নেপাল ভ্রমণঃ অন্যরকম জীবন দর্শন
উদয় হাকিম: একটু আগেই দেখে এসেছি সেই অপূর্ব মহিমা। অন্নপূর্ণা, ধবলাগীরি। দেখেছি দিনের প্রথম সূর্যের আলোয় কীভাবে সোনারঙা আগুন জ্বলে পাহাড়ের চূড়ায়। দেখেছি অবর্ণনীয় সেই সৌন্দর্য্য। সবাই ক্লান্ত। হোটেলে এসে গোসল। নাস্তা সেরেই উঠে গেলাম বাসে। সকাল ৭টায় বাস ছাড়লো। পোখারা থেকে কাঠমান্ডু। আমরা পোখারাতে ছিলাম ফেউয়া লেকের পাশে। এপাশ থেকে হিমালয়ের মাছের পুচ্ছ বা ফিস টেল দেখা যায় না। তাই দু’দিন পোখারাতে থাকলেও এর আসল সৌন্দর্যই দেখা হয়ে উঠেনি। যা শহরের উত্তরে, বরফে ঢাকা হিমালয়। মিনিট দশেকের মধ্যেই শহর পার হলাম। হঠাৎ উত্তরে তাকিয়ে সবাই অবাক। একটু আগে যে অন্নপূর্ণা, ধবলাগীরি দেখার জন্য পাহাড় বাইলাম, সেই হিমালয় কিনা রাস্তার ধারে! মহাসড়ক থেকে কিলো দুই অথবা আরেকটু বেশি হবে আকাশ ছোঁয়া হিমালয়। কিন্তু মনে হয় হাতের কাছেই। ধবলাগীরি সবার পশ্চিমে। সেখান থেকে পূর্ব দিকে চলে গেছে হিমালয়। হিমালয়ের এ অংশকেই বলা হয় ফিশ টেল। পশ্চিম দিকটা মাছের মাথার মতো। পূবে লেজ। যতদূর চোখ যায় কেবল বরফে সাদা। সাদা পাহাড়। তার উপর সূর্যের আলো। চকচক করছে। ছড়াচ্ছে বিকিরণ। হিমালয় থেকে নেমে এসেছে ছোট, বড় ঝর্ণা। কোনোটা বড় খালের মতো। কোনোটা নদীর মতো। পানি অতি স্বচ্ছ। দেখলেই মনে হয় স্বর্গীয় সুধা। পান করতে ইচ্ছে করে। এ ট্যুরে আমরা ২২ জন। করপোরেট ক্রিকেট লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো ওয়ালটন। সেই সৌজন্যে নেপাল ভ্রমণের সুযোগ। সবাই যখন মগ্ন অপরূপা হিমালয়ের রূপ দর্শনে, তখন ঘটলো আরেক বিপত্তি। লিটন নামে টিমের এক সহকারী ম্যানেজার বলছে গাড়ি থামাতে। ইমার্জেন্সি! বাসের সবাই এক সঙ্গে হাঁসছে। ওদিকে লিটনের অবস্থা টাইট। সবাই হাঁসছে কেন? কিছুক্ষণ আগেই ফিরোজ আলম বলছিলো, আর কারো জন্য না হলেও লিটনের জন্য বাস থামতেই হবে। মিনিট পাঁচেক পরেই সেটা ঘটে গেলো বাস্তবে। একটা তেলের পাম্পের সামনে গাড়ি থামলো। দু‘একজন নামলো। অন্যরা গাড়িতেই। বাইরে ঠাণ্ডা। রাস্তায় গাড়ি অল্প। মোটর সাইকেল বেশি। রাস্তার পাশ দিয়ে কিছুটা দূরত্ব রেখে বাড়িঘর। পতিত জমিই বেশি। এমন জায়গায় বাড়ি যাদের, তারাইতো তো স্বর্গবাসী! প্রায় ঘণ্টাখানেক বাস চলছে। কিন্তু পাহাড় শেষ হচ্ছে না। যতই যাচ্ছি, হিমালয়ও যেন আমাদের সাথেই চলছে। একসময় বরফের রূপালি পাহাড় পূব দিকে রেখে, আমাদের পথ গেল দক্ষিণে বেঁকে। অনেক দূর পর্যন্ত ঘাঁড় বাঁকিয়ে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। জানি না, জীবনে আর এমন দৃশ্য দেখা হবে কি না। বরফের উপর আলো পড়লে সে আলো যেন অন্য আলো হয়ে উঠে। যতদূর থেকেই দেখুন না কেন- সে আলো চোখে পড়বেই। পাহাড়, পাহাড়ি গাছ-গাছালির ফাঁক গলে দৃষ্টি এড়ায় না সে আলো।
