যাঁরা আমাদের সত্যিকারের বড় হতে শেখায়–
সুমন্ত আসলামঃ
ষাটের কাছাকাছি বয়সের মানুষটাকে ঠিক রিকশাওয়ালা মনে হয় না আমার।
আজ হরতাল, আমার সদ্য পাঁচ পেরুনো মেয়েটা আবদার ধরেছে, ‘বাবান, হরতাল দেখব।’ সকালে তাই ওকে নিয়ে বের হয়েছি হরতাল দেখাতে। হরতাল দেখা শেষে (!) মিরপুর ১১ নম্বর বাসস্ট্যান্ড থেকে রূপনগর মোড়ে আসব, মানুষটি এগিয়ে এলেন তার বাহন নিয়ে, ভাড়া ২০ টাকা।
কিছুদূর আসার পর ডান দিক দিয়ে, মিল্ক ভিটা রোড হয়ে একটা রাস্তা গেছে রূপনগরে যাওয়ার; আরেকটা গেছে বাম দিক দিয়ে, প্রশিকা বিল্ডিংয়ের সামনে দিয়ে ঢাকা কমার্স কলেজের রাস্তা হয়ে। বাম দিক দিয়ে রাস্তা একটু বেশী, ভাড়া ২৫ টাকা। মানুষটি ডান দিক দিয়ে না গিয়ে বাম দিক দিয়ে যেতে লাগলেন রূপনগরের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে আমি বললাম, ‘এদিক দিয়ে যােেচ্ছন কেন, আংকেল!’ রিকশাটা শ্লো করলেন মানুষটি। মাথাটা আমার দিকে একটু কাত করে তিনি বললেন, ‘ওইদিকে হরতালের অনেক লোকজন দেখলাম, ওইদিকে রাস্তাঘাটও অনেক ভাঙা-চুরা। এত লোক দেখলে আপনার ছোট মাইয়াডা ভয় পাইতে পারে, ভাঙা রাস্তা দিয়া যাইতে কষ্টও হইব তার।’
মাথাটা ঝিম মেরে গেল হঠাৎ। গন্তব্যে পৌঁছে মানুষটার দিকে ২৫ টাকা বাড়িয়ে দিলাম। উনি ওখান থেকে ২০ টাকার নোটটি নিয়ে বললেন, ‘ভাড়া তো ২০ টাকা ঠিক হইছে।’ কিছু না বলে আমি কিছুটা জোর করে ৫ টাকার নোটটা হাতে গুজে দিলাম তাঁর। অদ্ভুতভাবে হাসলেন তিনি, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আমার মেয়েটার।
ঝিম মেরে যাই আমি আরো। একটা অপরিচিত শিশুর জন্য, অচেনা একটা বাচ্চার জন্য, রক্ত-সম্পর্কহীন কারো জন্য একটা মানুষের মমতা দেখে চোখ ভিজে ওঠে আমার। আমরা কজনই এভাবে শিশুদের, বাচ্চাদের ভালোবাসতে পারি, ভালোবাসি, বুকে মমতা জাগে আমাদের?
বাবা বেঁচে নেই আমার। ওই মানুষটাকে আমার রিকশাওয়ালা মনে হয় না। নাতনীর মাথায় হাত বুলানো ভালোবাসায় ভরা এক দাদু মনে হয়! চিরকালীন বাচ্চা-ভালোবাসা দাদু!