হিন্দুরাই বার বার মার খাবে কেন?
শওগাত আলী সাগর: সোমবার বিকেলে গণভবনের সবুজচত্বরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । তৃতীয়বারের মতো নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার খোস মেজাজ নিয়েই জনাকীর্ন সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী যখন জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অব্যাহত থাকার ঘোষনা দেন, তখনো দিনাজপুর, যশোর, সাতক্ষীরা ও ঠাকুরগাঁওয়ের অসংখ্য হিন্দু প্রাণের ভয়ে লকিয়ে আছেন নানা আশ্রমে। কেউ কেউ পালিয়ে রয়েছেন অন্য গ্রামে। তার আগের দিন মানে রোববার রাত থেকেই তাদের ওপর হামলা শুরু হয়েছিলো। দেমের কয়েকটি অঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ী ঘরে জামাত- শিবিরের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হামলা, লুটপাট,ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ততক্ষনে প্রধানমন্ত্রীর কানে পৌছেঁ যাবার কথা।
কিন্তু নির্বাচনোত্তর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার পুরো বক্তব্য শোনার পরও ঠিক ঠাহর করা যায়নি তিনি আসলে ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কীনা । “জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ”অব্যাহত থাকার ঘোষনার সাথে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দুদের উপর পরিচালিত বিভৎস নির্যাতনের ব্যাপারে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের হাল নাগাদ তথ্য থাকলে হয়তো এ ব্যাপারে একটা স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছা যেতো। দীর্ঘ সংবাদ সম্মেলনে ঘটনাটার উল্লেখ পর্যন্ত না থাকায় একটা সংশয় তৈরি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কি ঘটনা সম্পর্কে অবহিত নন ? নাকি তিনি এটাকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে করছেন না! হিন্দুদের ওপর হামলাকারীদের বিরুদ্ধে নেওয়া সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের তথ্য সংবাদ সম্মেলনে দিয়ে ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের’ ঘোষনা দিলে হয়তো সেটি ভিন্নমাত্রা পেতো।
বাস্তবে আমরা সে ধরনের কোনো কিছু পাইনি। আসলে কখনোই পাই না। সত্যি বলতে কি, হিন্দুদের, বৌদ্ধদের উপর বারে বারে যে হামলা হয়, নির্যাতন হয়, সে ব্যাপারে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের, সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সত্যিকারের দৃষ্টিভঙ্গি কি – তা কিন্তু জাতিরা সামনে পরিষ্কার নয়। রাজনীতির কথা যদি বলি, তা হলে হিন্দুদের ব্যাপারে, অন্যান্য ধর্মালম্বীদের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার দৃষ্টি ভঙ্গি স্বচ্ছ এবং দৃশ্যমান। কিন্তু রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আর বাস্তবের দৃস্টিভঙ্গির মধ্যে ভিন্নতা থাকলেই বার বার আক্রান্ত হয়েও একটা সম্প্রদায় কোনো প্রতিকার পায় না।
হিন্দুরা, বৌদ্ধরাই এই দেশে বার বার লাঞ্চিত হবে কেন ? কেন কেবল তাদের বাড়ী ঘরই আগুনে পুড়বে, নির্যাতিত হবে তাদের নারী,পুরুষ আর শিশু! আওয়ামী লীগ ভোটে হেরে গেলে হিন্দুদের বাড়ীতে আগুন দেওয়া হয়,আওয়ামী লীগ ভোটে জিতলে হিন্দুদের বাড়ীঘর ভাঙা হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে হিন্দুদের, বৌদ্ধদের উপাসনালয়ে হামলা হয়। তাদের নারী পুরুষরা নির্যাতনের শিকার হন ! বাংলাদেশ নামের এই দেশটার রাজনীতি, গনতন্ত্র আর যুদ্ধাপরাধের বিচার না হওয়ার জাতিগত পাপের স্খলন – সবকিছুর জন্যই কেবল হিন্দুদের মূল্য দিতে হবে কেন?
পাঠকদের কাছে ব্যক্তিগত একটা ব্যাখ্যা দিয়ে নেই। এই লেখায় অত্যন্ত সচেতনভাবে আমি ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি ব্যবহার করা থেকে বিরত থেকেছি। আমি বন্ধুবর জয়ন্ত বণিকের সাথে সম্পূর্ণই একমত যে, বাংলাদেশে হিন্দুরা,বৌদ্ধরা, খ্রীষ্টানরা সংখ্যালঘু নন। মুসলমানদের মতো্ই তারা ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষমাত্র। একদা সাংবাদিকতা করা জয়ন্ত বণিকের কথাকে আমিও বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু আসলে যুদ্ধাপরাধীরা, স্বাধীনতা বিরোধীরা। বাকীরা বাঙালী, যাদের ধর্মীয় পরিচয় হয়তো ভিন্ন ভিন্ন। এর আগে যুদ্ধাপরাধের মামলায় দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর রায় ঘোষনার পরও হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের বিভীষিকা নেমে এসেছিলো। ক্ষমতায় থাকা ‘হিন্দুদের বন্ধু সরকার’ কি তার কোনো বিধান করেছে? না করে থাকলে কেন নয়? রাজনীতির হিসাব নিকাশ বাদ দিলেও, কেবলমাত্র আইন শৃংখলা পরিস্থিতির প্রশ্নেও তো তার একটা বিহিত হওয়ার কথা!
