রানা প্লাজা ধসের পর এক বছর পূর্ত্তিঃ জীবিতরা কি ফিরে পেয়েছেন পুরনো জীবন?
এসবিডি নিউজ24 ডট কম,ডেস্কঃসাভারেরানা প্লাজা ধসের পর এক বছর পূর্ণ হল ২৪ এপ্রিল। এক বছর পর কেমন আছেনদুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকেরা? তারা কি ফিরে পেয়েছেন পুরনো জীবন? গতবছরের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা নামের বহুতল ভবন ধসে পড়ার সময় সেখানে প্রায়তিন হাজার লোক ছিলেন। এর মধ্যে ১১শ‘রও বেশি লোক নিহত হন যাদের অধিকাংশইছিলেন ওই ভবনে ধাকা পাঁচটি গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিক। আহতের সংখ্যা প্রায়২ হাজার ৪ শ‘। অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হারিয়ে অনেকেই মুখোমুখি কঠিন জীবনের। রানাপ্লাজার সেই জায়গাটুকু থেকে ১০ মিনিট হেঁটে গেলে সাভার আড়াপাড়া। সেখানেইছোট্ট একটি টিনের ঘরে স্বামীর সাথে থাকেন মোসাম্মৎ রেবেকা খাতুন। ঘরেরমেঝেতে বসে ছিলেন দু‘পা হারানো রেবেকা। বলছিলেন, আমি সারা বছর ধরে খুবকষ্টে আছি। দু‘পায়ে মোট আটবার অস্ত্রোপচার হয়েছে। ডাক্তার বলছেন আবারোদরকার হতে পারে। রেবেকা রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় আহত শ্রমিকদের মধ্যেসবচাইতে বেশিদিন হাসপাতালে ছিলেন। ১০ মাসের মতো। ঐ দুর্ঘটনায় তিনি তার মাসহ পরিবারের আরো পাঁচজনকে হারিয়েছেন। বলছিলেন কীভাবে জীবন তার এক অর্থেথেমে গেছে। রেবেকার সারাদিন কাটে টিনের ছোট্ট এই ঘরটিতে। তিনি বলছিলেন, স্বামী ছাড়া এখন আর তার কেউ নেই। তিনি বলেন, সারাদিন এই ঘরে পড়ে থাকি। ভাবিযদি একটা কিছু হয় আর যদি আমার স্বামী কাছে না থাকে তাহলে আমার কী হবে। আমিকি বেঁচে বের হতে পারবো? রানা প্লাজা ধসে রেবেকার মতো ৪০ জনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হানি হয়েছে। আর যারা শারীরিকভাবে খুব বেশি আঘাতপ্রাপ্ত নন তারাওজীবন নিয়ে খুব বেশি সামনে এগুতে পারেননি। সাভারের আনন্দপুরে থাকেন আর একজনশ্রমিক শ্রাবণ আহাম্মেদ জাহাংগীর। বলছিলেন পোশাক শিল্পে আর কোনদিন ফিরেযাবেন না। তিনি বলেন, মনের মধ্যে ভীষণ ভয় কাজ করে। কারখানার মেশিনের ভয়ংকরশব্দ আমার এখন আর সহ্য হয়না। সারা বছর আমার ও আমার ছেলের খরচ জোগান দিয়েছেআমার বাবা। আমি একটি এনজিওর সহযোগিতায় একটি চায়ের দোকান দেবার চেষ্টা করছি।কিন্তু গার্মেন্টসে আর কোনদিন ফিরে যাব না। বাড়ির বাইরে তার চায়েরস্টলটিতে তেমন কিছু নেই বললেই চলে। রয়েছে শুধু কয়েকটি বিস্কুট আর চিপসেরপ্যাকেট । কোন কাস্টমারও নেই। জাহাংগীরের মতো রানা প্লাজার আরো বহু শ্রমিকএভাবেই বিকল্প পেশায় যাবার চেষ্টা করছেনএকশন এইড বাংলাদেশ এক জরিপে বলছেরানা প্লাজার প্রায় ৭৩ শতাংশ শ্রমিক তাদের পুরনো পেশায় ফিরে যাননি। অনেকেরিক্সা চালাচ্ছেন, দোকানদারি করছেন। কেউবা আবার গ্রামে কৃষি কাজে ফিরেগেছেন। তাদের বেশিরভাগই বলছেন নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যার কথা।কিন্তু সব ভয়, কষ্ট কাটিয়ে প্রায় ৩০০র মতো শ্রমিক তারপরও ফিরে গেছেন তাদেরপুরনো পেশায়।
রাজফুলবাড়িয়া, সাভারের একটি কারখানায় কাজ করেন তেমনই ৯ জন। শারমিন আক্তারতাদের একজন। ঐ দুর্ঘটনায় তিনি নিজে বেঁচে গেলেও মাকে হারিয়েছেন। প্রথমদিকেমায়ের মরদেহটুকুও মেলেনি। প্রায় পুরোটা বছর তার কেটেছে হাসপাতাল আর ডিএনএল্যাব ঘুরে। যদি মায়ের কোন খবর মেলে সেই আশায়। কিন্তু অবশেষে কয়েকমাস আগেমায়ের কবরের সন্ধান মিলেছে। জুরাইন কবরস্থানে ১৭৩ নম্বর কবর এটুকুই খোঁজপেয়েছেন তিনি। কিন্তু এই অভিজ্ঞতার পরও তাকে পোশাক শিল্পেই ফিরতে হয়েছেকাজের জন্যে। শারমিন বলছিলেন, এর বাইরে আর কোন কাজ তার জানা নেই। তিনিবলেন, প্রথম যেদিন কাজে আসি মনে হচ্ছিল তখনই পালাই। কিন্তু কি করবো। আমারআর কোন উপায় নেই। শারমিন বলছিলেন, ফ্যাক্টরিতে সামান্য একটু শব্দেও ভীত হয়েওঠেন। রাত্রে সেদিন স্বপ্ন দেখলাম যে এই ফ্যাক্টরিটাও ধসে পড়েছে। আমি ভাবিআল্লাহ আমাকে একবার বাঁচিয়েছে। আর একবার কি বাঁচাবে? এই কারখানায় কর্মরতরানা প্লাজা সব শ্রমিকেরাই বলছেন একইধরনের ভয়ের কথা। কিন্তু তারপরও দেনারদায়ে কাজে এসেছেন নার্গিস আক্তার। তিনি বলেন, মা আমাকে আর কাজে আসতে দিতেচায়নি। কিন্তু আমার বাবা নেই। ঘরভাড়া দিতে পারছিলাম না। অনেক ঋণ নিয়েফেলেছি। আসতাম না কিন্তু একদম কষ্টে পড়ে আসা। নার্গিসের মতো আরো বহু শ্রমিকএমন দেনার দায়ে রয়েছেন। শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত নন যারা, তারা তেমন কোনসহায়তাও পাননি। শুরুতে অল্প কিছু অনুদান মিললেও এখন তাদের তেমন কেউ খোঁজওনেয়না।
[সূত্র:বিবিসি বাংলা।]