অটিজমঃ এক অজানা কষ্টের নাম!

অটিজমঃ এক অজানা কষ্টের নাম!

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ:


ভূমিকাঃ “এক অজানা কষ্টের নাম ‘অটিজম”। কেন, কখন,কি কারণে মস্তিষ্কের কোন স্নায়ুকোষের কি ধরনের বিপর্যয়ের কারণে অটিজম হয় তা আমরা আজও জানি না। তাই অটিস্টিকদের ভেতরের কষ্টটা আমরা বুঝতে পারি না। তাদের এই অজানা কষ্টের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্যই ‘নীল বাতি’ প্রজ্জ্বলন করা জরুরি” বলে মনে করেন গ্লোবাল অটিজম বাংলাদেশ-এর নির্বাহী পরিচালক নিউরোলজিস্ট ডা. মাজহারুল মান্নান। অটিজম সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২ এপ্রিল (বুধবার) বিশ্ব অটিজম দিবসে সারা বিশ্বের সব গুরুত্বপূর্ণ ভবনে ও স্থাপনায় সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত জ্বলবে নীল বাতি। সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ সচিবালয়, সংসদ ভবন, প্রশাসনিক ভবন, হাসপাতাল, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ সম্ভাব্য স্থানগুলোতে নীল বাতি জ্বালানোর জন্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়েও প্রশাসনিক ভবনগুলোতে নীল বাতি প্রজ্জ্বলনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং এর সদস্য রাষ্ট্রসমূহ নিজ নিজ দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভবন, স্থাপনা, প্রশাসনিক কেন্দ্র, হোটেল, মার্কেট, দোকান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়,ব্যাংক, পত্রিকা অফিস, রেডিও ও টেলিভিশন ভবন,পার্কসহ বিভিন্ন স্থানে সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত নীল বাতি জ্বালাবে। এছাড়া হোটেল, মার্কেট, দোকান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক, পত্রিকা অফিস, রেডিও ও টেলিভিশন ভবন পার্কসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান এবং বেসরকারি সংগঠনগুলোকেও তাদের কার্যালয়ে ২ এপ্রিল সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত নীলবাতি জ্বালানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।

অটিজম কীঃ অটিজম শব্দটি সত্যি বলতে এখনো সবার কাছে তেমন পরিচিত নয়। ‌তরুন প্রজন্মের কেউ কেউ অটিজম শব্দটির সাথে পরিচিত ,কিন্তু সেটা হয়তো হুমায়ুন আহমেদের “কে কথা কয়” কিংবা মার্ক হ্যাডনের “দ্যা কিউরিয়াস ইনসিডেন্ট অফ দ্যা ডগ ইন নাইট টাইম” বই থেকে। এছাড়া কিছু হলিউডের মুভিতেও অটিস্টিক [অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তি] মানুষের গল্প দেখানো হয়েছে। কিন্তু এইসব গল্প বা মুভি থেকে অটিজম সম্পর্কে আংশিক,প্রকৃতপক্ষে বেশ ভুল ধারণাই পাওয়া যায়।
অনেকেই ভাবে থাকেন অটিস্টিক মানেই কিছু অত্যন্ত প্রতিভাবান, মেধাবী মানুষ যারা একটু বেশীই অন্তরমুখী হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বেশীরভাগ অটিস্টিক শিশুর intellectual disability বা বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা থাকে। ২০-৩০% অটিস্টিক শিশুর এই অক্ষমতা থাকেনা; যাদের অটিজমকে high-functioning autism বা অ্যাসপারগার সিনড্রোম বলা হয়। পরে “শিশুর অটিজম: তথ্য ও ব্যবহারিক সহায়তা” থেকে অটিজম এবং অটিস্টিক এর ধারণা পাওয়া গেল। গবেষণার কিছু অংশ তুলে দেয়া হলোঃ

“আমাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন ছবি তুলতে গেলে অস্বস্তিতে ভোগেন, স্বাভাবিক মুখভঙ্গিটা ধরে রাখতে কষ্ট হয়, যাদেরকে আমরা বলি ক্যামেরা-শাই। অ্যাকাডেমিক ও পেশাগতভাবে অত্যন্ত সফল কারো হয়তো জমায়েতে অনেকের সামনে কথা বলতে বা বক্তৃতা দিতে গলা বুজে আসে, হাত-পা কাঁপে। আমাদের শিক্ষকদেরও কেউ কেউ আছেন বহু বছর শিক্ষকতা করার পরও ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে লেকচার দিতে পারেননা। ভীড়ের মধ্যে পূর্ব-পরিচিত কাউকে দেখলে এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করলেও পারেন না কেউ কেউ। অদ্ভুত কিছু ভীতি বা ফোবিয়া আছে কারো কারো। ছোটবেলার স্কুলজীবনের কথা ভাবুন তো। স্পোর্টসের মাঠে হুইসেল শোনার সঙ্গে সঙ্গে সবাই একসঙ্গে ছিটকে বেরুতে পারে না, দৌড়ের শুরুতেই কেউ কেউ দেরী করে ফেলে। ক্লাসে সবার পেন্সিল বা কলম ধরার ভঙ্গি একরকম না; অল্পতেই হাত ব্যথা হয়ে যায় কারো কারো, তরতরিয়ে পাতার পর পাতা লিখতে পারেনা সবাই। দৈনন্দিন জীবনে খুঁটিনাটি সূক্ষ্ম কাজে সবার হাত-আঙ্গুল সমান পারদর্শী না; ছোট সরু স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে স্ক্রু বসানো বা খোলার কাজটি একাধিকবার চেষ্টার পর তবেই ঠিকভাবে করতে পারেন, এমন আছেন অনেকেই। সহজ কোন কথা সহজে প্রকাশ করতে বা বোঝাতে ঠিক স্বচ্ছন্দ নন কেউ কেউ। পরিস্থিতি অনুযায়ী আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খান কেউ কেউ। এইসব ছোটখাট অসঙ্গতি বা স্বল্পমাত্রার অক্ষমতাকে সাধারণ ধারণায় আমরা স্বাভাবিক বলেই ধরেই নিই। অর্থাৎ পরম স্বাভাবিক আচরণ থেকে কিছুটা বিচ্যুতি গ্রহণযোগ্য। কিন্তু সমস্যা হয় তখনই, যখন এইসব অস্বাভাবিকতার এক বা একাধিক রূপ একই ব্যক্তির মধ্যে গ্রহণযোগ্যতার সীমা ছাড়িয়ে প্রকটভাবে দেখা যায়। মনে রাখতে হবে, আলোচ্যক্ষেত্রে স্বাভাবিক কার্যক্রম/আচরণ থেকে উচ্চমাত্রার বিচ্যুতির জন্য দায়ী disability বা অক্ষমতাগুলো “প্রকাশ্য” নয়। যেমন, দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক হওয়া সত্ত্বেও দৃষ্টি-সংযোগ বা আই কন্ট্যাক্টে অক্ষমতা। কিংবা বাকশক্তি স্বাভাবিক হওয়া সত্ত্বেও কোন কথা স্বচ্ছন্দে বুঝিয়ে বলতে না পারা। এই hidden disability কোন সুনির্দিষ্ট অক্ষমতা নয়; এর সীমা বা আওতা (range) বিশাল; যা বোঝাতে ASD (Autism Spectrum Disorder) টার্মটি ব্যবহার করা হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক ও আচরণগত সীমাবদ্ধতার বিশেষ কিছু লক্ষণের সামষ্টিক নাম অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার (ASD)কথাবার্তায় পিছিয়ে থাকা, আত্মমগ্ন থাকা, অসংলগ্ন আচরণ করা- অটিজমের কিছু সাধারণ লক্ষণ যেগুলো শিশুর ২/৩ বছর বয়স থেকে দেখা দিতে পারে।”

অটিজমের লক্ষণঃ অটিজম শিশুদের লক্ষণ তিন বছরের মধ্যে শুরু হয়ে যায়। উল্লেখযোগ্য লক্ষণগুলো আলোচনা করা হলোঃ

*আটিজম শিশুরা কারও সঙ্গে কথা বলার সময় বক্তার চোখের দিকে চোখ রেখে কথা বলতে পারে না। তবে কথা ঠিকই শুনতে পায়।

*আটিজম শিশুরা প্রশ্ন করলে বা কোনো কিছু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে মনোযোগ দিতে পারে না এবং কথাও বলতে চায় না, যাকে বলা হয় ‘নন স্পিচ বিহেভিয়ার’।

