সমুদ্রে আরেক বাংলাদেশ
আনিস আলমগীর: ২০১৪ সালের ৭ জুলাই বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক দিন। কারণ স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর ওইদিনই পরিপূর্ণতা পেল একটি স্বাধীন দেশের জলসীমা। নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত সমুদ্রবিষয়ক আন্তর্জাতিক সালিশি আদালত সেদিন ভারত-বাংলাদেশের জলসীমান্ত বিরোধ নিরসনের রায় দিয়েছেন। বিরোধপূর্ণ এলাকায় বাংলাদেশ পেয়েছে ১৯ হাজার ৩৬৭ এবং ভারত ৬ হাজার ১৩০ বর্গকিলোমিটার। অবশ্য বাংলাদেশের দাবি ছিল ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটার। ২০১২ সালের ১৪ মার্চ এ রকম আরেকটি রায় আমরা পেয়েছিলাম জার্মানির হামবুর্গে স্থাপিত সমুদ্রবিষয়ক আরেকটি ট্রাইব্যুলান থেকে মিয়ানমারের সঙ্গে জলসীমান্ত বিরোধ নিরসনে। সেটিও ছিল ঐতিহাসিক একটি বিজয়। বাংলাদেশ সেদিন যা দাবি করেছিল, তার প্রত্যাশার পুরোটাই পেয়েছিল। সুখের বিষয় হচ্ছে, প্রতিবেশী দুটি দেশ এই রায় দুটিকে স্বাগত জানিয়ে মেনে নিয়েছে। বিরোধপূর্ণ এলাকা নিয়ে ৩ দেশই খুশি। কারণ এখন সেখানে নিজেদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে আর হিমশিম খেতে হবে না। বিদেশি বিনিয়োগ প্রশ্নের মুখে পড়বে না। স্বাধীন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এ অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নে দেশ ৩টিই ভূমিকা রাখতে পারবে।
লক্ষ করার বিষয়, কি মিয়ানমার, কি ভারত- সবার সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিরসনের এই রায় পছন্দ হয়নি বাংলাদেশের প্রধান একটি দল বিএনপির। বিএনপি দীর্ঘ সময় রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকাকালে এই বিরোধ জিইয়ে রাখা ছাড়া কোনও কিছু করতে পারেনি। পারেনি দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান করতে। না পেরেছে সাহস করে আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে। আমি বলছি না, তাদের এটায় আন্তরিকতার অভাব ছিল, আওয়ামী লীগ থেকে তারা কম দেশপ্রেমিক। তাদেরও নিশ্চয়ই আগ্রহ ছিল সমস্যাটির সমাধান। বরং বলব, সরকারে থাকতে তারা ওই বিষয়টি সমাধানের কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলও। কিন্তু পারেনি। আর নিজে যেটি পারিনি, নিজেরা যখন সরকার পরিচালনা করে অভিজ্ঞতা পেয়েছে মাঠের বক্তৃতাবাজি আর সরকার পরিচালনা এক জিনিস নয়- তখন নিজেদের ব্যর্থতার জন্য লজ্জিত না হয়ে এ নিয়ে কুতর্ক জুড়ে দেওয়ায় লাভ হচ্ছে কার? বিএনপি রায় নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তাদের প্রতিক্রিয়ায় জানায়, এই রায়ে নাকি ভারতের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়েছে। সমুদ্রে তাদেরই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের মোট আয়তন ৩ লাখ বর্গকিলোমিটার। এর অধিকার দাবিদার রাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার। ২০১২ সালের রায় এবং ২০১৪ সালের রায়ে বাংলাদেশ পেয়েছে মোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশের পাওনা যদি এই হয়, তাহলে ভারত আর মিয়ানমার থেকে তা বেশি। বিএনপি কোন বিবেচনায় এই রায়ের সমালোচনা করল- এটি বোঝা মুশকিল। হেগ ট্রাইব্যুনাল নিরপেক্ষতা বজায় রাখা এবং সবাইকে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠারও চেষ্টা করেছেন। রায় প্রদানের আগে তারা বিরোধপূর্ণ এলাকায় সফরও করেছেন। কথায়-কথায় অভিযোগ উত্থাপন বিএনপির অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই অভ্যাস অনুসারে তারা সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে অভিযোগ করবেন- এতে বিচিত্র কিছু নেই। ভারত বিরোধিতার মাতম তুলে কায়াহীন ছায়ার বিরুদ্ধে বিএনপির যুদ্ধ ঘোষণার কুঅভ্যাস জন্মের পর থেকেই। কিন্তু তলে-তলে ভারতকে ছাড় দিতে তারাও এগিয়ে। বাংলাদেশকে ভারতীয় পণ্যের বাজার করেছে বিএনপিই।
সক্রেটিস একবার রাজনীতিবিদদের মধ্যে জ্ঞানী লোকের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু পেয়েছিলেন এক বৃহৎ জ্ঞানপাপীর দল। বিএনপির অবস্থায়ও মনে হচ্ছে, জ্ঞানপাপীদের সমাবেশ। অন্ধভাবে কোনও নীতিকে অনুসরণ করার সময়ই মানুষ চরমভাবে অসাবধান হয়ে পড়ে। এতে নিজেদের জন্য বিপর্যয় তৈরি হয়। বিএনপি বর্তমানে সে বিপর্যয়ের সম্মুখীন। তারা সরকারের ব্যর্থতাও খুঁজে বের করতে পারে না, সফলতাও দেখে না। বাংলাদেশের জনগণ যদি নিজেদের আজ সুশাসন বঞ্চিত মনে করে, তাহলে সরকারকে পথ দেখাবে, জনগণের জন্য কাজ করবে- এমন একটি বিরোধী দল থেকেও বঞ্চিত।
