আন্দোলনের হুঙ্কার এবং চালু জোকস…
প্রভাষ আমিন: সবার জানা একটি গল্প দিয়ে শুরু করছি। এক রাখালবালক মাঠে মেষ চড়াতে যায়। গ্রামবাসীকে বিভ্রান্ত করার জন্য সে চিৎকার করে, বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে। গ্রামের লোকজনও তাকে বাঁচাতে ছুটে আসে। কিন্তু এসে দেখে, বাঘ আসেনি। এভাবে কয়েকবার সেই রাখালবালক গ্রামবাসীকে বিভ্রান্ত করে। একদিন সত্যি সত্যি বাঘ এলো। রাখালবালক প্রাণান্তকর চিৎকার করে গেল। কিন্তু গ্রামবাসী ভাবলো, রাখাল আবার তাদের বিভ্রান্ত করছে। তাই কেউ এলো না।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী, সাবেক বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া যখন বলেন, ঈদের পরে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। আমার খুব হাসি পায়। আর সেই রাখাল বালকের গল্পটি মনে পড়ে। অন্তত গত চার বছর ধরে আমরা শুনে আসছি খালেদা জিয়ার আন্দোলনের হুঙ্কার। কেন জানি না, রোজার মাস সামনে এলেই যেন খালেদা জিয়ার আন্দোলনের কথা মনে পড়ে যায়। আর তিনি ঈদের পর কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার হুমকি দেন। কিন্তু রোজার মাসেই বোধহয় আবার সেই আন্দোলনের কথা ভুলে যান বা রমজানের শিক্ষা নিয়ে সংযমী হয়ে যান। তাই আন্দোলন আর হয় না। বারবার অর্থহীন আন্দোলনের ডাক পুরো বিষয়টিকে হাস্যকর করে তুলেছে। বিএনপি’র নেতাকর্মীরাই খালেদা জিয়ার এই আন্দোলনের ডাক নিয়ে আড়ালে আবডালে হাসাহাসি করেন। তারাই বলাবলি করছেন, তারিখ দিয়ে মাইর হয় না। চাঁদ দেখে আন্দোলন হয় না। দেশে যদি আন্দোলনের যৌক্তিক কারণ থাকে, আর তাতে যদি জনগণ ও নেতাকর্মীকে সম্পৃক্ত করা যায়; তাহলে আন্দোলন যে কোনো সময় গড়ে উঠতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, দেশে কি আন্দোলন করার মতো যৌক্তিক পরিস্থিতি রয়েছে? আমি মনে করি রয়েছে। কারণ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াত যে দাবিতে আন্দোলন করেছে এবং নির্বাচন বর্জন করেছে, তা এখনও পূরণ হয়নি। তার মানে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর যেখানে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠার কথা, সেখানে আন্দোলনের মাঠ ছেড়ে দেয় বিএনপি। বিএনপির মূল দাবি, নির্দলীয় নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। এই দাবি ছিল এবং আছে। বিএনপির দাবি যথেষ্ট যৌক্তিক, তবে আমি মনে করি বাংলাদেশে আর কখনোই আগের স্টাইলের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসবে না। তারপরও বিএনপি তাদের দাবির ব্যাপারে অনড় থেকে আন্দোলনে হেরে গেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে নানা জরিপে দেখা গেছে, দেশের বেশিরভাগ মানুষ বিএনপি’র দাবির পক্ষে। তারপরও বিএনপি তাদের আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। কারণ তারা জনসম্পৃক্ত আন্দোলনের চেয়ে, জামায়াতের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ওপর বেশি নির্ভর করেছে। জনগণের ওপর নির্ভর না করে তারা বিদেশিদের ওপর নির্ভর করেছে। সুযোগ পেলেই তারা বিদেশিদের কাছে দেশের ব্যাপারে নালিশ করেছে। সর্বশেষ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের কাছেও নালিশ করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু কোথাও সাড়া পাননি।
সুষমা স্বরাজের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে বিএনপি আবারও তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার প্রমাণ রেখেছে। বাংলাদেশের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে সকালে হোটেল সোনারগাঁওয়ে ছুটে যেতে হয়েছে। দুটোই খালেদা জিয়ার জন্য গ্লানির। সাধারণত তিনি বিকেল বা সন্ধ্যার আগে কোনো কর্মসূচি রাখেন না। ক্ষমতায় থাকতেও এটাই ছিল তার রুটিন। আর এখন কিনা তাকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা কেরতে সকালে ঘুম থেকে উঠতে হয়। সুষমা স্বরাজ যেখানে সংসদ ভবনের কার্যালয়ে গিয়ে রওশন এরশাদের সঙ্গে দেখা করেন, সেখানে খালেদা জিয়াকে যেতে হয় হোটেলে। একেই বলে নিয়তির নির্মম পরিহাস। অথচ এই খালেদা জিয়া একসময় হরতালের অজুহাতে ভারতের রাষ্ট্রপতির সাথেও