আমাদের গণজাগরণ
শেখ তাসলিমা মুন:
৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩। রাতে ঘুমুতে পারলামনা। আমি ঘুমিয়ে থাকবো? আর ওদিকে কাদের মোল্লার রায় হয়ে যাবে? ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ বাংলাদেশ সময় সকাল দশটা। ভোর পাঁচটা এখানে। আদালতে রায় পড়া হচ্ছে। মিডিয়ায় আসতে আরও দেরী। হাত পা কাঁপছে। হঠাত না না না না না না না………………কেউ লিখলেন। কি? কি হয়েছে? কেন? কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন। আমি লিখলাম, নিশ্চয়ই আমেরিকা আর ইউর চাপ!
আমি সাধারণত খুব বিপদে শান্ত হয়ে যাই। অল্প বিপদে ছট ফট করি। সবাইকে শান্ত হতে অনুরোধ করি।
না সবাই ফেটে পড়ে। আমার থ্রেডে তখন ৪০টির মত কমেন্টস।
কয়েকজন বন্ধু লিখলো, চলো শাহবাগে যাই। শাহবাগ। শাহবাগ। ১০ জন মানুষ হাতে পোস্টার লিখে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়ে দিলো।
তারপর। আর লেখার ক্ষমতা রাখিনা। অফিস চলে গেছি। ছটফট করছি। বাসায় ফিরলাম তাড়াতাড়ি। তখনো ফিরিনি। ট্রেনে। বন্ধু সুপ্রিতি ধর ফোন দিয়েছে। কিছু শুনছিনা। শধু শব্দ আর শব্দ। আমি হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছি। ওপার থেকে ও চিৎকার করে বলছে, কিছু শুনছো? আমি বললাম, শো শো শব্দ। কিসের শব্দ? সমুদ্রের পাশে নাকি তুমি?
ও বললো, না আমি শাহবাগে, শোন ……
আমি বললাম, কিসের শব্দ? কিসের গর্জন?
মানুষের।
মানুষের? কত মানুষ?
অনেক মানুষ!
অনেক কত? কত অনেক?
বাসায় ফিরে সুস্থির থাকতে পারলাম না। বাংলা চ্যানেল খুলে ঘরে পায়চারি করছি আর টিভির সামনে বসছি। আবার উঠে পড়ছি। হাঁটছি। পায়চারি করছি। শাহবাগ। শাহবাগ! কতদূরে? কতদূরে তুমি?
আমাদের পরিচিত মুখ সব। রাত বাড়ছে। আমি ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, তোরা বাসায় যাবিনা?
না।
মানে?
আমরা সারারাত থাকবো।
পাশে খিচুড়ি বসেছে। ঢোল নিয়ে বসে গেছে ওরা। মোমবাতি জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসেছে ওরা। ওরা নড়বেনা। ওরা অনড়। ওরা চারপাশ কাঁপিয়ে বসে থাকে অনড়।
সকাল হতে না হতে শুধু ইতিহাস।
চলো চলো শাহবাগ চলো।
মানুষের ঢল নামছে।
কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই। ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই। কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই। ক তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার! তুই রাজাকার!
সেই থেকে ফাঁসি একটি শব্দ যে শব্দের ভেতর একটি জাতি ৪২ বছরের অসমাপ্ত কাজে নামলো।
শাহবাগে বড় বড় করে লেখা হলো, আপনাদের সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত! এখানে ৪২ বছরের অসমাপ্ত নির্মাণ কাজ চলছে।
আমি বারবার অনুভব করেছি, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ যা সৃষ্টি হলো সেটা বাঙালি জাতিকে লিখে যেতে হবে আরও ১০০ বছর। এর পূর্ণ মুল্যায়ন এবং অনুধাবন করতেও এ জাতির আরও লাগবে একশো বছর।
কি দিয়েছে আমাদের শাহবাগ?
একটি দু বছরের শিশুও জানলো, রাজাকার একটি ভয়ঙ্কর শব্দ।
একটি দু বছরের শিশুও জানলো, আমাদের দেশে একটি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো।
একটি দু বছরের শিশুও বুঝতে শিখলো, গণহত্যার বিচারের দাবী করতে শাহবাগে যেতে হয়।
একটি দু বছরের শিশু চিৎকার করে বলতে শিখল, জয়য়য়……বাংলাআআআআআআ!