একটি দেশ ৪৩ বছর পর জলসীমার বিরোধ মিটিয়ে সমুদ্রে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর সুযোগ পেল। বিরোধপূর্ণ সব তেল-গ্যাস ব্লক পেল। সেটি বিএনপির জন্য বড় হল না, হল তালপট্টি- যেটির অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন। এটি পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সালিশে যায়নিও। আবার অস্তিত্ব রেখে বিরোধ নিরসন করতে গেলে প্রক্রিয়া আরও ৪৩ বছরের ধাক্কায় পড়ার আশঙ্কা ছিল। তালপট্টিটা আসলে কী? ১৯৭০ সালের দিকে রায়মঙ্গল নদী ও ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনায় একটা চর জেগেছিল। এটিকে আমরা দক্ষিণ তালপট্টি নামে অভিহিত করেছিলাম। ভারত এই চরটিতে ১৯৮১ সালে তাদের নৌবাহিনী পাঠিয়েছিল। তারা তার নামকরণ করেছিল পূর্বাশা। বাংলাদেশ দক্ষিণ তালপট্টির দাবিও ভারতের কাছে পেশ করেছিল। কিন্তু বর্তমানে চরটির অস্তিত্ব আর নেই। আসলে ওই চরটি ছিল চোরাবালি চর। নদীর মোহনায় এ রকম অনেক বালিচর জেগে ওঠে আবার বিলীন হয়ে যায়। আমাদের যমুনা নদীতেও বর্ষার পর-পরই দীর্ঘ চরের অস্তিত্ব দেখি এবং কিছুদিনের মধ্যে ওই চর বিলীন হয়ে যায়। যমুনাতীরের মানুষ এ চরগুলোকে চোরাবালির চর বলে অভিহিত করে থাকে। বিএনপি আসল সমস্যায় না তাকিয়ে সবসময় চোরাবালির চর নিয়ে ব্যস্ত থাকায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তাদের মতামত কী- এটি জানার আগ্রহ একসময় মানুষের কাছে হয়তো গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। তবে বিএনপির ভাবনা যাই হোক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে অভিনন্দন জানাতে হয়। গত ৪৩ বছর যে বিষয়টি ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে অমীমাংসিত ছিল, তার সরকার সাহসিকতার সঙ্গে ওই বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে উত্থাপন করে উভয় রাষ্ট্রের সঙ্গে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছে দেশের অপূরণীয় মঙ্গল সাধন করেছে। প্রশংসা করতে হয় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, বিষয়টি নিয়ে শুরু থেকে লেগে থাকা কর্মকর্তা এডমিরাল খুরশিদ আলম ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তাকেও। তাদের দৃঢ়তা ও পরিশ্রমের জন্য আমরা এ বিজয় পেলাম। আদালতে সমদূরবর্তী পদ্ধতিতে জলসীমানা নির্ধারণের দাবি তুলেছিল ভারত এবং বাংলাদেশ ন্যায্যতার ভিত্তিতে জলসীমানার বিভাজন চেয়েছিল। হেগের সালিশি আদালত ন্যায্যতার ভিত্তিতে বিষয়টি বিবেচনা করে রায় দিয়েছেন। এই রায়ের ফলে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ চূড়ান্ত হওয়ায় বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল, চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৯৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ- সব সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার লাভ করেছে। হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে ৫ বিচারপতির মধ্যে একজন ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত শ্রীনিবাস রাও। তিনি রায়ে মতামত প্রদানকালে বলেছেন, ভারতের জন্য ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অবশ্য এ রায়ই চূড়ান্ত। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ নেই। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রায় মেনে বলেছেন, ভারত এই রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
শেখ হাসিনার সরকার জলসীমা নির্ধারণে অশেষ গুরুত্ব দেওয়ায় ২০১২ ও ২০১৪ সালের রায়ে তাদের-আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। বাংলাদেশের থেকে বড় আরেকটি বাংলাদেশ পেয়েছে বঙ্গোপসাগরে। এখন সার্বিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে এর উন্নয়নে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার তুলনায় স্থলভূমির পরিমাণ কম। বাংলাদেশের সমপরিমাণ আরেকটি বাংলাদেশকে জনবসতির জন্য ভাবা দরকার এখন থেকে। হল্যান্ডসহ বিশ্বের অনেক দেশ সমুদ্রে জাহাজ ডুবিয়ে কৃত্রিমভাবে চর তৈরি করছে। সেখানে পলিমাটি জমে-জমে একসময় তৈরি হচ্ছে আবাসভূমি। বিষয়টি দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ। কিন্তু আগামী প্রজন্মের জন্য ভূমি-ভাবনা এখন থেকেই শুরু করতে হবে এবং এর একমাত্র উপায় এই বিশাল সমুদ্র। যে তেল-গ্যাস ব্লকগুলো এতদিন আমরা ব্যবহার করতে পারিনি, এর সঠিক ব্যবহার করতে হবে। দেশের এই সম্পদ আবার বিদেশিদের লুটপাটের সুযোগ না করে শতভাগ দেশের মানুষের কল্যাণে কীভাবে কাজ করা যায়, শাসকশ্রেণিকে তা ভাবতে হবে। রাশিয়া ইতোমধ্যে সমুদ্রে তেল-গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধানে সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে। বাপেক্সে সহযোগী হিসেবে রাখতে চেয়েছে। সরকারের উচিত রাশিয়াসহ আরও যারা সুপ্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসে, এর সবই পর্যালোচনা করে দেশের জন্য যেটি লাভজনক হয়- ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া।
[লেখক : সাংবাদিক, শিক্ষক]
{লেখাটি দৈনিক আমাদের সময় থেকে সংগৃহীত}