পোখারা থেকে প্রায় ৩০ কিলো এসে দক্ষিণে মোড় নিয়েছি। বা পাশে পাহাড়, টিলা। ডান পাশে একটা নদী। নদীর উপর ঘন কুয়াশার আস্তর। ওপারে সারি সারি গাছ। এমন প্রকৃতি শুধু মনের জন্য নয়, চোখের জন্যও সুখকর। কিন্তু নদীতে পানি নেই! মে মাসের দিকে বরফ গলা শুরু হলে তখন এখানে পানি জমে। দ্রুত নামতে থাকে দক্ষিণ-পূর্বে। ভাটিতে। অক্টোবরে শুকিয়ে যায়। বিমান থেকে দেখলে মন হয় সাদা মাটির নদী। ঘণ্টা দুয়েক পর চোখে পড়লো সরষে ক্ষেত। সবজি বাগান। পাহাড়ের ঢালে, খাদে ছোট ছোট বাড়ি-ঘর। উঁচু পাহাড়গুলোর ভাঁজে খাঁজে সুদৃশ্য বনানী। মনে হয় গাছগুলো প্রাকৃতিক চিরুনী দিয়ে আঁচড়ানো। ফসলী জমিগুলোতেও ফলন কম। কারণ পাথুরে মাটি। পানি দেখা গেলো নদীতে। নদীর নাম গোমতী খোলা। কাঠমান্ডু থেকে পোখারা আসার পথেও দেখেছিলাম অসংখ্য সাইনবোর্ডে খোলা লেখাটা আছে। পরে জানলাম নদী বা খালকে নেপালিরা খোলা বলে। বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকায় যাকে ছড়া বা ঝিরি বলে। তবে আমাদের ছড়ার চেয়ে ওদের খোলা একটু বড়। বাংলাদেশের মতোই ওখানে যে কয়টা নদী আছে, সেগুলোর নামও সুন্দর। গোমতী খোলার পানি স্বচ্ছ। মাছ নেই। কেন নেই? গাইড বিপিন জানালেন, জল অনেক ঠাণ্ডা। তাই মাছ থাকে না। পশ্চিমে খানিকটা মোড় নিয়ে রাস্তা আবার বাঁক নিলো দক্ষিণে। বান্দিপুর খোলা ছাড়া ড্যাম। নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে। সেনাবাহিনী পাহারা দিচ্ছে। বিপিন জানালেন, বিদ্যুৎ ঘাটতিতে নেপাল বিশ্বের শীর্ষস্থানীয়। তারপরও এখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ নাকি ভারতে চলে যায়! এজন্যই দেখছি প্রায় সব বাড়িতেই সৌর বিদ্যুতের প্যানেল। আমরা যে হোটেলে ছিলাম তার ছাদ জুড়েও ছিল সোলার প্যানেল। এবার চলছি পূব দিকে। পোখারা থেকে ১০০ কিলোমিটার এসেছি। এই এলাকার নাম ল্যামজাং মাউন্টেইন। এই পাহাড়ের যত উপরে যাওয়া যায় ততোই ঠাণ্ডা। এখানে মিলল খানি খোলা। এটা বড় নদী। যদিও জলধারা ক্ষীণ। ক্রমশ ভাটিতে নদীটি প্রস্থে বেড়েছে। দু’পাশে সুউচ্চ পাহাড়। নদীর বুকে ছোট-বড় একেক কালারের পাথর। অদ্ভূত সুন্দর পাথুরে নদী। নাম ত্রিশুলি। এটি নেপালের অন্যতম প্রধান নদী। পশ্চিম দিক থেকে আরেকটা বড় নদী এসে মিশেছে এখানে। রাস্তার উপর বড় ব্রিজ। নাম ত্রিশুলি ব্রিজ। আমরা বাস থেকে নামলাম। ছবি তুললাম। এই পথেই রাতের বেলা গিয়েছিলাম পোখারায়। কিন্তু অন্ধকার ছিলো বলে দেখতে পারিনি এসব কিছুই। রাতের এই নদীর স্রোতের শব্দ শুনেছিলাম। আমি কোচ জাহিদ সাহেবকে ডেকে নিয়ে নদীর ধারে শিশ দিয়েছিলাম। তখন বুঝিনি নদীটা খরস্রোতা ছিলো এতো। তবে চাঁদের হালকা আলোয় দেখেছিলাম রূপালি জলের ধারা। কাঠমান্ডু আর পোখারার প্রায় মাঝামাঝি এলাকায় কারিনতার। এখানেই নেপালের একমাত্র কেবল কার স্টেশন। ৩.