একটি দুই বছরের শিশুও চিৎকার করে বলতে শিখলো, রাজাকারের ফাঁসি চাই।
কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবী কি এই গন বিস্ফোরণের, এই রেনেসাঁর, ইতিহাসের উন্মেষের একমাত্র কারন?
হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা ক্যান্সারের পেশেন্ট রাস্তায় নেমে এসে দুনিয়া কাঁপানো তিনটি মিনিটে শরীক হলো। কেন? শুধুই কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবী? গুণীজনেরা সে ব্যখ্যা নিশ্চয়ই দেবেন।
শাহবাগের সবচাইতে বিশেষত্ব বোধ করি, কেউই এই আন্দোলনের রূপরেখা অনুমান করতে পারেনি। না মিডিয়া। না শাসক শ্রেণী। না মৌলবাদ। না বিদ্যমান বিরোধীদল। এমন কি যুদ্ধাপরাধদের অভিযোগ নিয়ে যারা জেল হাজতে তাস খেলে সময় কাটাচ্ছিলো তারা তীব্র ঝাঁকুনিতে জ্ঞান হারালো।
আর আমরা? আমরা কিংকর্তব্যবিমুঢ় আবেগে মূর্ছা যেতে যেতে বললাম, কে বলেছে বিচারের বানী নীরবে নিভৃতে কাঁদে? না না। আমাদের সুবিচার পাবার দিন ফিরে এসেছে। আমাদের সুবিচার চাইবার দিন ফিরে এসেছে।
কিন্তু এ বিপুল আয়তনের কাজ কারা করলো? বয়সে দ্বিগুণ হয়েও বললাম সেই প্রজন্মের কাছে, দেহ পদধূলি! দেহ পদধূলি! লহ অশ্রু মোর! সে আমাদের প্রজন্ম। আমাদের তরুণ প্রজন্ম।
প্রথম কদিন দেখলাম ওরা শ্লোগানে শ্লোগানে গলা ভেঙে ফেলছে। ছোট্ট শ্যামলা মেয়েটির গলায় যে দ্যোতনা, আমি কেবল বংগবন্ধুর গলায় শুনেছি সে ঝঙ্কার! ভিন্ন জায়গায়। ভিন্ন সময়ে।
দূর গ্রাম থেকে একজন কৃষক ভাই হাতে এক প্যাকেট বিস্কুট আর এক বোতল পানি নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছেন।
বাচ্চারা, আমারতো কিছু নাই। অনেক দূর থেকে হেঁটে এসেছি শুধু তোমাদের দেওয়ার জন্য।
ডুকরে কেঁদে উঠলাম এ দৃশ্য টিভির পর্দায় দেখে। কান্নার অর্গল খুলে দিলাম। না আটকাবোনা। আয় কান্না ঝেঁপে! আমার ছেলেদের ভালবাসা দেবো মেপে।
১৯৭১। আমাদের মুক্তিযদ্ধা ছেলেরা জলে জংগলে পালিয়ে গেরিলা অপারেশনে ব্যস্ত। ওদের পরনে কাছা দিয়ে পরা লুঙ্গি। হাতে স্টেনগান। মাথায় গামছা পেটি দিয়ে বাঁধা। চোখের সামনে ভেসে উঠছে ওদের ক্ষুধার্ত মুখ। তৃষ্ণার্ত চাউনি। গোপনে ভীষণ গোপনে বেতের ধামায় নেয়ে যাওয়া হচ্ছে রুটি। টিনের কলসিতে পানি।
শাহবাগে টাকার দরকার? পানি? ওরা কতক্ষণ আর স্লোগান দেবে?
