে তুলে ধরা তা শুধু নারীকে হেয় প্রতিপন্নই করে না, তাদের অগ্রযাত্রাকে ব্যহতই করে না, নারীর নিজের প্রতি তার বিশ্বাসকে তার মনোবলকেও ভেঙ্গে দেয়।
আমাদের চলার পথে বিভিন্ন সময় যেকোন সামান্য কারণে, সামান্য বিরক্তিতে যে সব অকথ্য গালি এবং ভাষা আমরা শুনতে পাই তার প্রায় প্রতিটিই নারী সংশি¬ষ্ট।
নারীর জন্য অপমানজনক, অবমাননাকর শব্দাবলীর উচ্চারনের মাধ্যমেই আমরা আমাদের মনের ক্ষোভ প্রকাশ করি। অশ্রাব্য ভাষায় নারীকে উপস্থাপন করি। তাই আমাদের অশ্রাব্য উচ্চারণও নারীকেন্দ্রিক তো বটেই, পুরুষ সৃষ্ট যেকোন অন্যায়ের জন্যও গালির ভাগ নারীকেই বহন করতে হয়। কি আশ্চর্য আর বিষ্ময়কর!
নারীর জন্য প্রসংসার যে ভাষা নির্মান করা হয়েছে তাতেও নারীকে দুর্বল করে রাখা হয়েছে। পুরুষের জন্য প্রশংসার ভাষা হচ্ছে, শৌর্য বীর্যের অধিকারী, উচ্চকাক্সক্ষী, অমিততেজী, বলবান ইত্যাদি আর নারীর জন্য নির্বাচিত হয়েছে, মিতভাষিনী, সুহাসিনী, ধৈর্যশীলা, পতিপরায়না ইত্যাদি। অর্থাৎ গুনী নারী ও দুর্বল। নারীর গুনগুলোই নারীকে আরও শক্তিহীন করে তোলে। এই সব গুণের ফাঁদে বন্দী করে সমাজ নারীকে নির্ভরশীল আর দুর্বল করে রাখতেই পছন্দ করে। কোন ভাবেই কোন নারীকে মাথা উঁচু করে তোলার পক্ষপাত দেখায় না।
মূলত নারীর জন্য নির্মিত ভাষার অধিকাংশ নারীকে অবমাননাকর, অপমানজনক স্থানে নিয়ে এসেছে। ভাষার নির্মিত নারীমুর্তি কোনভাবেই সম্মানজনব নয়। সমাজের সকল জায়গায়, আনাচে কানাচে ব্যবহৃত এসকল শব্দ ও ভাষা নারীকে যেমন নিম্নস্থানে নিক্ষেপ করেছে তেমনি নারীর ক্ষমতায়নের পথেও বিরাট অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। কারন যে নারীকে আমরা ক্ষমতায়ন করবো, যাকে আমরা ক্ষমতায়ন করবো, যাকে আমরা ক্ষমতার ভাগ দিবো তার অবশ্যই একটি সম্মানজনক ভাবমূর্তি থাকতে হবে। তাকে বিশ্বাস করা, তার প্রতি আস্থা রাখার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
নারীকে যদি ক্ষমতায়ন করতে হয়, নারীকে যদি একটি সম্মানজনক অবস্থান দিতে হয়, যদি তাদের প্রতিভার বিকাশ ঘাটাতে হয় সর্বোপরি একজিন নারীর সমাজকে দেবার যে ক্ষমতা তার যদি পূর্নব্যবহার করতে হয় তবে অবশ্যই নারীর জন্য এই সমস্ত অবমাননানকর ভাষার ব্যবহার বদলাতে হবে। ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে নারীর জন্য একটি যথাযথ সামাজিক অবস্থা তৈরি করতে হবে। নারী ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত ও বাস্তবে রুপ দিতে ভাষা ব্যবহারও একটি গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা রাখবের্। আমাদের বোধে প্রোথিত হওয়া নারীর নিকৃষ্টতর রুপটি ভেঙে ফেলার জন্য ভাষার বদল প্রয়োজন, আর বদলে যাওয়া ভাষাতেই নারী তার যথাযথ মূল্যায়নে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারবে। তাই এই ভাষার পরিবর্তন ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ,ততই মঙ্গল।