১ কিলোমিটার লম্বা। ৩০০ মিটার উঁচু। নদী পার হয়ে যেতে হয় সেখানে। আমাদের হাতে অতো সময় নেই। তাই যাওয়া হলো না। এই এলাকাতেই মনোকামনা মন্দির। এই মন্দিরে যে কামনা বা বাসনাই করা হোক তাই নাকি ফলে। ডিসকোভারি চ্যানেলে এই মন্দির নিয়ে একটি অনুষ্ঠান দেখেছিলাম। যদিও এসব বিশ্বাস করি না আমি। কিন্তু বিশাল সংখ্যক বিশ্বাসীতো অবশ্যই আছে। এটা এই উপমহাদেশের একটা কমন সিনারিও। মনোকামনা মন্দিরে যাওয়ার পথে গাড়ি থামলো। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। খিদে লেগেছে। গেলাম একটা রেস্টুরেন্টে। কিন্তু খাবার পছন্দ হলো না। লম্বা সাদা চালের ভাত আছে। কিন্তু তরকারি পছন্দ হচ্ছে না। তাই খাওয়া হলো না। রাস্তার ধারেই দেখলাম চমৎকার কমলা বিক্রি হচ্ছে। নেপালি রূপিতে ১০০ টাকা কেজি। পাঁচ কেজি কিনলাম, ঢাকায় নেয়ার জন্য। আরো দুই কেজি তখন খাওয়ার জন্য। কাঠমান্ডুর কাছাকাছি জেলা ধাজিং। নেপালে সমতল ভূমি প্রায় নেই বললেই চলে। তার মধ্যে এই ধাজিং হচ্ছে অপেক্ষাকৃত সমতল। যে কারণে এখানে ফসল ফলে বেশি। বিপিন বাবু জানালেন, কাঠমান্ডু শহরের সবজি এবং খাবার সরবরাহ হয় এখান থেকেই। মহাসড়ক ধরেই ত্রিশুলি রিভার। এটি পার হওয়ার জন্য কিছু রজ্জুপথ দেখলাম। আছে রশি টেনে বা রশিতে বেয়ে রাস্তা পারের ব্যবস্থাও। কাঠমান্ডু শহরের পশ্চিমে বিশাল পাহাড়। পোখারা যাওয়ার পথেও দেখেছিলাম এটা। এই পাহাড়ে উঠতেই প্রায় ঘণ্টাখানেক লেগে গেলো। খুব রিস্কি রাস্তা। নিচের দিকে তাকালে মানুষ কিম্বা ছোট যানবাহন পিঁপড়ের মতো দেখায়। একটু এদিক সেদিক হলেই এক কিলোমিটার নিচে। বাঁচার প্রশ্ন অবান্তর। বিপিন জানালেন, এখান থেকে গাড়ি নিচে পড়ে গলে কিছুই পাওয়া যায় না। তাই উদ্ধারের চেষ্টাও করা হয় না। একদিকে পেটে অসহ্য খিদের জ্বালা। অন্যদিকে দুর্ঘটনার ভয়। সবমিলিয়ে খুব খারাপ অবস্থা। কারো মুখে রা নেই। কিন্তু পাহাড়ের উপরে উঠে দেখলাম পুরো কাঠমান্ডু শহর। পশ্চিমে শুধু পাহাড় আর পর্বত। হোটেলে লাঞ্চের ব্যবস্থা ছিলো। সূর্য ডোবার পর সেই লাঞ্চ হলো! শরীরে আর শক্তি নেই। তারপরও একবার বেরুতে হবে শহরটা দেখতে। কিন্তু মিনিট দশেক বিশ্রাম না নিলেই নয়।
পোখারা থেকে কাঠমান্ডুর এই রাস্তাকে অনেকটা মানুষের জীবনের সঙ্গে তুলনা করা যায়। জীবনে যেমন ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎড়াই থাকে; আছে এখানেও। আছে দিগন্ত বিস্তৃত হিমালয়, আছে নদী, বন, সমতল, ফসলের মাঠ। আছে পাথুরে পাহাড়, ফুলের ঘ্রাণ। সহজিয়া মেঠোপথ, কঠিনতম দুর্ঘটনাপ্রবণ রাস্তা। খোলা দিগন্ত, দৃষ্টি ছাওয়া পাহাড় সবই আছে। তাই বলা চলে, সড়ক পথে পোখারা থেকে কাঠমান্ডু আসা মানেই জীবনের বড় একটি চক্র নিজ চোখে দেখে নেয়া। জীবনের মানে তো ভ্রমণেই! জীবনের মানেই হলো দেখা। দু‘চোখ ভরে দেখা। হৃদয় দিয়ে উপভোগ করা।
[লেখক: উদয় হাকিম,সাংবাদিক।।
নেপাল থেকে ফিরে, ৩ জানুয়ারি’১৪]