বোধ হয় ১১ ফেব্রুয়ায়রি। আমি সুমনের(সবাক পাখি) টেলিফোন যোগাড় করলাম। টেলিফোন করলাম। বললাম, আমি তোমাদের জন্য কিছু করতে চাই। কিভাবে করবো? আমি ডাঃ ইমরান এইচ সরকারের সাথে কথা বলতে চাই।
সুমন আমাকে সেই প্রথম ইমরানের টেলিফোন নাম্বার দেয়। সুমন আমায় বললো, আপনি একটু পরে ফোন করেন।
করলাম। ইমরান টেলিফোন ধরলো।
আমি একই কথা ইমরান এইচ সরকারকেও বললাম।
না, আপু আমরা কোন টাকা পয়সা নিচ্ছিনা। লাগলে আপনাদের জানাবো।
ইমরান আজও আমাকে টাকার প্রয়োজন জানায়নি।
লাইভ টিভিতে দেখছি পানি আসছে। মাইক বাজছে। সামিয়ানা টানানো হচ্ছে। বুঝতে পারছি এসবের খরচ আছে। এ খরচ টাকায় শোধ করতে হয়। কেউ বা কারা সেটা করছে।
তখন কেউ প্রশ্ন তোলেনি, এ টাকা কোথা থেকে আসছে?
সবাই ভেসে যাচ্ছে আবেগে। শ্লোগানে শ্লোগানে ভেঙে ফেলছে গলা।
দেশপ্রেমের এই পুন্যযাত্রায় সবাই অংশ নিতে ছুটে আসছে। ছুটে যাচ্ছে।
কেউ বলেনি, কেউ প্রশ্ন করেনি এ খরচ কার হাত দিয়ে হচ্ছে?
এর পর শাহবাগের যাত্রা নানান মোড় নিয়েছে। শাহবাগের সফলতায় নানান গ্রুপ নানান ভুমিকা নিয়েছে। আমরা সবাই তার সাক্ষি। কাউকে সে গল্প তুলে ধরার দরকার নেই। বড় বড় ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে শাহবাগ সক্ষম হয়েছে। শাহবাগের কষ্টিপাথরে অনেকের রূপ কুরুপ প্রকাশ হয়ে পড়েছে।
শাহবাগের অর্জন এবং তার বিবিধ দিক আলোচনা করতে গেলে এই ছোট্ট নোট যথেষ্ট নয়। শাহবাগ আমাদের বুঝিয়েছে চোখে আঙ্গুল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ একটি চেতনা, আর সে চেতনায় এতদিনের মিথ্যাচার করে ক্ষমতায় আরোহণ আর সম্ভব নয়।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বনাম গনহত্যাকারী। সে পক্ষে তখনকার বিরোধী দল তার পক্ষ স্পস্ট করতে বাধ্য হয়েছে জনগণের কাছে।
জাতি বুঝেছে, বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অস্তিত্ব। আমাদের শাহবাগ সে চেতনা পৌঁছে দিয়েছে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। নানান বয়সের, নানান প্রজন্মের মানুষের কাছে।
শাহবাগ! তার মুল্যায়ন করার শক্তি আমাদের এখনও হয়নি। এখুনি নয় অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন।
সেই চেতনা কি নিভে যাবার? না। সেটা প্রজ্বলিত বাস্তবতা। বাঙালির প্রানে। বাংলাদেশের হৃদয়ে।
প্রজন্ম সেটা বহন করবে।
তাদের কাজ থেমে গেছে? না। এ কাজ কোনদিন থেমে যায়না। এটি একটি চলমান প্রসেস। ৪৩ বছরের থেমে থাকা পুনর্নির্মাণ কাজ কোনদিন এক বছরে সম্ভব নয়। এটি একটি বহমান প্রকল্প।
কে নেবে এ কাজের দায়িত্ব, সেটা নির্ধারণ করবে কে? আমি বলবো সময়। সময় নির্ধারণ করবে। সময় সিদ্ধান্ত নেবে।
তিনশো কোটি টাকার অপবাদ খুব বড় অপবাদ নয়। এর থেকে অনেক বড় অপবাদ এসব কাজে আসবে যাবে। থাকবে। সময় সেটা দুরও করবে।
সময়। সময়ই সৃষ্টি করবে তাঁদের, তৈরি করবে তাঁদের যারা এ দায়িত্ব ভার নিতে সক্ষম।
[শেখ তাসলিমা মুন,সুইডেন]
১০ এপ্রিল, ২০১৪