পত্রিকার খবরে পড়েছি, যশোরের হিন্দুরা ঘটনার আভাস পেয়ে প্রশাসনের কাছে,আওয়ামী লীগের কাছে সহায়তা চেয়েছিলো। কিন্তু কেউ যথাসময়ে এগিয়ে আসেনি। এটি অত্যন্ত মারাত্মক অভিযোগ। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য যেমন, সরকারের জন্যও তেমন। টরন্টোর মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু মনিরুল ইসলাম বলেন, যেখানে হিন্দুরা মার খায়, নির্যাতিত হয়, সেখানে কিন্তু ভোটে আওয়ামী লীগই জেতে, সেখানে আওয়ামী লীগের সাংসদ আছেন। সেটি সাতক্ষীরা হউক, আর যশোরই হউক। সাতক্ষীরায় একজন মন্ত্রী ছিলেন, সেখানে হিন্দুরা নির্যাতিত হয়েছে, যশোরে আওয়ামী লগেরই এমপি আছেন, সেখানেও হিন্দুরা নির্যাতিত হচ্ছে। হিন্দুরা আওয়ামী লীগকে ভোট দেয় ঠিকই, দু:সময়ে কোনো সহায়তা পায়না। যশোরের হিন্দুদের রক্ষায় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ কেন নিলো না, সে ব্যাপারে কি এই সরকার কোনো তদন্ত করবে?
কেউ হয়তো বলতে পারেন, আমি কেবল সরকারের সমালোচনা করছি, জামাত শিবিরের সমালোচনা করছি না। জামাত শিবিরের আসলে সমালোচনা করার কিছু নেই। তারা তো অপরাধী,সন্ত্রাসী। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটা জরুরী। সমালোচনা- নিন্দা তো অক্ষমের আহাজারি। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ,ফেসবুকে, ব্লগে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বন্ধুরা রাগে ক্ষোভে ফুসছেন, তাদের রাগ যতোটা না সরকারের প্রতি তার চেয়ে অনেক বেশি জামাত শিবিরের প্রতি। তাতে কি তাদের নিরাপত্তা বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কেও দেখলাম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, হিন্দুদের ওপর জামাতহ শিবিরের হামলার নিন্দা করেছেন তিনি। সজীব ওয়াজেদ জয় নিন্দা না করে যদি কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার তথ্য জানাতেন,তাহলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা হয়তো সাহস পেতো, তাদের মধ্যে আস্থার ভাব তৈরি হতো। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে, কেবল সমালোচনা আর কথামালার ফুলঝুড়িতে নিন্দার মালা গাঁথার মধ্যে রাজনীতি হয়তো হয়, হিন্দুদের,বৌদ্ধদের, খ্রীষ্টানদের নিরাপত্তাহীনতার আতংক কাটে না।
জয়ন্ত বণিক বলছিলেন, এই যে হিন্দুরা মার খাচ্ছে, মার খেয়ে খেয়ে পালাচ্ছে , তারা যদি দাঁড়িয়ে যায় ! চট্টগ্রামের কোথায় যেন হিন্দু তরুনরা সংঘটিত হয়ে দাড়িয়ে গিয়েছিলো, রাত জেগে পাহাড়া দিয়ে রক্ষা করেছে নিজেদের মহল্লা। সাঈদীর রায়ের পরের ঘটনাইতো সেটা। জায়গায় জায়গায় হিন্দুরা যদি দাড়িয়ে যায়, পাল্টা মারতে শুরু করে ? তখন কি হবে? আশংকা একটা আছে,আইন শৃংখলা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। সরকারের জন্যই বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হবে। কিন্তু ‘ হিন্দুরা কেবল মার খেয়ে যাবে, মার খেয়ে ৭১ এর শরণার্থীর মতো সারিবদ্ধ হয়ে আশ্রয়ের জন্য ছুটে যাবে, সংবাদপত্রে সেই ছবি দেখে আমরা আহ! উহ! করবো,আর রাজনীতির মাঠ গরম করবো’ – সব সময়ই এটাই কাহিনী বিন্যাস থাকবে- তা ভাবছি কেন?
নির্বাচনোত্তর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসবাদের প্রতি জিরো টলারেন্সের কথা বলেছেন। যশোরে,ঠাকুরগাও,দিনাজপুরে হিন্দুদের ওপর হামলাকারীদের দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষনার বাস্তবায়ন শুরু হউক। মাসের পর মাস ধরে জামা-শিবিরের সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাস চলছে। সন্ত্রাস মোকোবেলায় সরকারকে কেমন যেন অসহায় মনে হচ্ছে। জনগন কিন্তু সরকারকে শক্তিশালী হিসেবেই দেখতে চায়, সরকারের যে অস্তিত্ব আছে, সরকার যে ক্রিয়াশীল সেটি তার ব্যক্তিজীবন দিয়ে অনুভব করতে চায়। অতীতে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের কোনো সুরাহা হয়নি- কেবল এই অজুহাতে এই ঘটনা এড়িয়ে যাবার সুযোগ নাই। দেশের মানুষ সরকারের অস্তিত্ব টের পেতে চায় । হিন্দুদের ওপন নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মধ্য দিয়েই আমরা সরকারের অস্তিত্ব টের পেতে চাই।
[শওগাত আলী সাগর; টরন্টো থেকে প্রকাশিত নতুনদেশ ডটকম এর প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক]