আদম মালিক, জিয়া এবং প্রথম রাষ্ট্রপতি বিতর্ক
স্বাধীনতার একযুগের মাথায় রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিয়াউর রহমানের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর তার দল আবিষ্কার করে যে, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক। আর স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর জিয়ার স্ত্রী-পুত্র মিলে আবিষ্কার করেছেন জিয়া শুধু ঘোষকই নন, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি!
মূলত গত ২৫ মার্চ মঙ্গলবার স্থানীয় সময় দেড়টায় পূর্ব লন্ডনের রয়েল রিজেন্সি অডিটরিয়ামে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে যুক্তরাজ্য বিএনপি আয়োজিত ‘বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতার ঘোষক’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তারেক রহমান প্রথম তার আবিষ্কারের কথা বলেন। বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া তারই প্রতিধ্বনি করেন ঢাকায়। জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট দাবি করে তারেক রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষকে সঠিক ইতিহাস জানানোর সময় এসেছে। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট এটাই সত্যি, এটাই ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।’
প্রথম রাষ্ট্রপতি বানানোর এই আয়োজন যে হঠাৎ করে আসেনি, এটা যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র সেটা তারেক জিয়ার আলোচনা সভার টাইটেল থেকেই বোঝা যায়, ‘বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতার ঘোষক।’ আমার জানা মতে, বেগম জিয়া ঢাকায় তার ছেলের বক্তব্য প্রতিধ্বনি করার আগে ১৯ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গেও এটা নিয়ে আলাপ করেছেন এবং তাদেরও একই সুরে কথা বলার অনুরোধ করেছেন। কাজী জাফররা হয়তো শিগগির একই সুরে বাজনা বাজাবেন।
তারেক জিয়া স্বাধীনতাযুদ্ধকালে শিশু ছিলেন। ওই যুদ্ধের স্মৃতি তার তেমন না থাকারই কথা। বেগম জিয়া ভালোভাবেই দেখেছেন ওই যুদ্ধ। তার স্বামী স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিয়ে যখন ভারতে, তাকে চট্টগ্রামের বাসা থেকে শুভপুর হয়ে আগরতলা নিয়ে যেতে লোক পাঠিয়েছিলেন জিয়া। সেই লোকদের একজন আমাকে বলেছেন, তিনি হাঁটতে পারবেন না। বাসে, হেঁটে এতদূর কীভাবে যাবেন প্রশ্ন তুলেছিলেন। পরে জাহাজে করে ঢাকা চলে গেছেন। দেশের বিজয় অর্জন পর্যন্ত তিনি ঢাকা ক্যান্টমেন্টে ছিলেন। বেগম জিয়ার ক্যান্টমেন্টে অবস্থান নিয়ে নানা কথা চালু আছে। সেই ইতিহাসে না গিয়ে শুধু একটা কথা বলতে চাই, আজ দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে, ?ফাঁসিও হয়েছে যুদ্ধাপরাধীর। পাকিস্তানি আর্মিকে সহযোগিতার অভিযোগ এনে একদিন কেউ খালেদা জিয়াকেও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে বিচার দাবি করলে আশ্চর্য হব না। খালেদা জিয়া যখন ইতিহাস বিকৃতিতে নেমেছেন তখন আওয়ামী লীগ মুখ বন্ধ করে বসে থাকবে মনে হয় না। তবে তাতে কী হবে? জাতীয় নেতাদের অতীতের বিতর্কিত জীবন জনসম্মুখে প্রকাশ পেয়ে যাবে। অহেতুক আরেকটি বিতর্কের শুরু হবে, যা দেশের মানুষের মোটেও কাম্য নয়।
উচ্চ আদালত থেকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনার পরও যারা জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলেন, এখন প্রথম রাষ্ট্রপতি বলে যারা রাজনৈতিক বিতর্ক করতে চান, তারা আসলে কুতর্কের জন্যই এসব চান। জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতাযুদ্ধে যে অবদান ছিল সেটাকে খাটো করার জন্য, তার স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের নেপথ্য কাহিনী যে যেভাবেই আবিষ্কার করা হোক না কেন এটা তো বলা যাচ্ছে না, মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার কোনো অবদান ছিল না। এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বেতার থেকে তিনি একটি ঘোষণা দিয়েছেন। এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ওই ঘোষণার প্রথমটিতে জিয়া নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিলেন। পরোক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং মরহুম একে খানের পরামর্শে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন, যা জিয়ার আগে আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নানসহ অন্যরাও পাঠ করেছেন। ছাত্রলীগের তৎকালীন সিটি নেতা বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী দাবি করেন, ‘ঘোষণা পাঠ যদি স্বাধীনতার ঘোষণা হয় তাহলে ছাত্রলীগ নেতারাই প্রথম স্বাধীনতার ঘোষক’। ২৫ মার্চ রাতে জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন বলে আমাদের মাইকিং করতে নামিয়ে দেন শহরে। রিকশায় রিকশায় রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন বলে প্রচার চালাই। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যানুসারে, জিয়া যখন ২৭ মার্চ কালুরঘাটের ব্রিজের নিচ থেকে রেডিওস্টেশনে আসেন, তার পরিচয় জানতে চান বেলাল মোহাম্মদসহ রেডিও কর্মীরা। তিনি বলেন, আমি মেজর জিয়া। তখন তারা বলেন, আমরা সবাই তো মাইনর, আপনি একজন মেজর আছেন। আপনি কিছু বলেন। আমরা আগ্রাবাদ থেকে রেডিওর সম্প্রচার যন্ত্র খুলে নিয়ে এসেছি। জিয়া তখন নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ও স্বাধীনতার অস্থায়ী প্রধান সমরনায়ক বলে তার প্রথম ঘোষণাটি দেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সেই ঘোষণা দিলেই জিয়া দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হয়ে যাবেন? পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতাযুদ্ধকালে সেখানকার নেতা আদম মালিক, যিনি পরে সেদেশের ভাইস প্রেসিডেন্টসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন, নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীন ইন্দোনেশিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি কিন্তু সুকর্ণই ছিলেন, জাতির পিতাও তিনি। যুদ্ধের ডামাডোলে কত ঘটনাই ঘটে, জাতি সেটা ভুলে যায়। জিয়াউর রহমানের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। জিয়াউর রহমানের ঘোষণাটি কি ইনটেনশনাল নাকি নেহায়েত ভুল এ নিয়ে যুদ্ধকালে কলকাতায় প্রবাসী সরকারেও চলছিল নানা আলোচনা। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, জেনারেল ওসমানী, মরহুম জহুর আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ ঘোষণার জন্য তাকে কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মিজানুর রহমান চৌধুরী ও আখতারুজ্জামান চৌধুরীর হস্তক্ষেপে তা আর হয়নি। বিএনপির নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা যুক্তি দিচ্ছেন, যেহেতু কালুরঘাটের সেই ঘোষণা থেকে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে প্রবাসী সরকার গঠন পর্যন্ত দেশে কোনো সরকার ছিল না, রাষ্ট্রপ্রধান ছিল না তাই জিয়া ওই সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। বিএনপি চেয়ারপার্সনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান এ প্রসঙ্গে একটি কলামে লিখেছেন, ‘জিয়াউর রহমানের ঘোষণা অস্বীকার করলে স্বাধীনতার যুদ্ধকেই অস্বীকার করা হয়, এর ইতিহাস বিকৃত ও ধারাবাহিকতা বিঘিœত হয়। জিয়া নিজেকে তার ঘোষণায় বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান রূপে উপস্থাপন করেছিলেন। তার স্বাধীনতার ঘোষণা বৈধ হলে, প্রবাসী সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবেও তিনিই বৈধ ছিলেন। তার এই ঘোষণাকে আর কোনো ঘোষণা মারফত কোনো বৈধ কর্তৃপক্ষ কখনো রদ বা রহিত করেননি।’
কি হালকা, হাস্যকর যুক্তি। তিনি এর পরের কাহিনী বেমালুম চেপে গেলেন কেন জানি না। জিয়ার ঘোষণা তো জিয়া নিজেই রদ করেছেন পরোক্ষণে ‘আমি মেজর জিয়া প্রভিশনাল কমান্ড ইন চিফ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করছি’ বলে ভাষণ দিয়ে। এখানে অন্যকে রদ করতে হবে কেন! এই যে যার পক্ষে তিনি তার ঘোষণা রদ করলেন তিনি তাহলে কে? যিনি নিজের ভাষণে নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বলে পরোক্ষণেই তা বাতিল করে দিয়েছেন, যিনি নিজেকে জীবিত থাকাকালে কোনোদিন স্বাধীনতার ঘোষক বলেননি তাকে জোর করে আরেকজনের সমান বানানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা কতটুকু সন্মান বয়ে আনে ওই মানুষটির জন্য?
স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি আর এখন গোপন কোনো দলিল নয়। সবাই জানেন। মনে হচ্ছে জানতে এবং মানতে চান না শুধু বিএনপির কিছু নেতা। তারা এটাও বিশ্বাস করাতে চান যে, শেখ মুজিবের ডাকে নয়, জিয়ার ডাকে এদেশের মানুষ যুদ্ধ করেছে। সবচেয়ে হাস্যকর হচ্ছে, ২৭ মার্চ এবং তার পরের কালুরঘাটের সেই ঘোষণা নাকি সারাদেশের মানুষকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছে! রংপুরের বিএনপি নেতারা তেমন দাবি করেন, নিজের কানে শুনেছেন বলে। বাস্তবতা হচ্ছে, কালুরঘাট বেতারের চট্টগ্রাম থেকে ফেনী পর্যন্ত আসা মুশকিল ছিল।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তারেক রহমান বা বেগম জিয়ার ভাষ্যানুসারে ‘জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল’ কথাটা যদি সত্য হয়, সেনাবাহিনীর মেজরের চাকরির মোহ ত্যাগ করে সেনানিবাস ছেড়ে জিয়াউর রহমান সহকর্মীদের নিয়ে কালুরঘাট ব্রিজের নিচে অবস্থান নিয়েছিলেন কার আহ্বানে? কেন ট্র–পস নিয়ে ব্যাংকারে অবস্থান করে আরাকান রোড দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা কক্সবাজারের দিকে মার্চ করলে প্রতিরোধ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি? কার আহ্বানে মেজর শওকত, মেজর রফিক, ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, ক্যাপ্টেন শমশের মবিনসহ অন্যরা তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন? ক্যান্টনমেন্ট ছেড়েছেন? খালেদা জিয়া এবং তারেক জিয়া না বললেও, এটি বলার অপেক্ষা রাখে না আহ্বানটি ছিল বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের।
আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধটি কোনো নিয়মিত যুদ্ধ ছিল না, এটি ছিল জনযুদ্ধ। ঘরে ঘরে গিয়ে বলে এলে যুদ্ধ হয় না, যুদ্ধের জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রস্তুতি দরকার। দীর্ঘ ২৩ বছর সে প্রস্তুতির কাজটি করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশের মানুষকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছেন। আমরা বাঙালি, ওরা পাকিস্তানি আমরা কখনো এক হয়ে থাকতে পারব না, এই বোধ একদিনে তৈরি হয়নি। যুদ্ধের এই প্রস্তুতি কত তেজদীপ্ত ছিল যে জিয়াউর রহমানের মতো একটি নিয়মতান্ত্রিক বাহিনীর সদস্যরা ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে কালুরঘাটে অবস্থান নিয়েছেন, মওলানা ভাসানীর মতো একজন বরেণ্য নেতা পথের ক্লান্তি ভুলে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে আসামে পৌঁছেছিলেন। শেখ মুজিব বাঙালির ধমনীতে স্বাধীনতার যে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা ছাড়া তা নির্বাপিত হতো না। বাঙালির সে আকাক্সক্ষা কারো ঘোষণার মুখাপেক্ষী ছিল না। কোনো জনগোষ্ঠীর কাজ সফল হতে পারে না যদি না সময় ও আবহাওয়া অনুকূলে না থাকে। শক্তিশালী নেতা আবহাওয়া তৈরি করে সাফল্য আনতে পারেন। শেখ মুজিব ৬ দফা আন্দোলন করে জাতিকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছেন স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে তিনি বাঙালি জাতির আইনানুগ অভিভাবকত্ব পেয়েছিলেন। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ মিলে আওয়ামী লীগের আসনসংখ্যা তখন ছিল ৪১৭টি। মূলত তখন তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঋষি হয়ে উঠেছিলেন। বাঙালির জাতির পিতা হিসেবে আভির্ভূত হওয়ার পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন।
পরিশেষে বলব, সীমার বাইরে নিজেকে, নিজের পরিবারকে মর্যাদার আসনে বসাতে গিয়ে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা বেগম জিয়া ও তারেক জিয়ার জন্য সুখকর হবে না। একটি ঐতিহাসিক সত্য তাদের অবগতির জন্য বলে রাখি গান্ধী না থাকলেও ভারত স্বাধীন হতো কিন্তু জিন্নাহ আর শেখ মুজিব না থাকলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সৃষ্টি হতো না।
[লেখক : সাংবাদিক ও শিক্ষক]
সূত্র: মানবকণ্ঠ ও নতুনদেশ ডট কম।।