দেখা করেননি। এতে অবশ্য সুষমা স্বরাজের কোনো দোষ নেই। এরশাদের পতনের পর থেকে খালেদা জিয়া হয় প্রধানমন্ত্রী, নয় বিরোধী দলীয় নেত্রী ছিলেন। এই প্রথম তিনি কেউ নন। নিছক একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান। কোথায় সাক্ষাত হবে, তা নিয়ে তদ্বিরের সুযোগ ছিল না, সুষমার দেখা পেতেই খালেদা জিয়াকে অনেক তদ্বির করতে হয়েছে। অথচ বিজেপি’র বিশাল জয়ে উল্লাসের ঢেউ খেলে গিয়েছিল বিএনপি শিবিরে। আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণার আগেই খালেদা জিয়া নরেন্দ্র মোদীকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। কিন্তু এখন বাস্তবতা সেই উল্লাসের বেলুনকেও চুপসে দিয়েছে। বিএনপি এখন কোথায় যাবে? জামায়াত বা বিদেশিদের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বিএনপি যদি দলের নেতাকর্মী আর জনগণের ওপর নির্ভর করতো, তাহলে এরচেয়ে ভালো হতে পারতো। কিন্তু একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তে বিএনপি আজ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপি আন্দোলনের নামে যা করেছে, তাতে আন্দোলনের কথা শুনলেই জনগণ এখন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তাই দাবি যত যৌক্তিকই হোক, বিএনপির পক্ষে একটি কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলা সত্যি দুরূহ। যুদ্ধে জিততে হলে কখনো কখনো পশ্চাদপসারণ করতে হয়। বিএনপি নেতারা বলছেন, ৫ জানুয়ারির পর তারা কৌশলগত কারণে পিছিয়ে এসেছেন। বেগম খালেদা জিয়া বলছেন, তারা সরকারকে পচার সময় দিচ্ছেন। কিন্তু সরকারকে পচাতে গিয়ে তারা নিজেরাই পচে যাচ্ছেন, সেই খবর কি আছে? স্বাভাবিক হলো, বিএনপি যদি সত্যি ঈদের পর আন্দোলন করতে চায়, তাহলে এই সময়ে তাদের সংগঠন গোছানোর কথা। কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ বা তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। যে কোনো আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি সংগঠনের ঢাকা মহানগর কমিটি। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে মহানগর কমিটির বেহাল দশা। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবেন কী, নিজেরা নিজেরা গ্রুপিংয়ে ব্যস্ত সবাই। আন্দোলনের আরেক মূল ব্রিগেড ছাত্রদল। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বেগম খালেদা জিয়া ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলেছেন। কিন্তু সে অনুযায়ী কোনো অ্যাকশন হয়নি। ছাত্রদল এখন এলোমেলো, দিশাহীন। মির্জা ফখরুল বছরের পর বছর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। সারাদেশেও সংগঠনের একই অবস্থা। কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার প্রেসক্লাবে বিভিন্ন মানববন্ধনে অংশ নিয়ে বড় বড় কথা বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ বিএনপির সকল তৎপরতা। বেগম খালেদা জিয়ার দিন শুরু হয় রাত ৮টায়। সারাদেশ যখন ঘুমায়, তখন জনগণের দল বিএনপি, জনগণের ভাগ্য নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে। বেগম খালেদা জিয়ার যে কোনো খবর নিউজরুমে আসে রাত ১২টায়। এই রকম একটি বেহাল দল করবে ঈদের পর আন্দোলন! শুনলে সত্যি হাসি পায়। একটা চালু জোকস আছে। দেনাদার পাওনাদারকে বলছে, ভাই আপনার টাকা দিয়ে দেবো। কবে দেবেন? যেই মাসে শুক্রবার নাই, সেই মাসে। এখন আমারও বিএনপি নেত্রীর কাছে একই প্রশ্ন, ভাই আন্দোলন কোন ঈদের পরে হবে? আন্দোলন কেন হচ্ছে না জানতে চাইলে বিএনপি নেতারা বলেন, আন্দোলন কিভাবে হবে, ঘর থেকে বেরুলেই তো পুলিশ গুলি করছে। মামলা-হামলা-নির্যাতন চালিয়ে আন্দোলন নস্যাৎ করে দিচ্ছে। সরকার যা করছে তা খুবই খারাপ। গণতান্ত্রিক দেশে এমনটা হওয়া উচিত নয়। কিন্তু সরকার তো চাইবেই যাতে আন্দোলন না হয়। কিন্তু সামরিক শাসনের বিরুদ্ধেও তো এ দেশে আন্দোলন হয়েছে। আশার কথা বিএনপি নেতা হান্নান শাহ বলেছেন, ঈদের পর এমন কঠোর আন্দোলন করবেন যে গুলি করেও আন্দোলন দমন করা যাবে না। আমরা অপেক্ষায় রইলাম, গুলির মুখে বিএনপির আন্দোলন দেখার জন্য।
[লেখক: অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ]
ইমেইল: probhash2000@gmail.com