*অটিজম শিশুদের সামনে কোনো কিছু ধরলে বা ডানে-বাঁয়ে নিলে চোখের দৃষ্টি ওইদিকে আকর্ষিত হয় না;অর্থাৎ মনোযোগ দেয় না। আটিজম শিশুরা অন্য শিশুদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারে না এবং আগ্রহ প্রকাশ করে না।

*একই বয়সের স্বাভাবিক শিশু মা বা কেউ ব্যথা পেলে যেমন বলে ওঠে ‘ব্যথা পেয়েছ?’ অথবা ‘কী হলো দেখি’ ইত্যাদি সিমপ্যাথি প্রকাশ করে থাকে; কিন্তু অটিজম শিশুরা সেরকম সহানুভূতি দেখায় না। একে বলে ‘ল্যাক অব সোসিয়াল অর ইমোশন্যাল রেসপনডিং’। ডাকলেও মনোযোগ দেয় না।

*তারা দেরি করে কথা শেখে এবং অনেকেই কিছুটা অস্পষ্ট করে কথা বলে।

*একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হলো,অটিজম শিশুরা ‘সেলফ স্টেমুলেটরি বিহেভিয়ার’ (এসএসবি) স্ব-উদ্দীপনামূলক আচরণ করে থাকে। যেমন_ একই জায়গায় কিছুক্ষণ লাফালাফি করা বা একই স্থানে কিছুক্ষণ ঘুরতে থাকা। কোনোকিছুর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা বা চোখের মণি একদিকে বা কোনায় নিয়ে তাকিয়ে থাকা।

*নরম কোনো বস্তু বা কার্পেট বা রাবার জাতীয় কিছু পেলে বা দেখলে আঙুল দিয়ে বা হাত দিয়ে নিজের মনে নাড়াচাড়া করা বা পরশ বুলিয়ে দিতে থাকা ইত্যাদি।

*কোন শব্দ হঠাৎ করে নিজের মনে আওড়ানো বা পুনরাবৃত্তি করা, কখনও দাঁত কিটমিট করা।

*কোথাও বসে থাকলে সামনে-পেছনে দুলতে পছন্দ করা। গোড়ালি উঠিয়ে টো (পায়ের আঙুল) এর ওপর ভর করে কখনও কখনও দৌড়ানো,দু’দিকে দু’হাত প্রসারিত করে সাঁতার কাটার মতো দ্রুত দোলানো_ এসব বিশেষ বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করে অটিস্টিক শিশুদের সহজে চেনা যায়।

অটিজম সচেতনতা দিবসঃ বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস ২ এপ্রিল। এবার সপ্তমবারের মতো পালিত হচ্ছে দিবসটি। দিবসটি সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠনগুলোও পালন করবে। ২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২ এপ্রিল দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ২০০৮ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০০৮ সাল থেকে এর গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী অটিজম শিশু,তাদের যথাযথ শিক্ষা,তাদের পিতামাতাদের সচেতনতা, সামাজিক দায়িত্ববোধ, পরিণত বয়সে তাদের কর্মক্ষেত্রের ব্যবস্থাকরণ, সবার মতো তাদের মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে দিবসটি গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য,‘অটিজম সচেতনতা বৃদ্ধিতে আমরা সবাই’।

শেষ কথাঃ অটিস্টিক শিশু মানে বোকা বা পাগল নয়। অটিজম শিশুরা স্কুল-কলেজ এমনকি ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করে সফলতার সঙ্গে ডিগ্রি অর্জন করার যোগ্যতা রাখে। বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী লেডি হাক এবং ডারিল হান্না_অটিস্টিক ডিসঅর্ডার তাদের সফলতার জন্য বাধা হতে পারেনি। আইনস্টাইন, আইজাক নিউটন, চার্লি চ্যাপলিন, পাবলো পিকাসো, এডলফ হিটলার, মাইকেল জ্যাকসন, পকিমন কার্টুন ছবির আবিষ্কারক সাতসি তাহেরিসহ বহু বিখ্যাত ব্যক্তি কোনো না কোনো অটিস্টিক ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ছিলেন। তবে আটিজম চিকিৎসায় কোনো ওষুধপত্র, নিরাময়ের কোনো কোর্স এখনও আবিষ্কার হয়নি। তবে প্রশিক্ষণ,সহযোগিতা ও সহমর্মিতা প্রয়োজন।

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।

jsb.shuvo@gmail.com

প্রধান সম্পাদক