জীবন এত ছোট কেনে?
প্রভাষ আমিন: ঢাকায় আমার প্রথম দিকের বন্ধুদের একজন জাহিদ নেওয়াজ খান। আমরা জুয়েল নামেই চিনি। একাডেমিক হিসেবে এক বছরের জুনিয়র হলেও প্রগাঢ় বন্ধুত্বে তা বাধ সাধেনি। একসাথে আমরা বিচিন্তায় কাজ শুরু করি। আবার একসাথে ছেড়েও দেই। পরে আবার প্রিয় প্রজন্মে, আবার বাংলাবাজার পত্রিকায় একসাথে কাজ করেছি। খুব দুঃসময়ে ঢাকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত যখন পাক্কা, তখন জুয়েল আমাকে ঠেকিয়েছিল। তখন জুয়েল না ঠেকালে আমি হয়তো এখন গ্রামের চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতাম। ক্যাম্পাসে আমাদের বাউন্ডুলেপনার স্বর্ণযুগে জুয়েল বলতো, আমার অনেক টাকা হলে একটা পার্টি দেবো। সেখানে অঢেল খানাপিনার ব্যবস্থা থাকবে। সবাইকে তরল করে আমি মরে গেলে আমার সম্পর্কে তারা কী বলবে তা জানতে চাইবো। জুয়েলের ধারণা তরল অবস্থায় মানুষ সত্যি কথা বলে। জুয়েলের আইডিয়াটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কয়েকদিন আগে ছড়াকার বন্ধু ওবায়দুল গনি চন্দনের মৃত্যুর পর আইডিয়াটি আমার মাথায় আবার ঘুরপাক খাচ্ছে। চন্দনের লাশের পাশে দাড়িয়ে আমরা অনেকেই তার সম্পর্কে অনেক কথাই বলছি। অনেকে লিখেছিও। কিন্তু চন্দন তো জানতেই পারলো না, আমরা তাকে কতটা ভালোবাসি।
মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, মরে যাওয়ার পরের জগতটা কেমন? যদি একবার মরে গিয়ে সবাই কী বলছে তা শুনে আবার ফিরে আসা যেতো। কী মজাই না হতো। কিন্তু অমোঘ মৃত্যু ওয়ানওয়ে। মজাটা হলো মৃত্যুর পর আমরা সবার সম্পর্কে অনেক ভালো ভালো কথা বলি। ভদ্রতা করে খারাপগুলো আড়াল করে রাখি। অথচ সত্যিটা হলো সব মানুষই ভালোমন্দে মেশানো। ভালোটাই আমরা দেখি, খারাপটা বেশিরভাগ সময় আড়ালেই থেকে যায়। এই যেমন আমি তো জানি, কত অন্ধকার লুকিয়ে আছে আমার ভেতরেও। তবে ৪৫ বছরের পেছন ফিরে যখন তাকাই, একধরনের সন্তুষ্টিই বোধ করি। মানুষের উপকার করার মত ক্ষমতা বা সামর্থ্য হয়নি। তবে কোনোদিন কারো ক্ষতি করিনি। সারাজীবন মানুষকে ভালোবেসেছি, সম্মান করেছি, বোকার মত বিশ্বাস করেছি। আমি বিশ্বাস করি, সারাক্ষণ মানুষকে অবিশ্বাস করে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকার মধ্যেও আনন্দ আছে। আমি নিজেকে খুব সুখী মনে করি। প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে নিজের বিবেকের কাছে একবার জবাবদিহি করি। তারপর নিশ্চিন্তে ঘুম। কে ঠিক করেছেন জানি না, সুখী মানুষের নাকি দুটি মানদন্ড, রাতে নিশ্চিন্তে ঘুম আর ঘুম থেকে জেগে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়া। আমার ইচ্ছাঘুম, ঘুমানোর জন্য কখনোই ঔষধ খেতে হয়নি। আর কখনো ইসবগুলের ভুষিও লাগে না আমার। হা হা হা। নতুন নতুন ইলেকট্রনিক্স ছাড়া আর কিছুর প্রতি লোভ নেই। কোনো না কোনো একদিন গ্রামে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উচ্চাকাঙ্খা নেই। চাওয়া কম বলে না পাওয়ার বেদনাও খুব বেশি পোড়ায় না। যত কম চাওয়া, তত বেশি সুখ। একটাই তো জীবন, তাতে সুখটাই তো আসল। পদ-পদবী, ক্ষমতা, টাকা-পয়সার জন্য মারামারি, কামড়াকামড়ি করে তা নষ্ট করার কোনো মানেই জমহয় না। আমি নিশ্চিত, আমি জানি, আমি বিশ্বাস করি সুখী হওয়ার জন্য, ভালো থাকার জন্য অর্থটা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি খুবই ভাগ্যবান। অনেক স্বজন, অনেক বন্ধু, অনেক সহকর্মীর ‘নিঃস্বার্থ’ ভালোবাসা পেয়েছি। নিঃস্বার্থ বলছি, কারণ যারা আমাকে ভালোবাসেন তারা জানেন, আমাকে ভালোবাসলে বিনিময়ে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই মিলবে না।
আর কত বছর বাঁচবো? ১৫ বছর, ২০ বছর। ইদানিং কোলেস্টেরল, ফ্যাটি লিভার, অ্যাজমা, ব্যাকপেইন- নানা ব্যাধি বাসা বেধেছে। লম্বা জীবন চাই না আমি। যতদিন সক্রিয় ততদিনই বাঁচতে চাই, বিছানায় শুয়ে একদিনও নয়। অতটা পূণ্য করেছি কিনা জানি না। সবচেয়ে ভালো হয়, ঘুমের মধ্যে মরে যেতে পারলে। আর অন্তত ১৫টা বছর বাঁচতে পারলে ভালো। ছেলেটা ততদিনে নিজের পায়ে দাড়িয়ে যাবে। ৪৫ বছরের জীবনে বড় কোনো আক্ষেপ নেই। বয়স না হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ করতে না পারা, একই হাসপাতালে থেকেও কাজী নজরুল ইসলামকে দেখতে না পারা, ৯০এর ২৮ নভেম্বর আম্মা জোর করে কুমিল্লা নিয়ে যাওয়ায় ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদের পতনের মুহুর্তে ঢাকায় থাকতে না পারা, আব্বার সঠিক চিকিৎসা করাতে না পারা, নিজের গাড়ি এবং প্রসূনের জন্মের আগেই আব্বার চলে যাওয়া, সবকিছু ছেড়ে আমার কাছে চলে আসা মুক্তিকে স্বাচ্ছন্দ্য দিতে না পারা- অপ্রাপ্তির তালিকা খুব ছোট। কিন্তু প্রাপ্তির তালিকা অনেক লম্বা। খালি আফসোস, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, কত বই এখনও পড়া হলো না, কত ছবি এখনও দেখা হলো না, কত গান এখনও শোনা হলো না, প্রকৃতির কত রূপ এখনও দেখা হলো না। আহা, জীবন এত ছোট কেনে?
[লেখক: অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ]
ইমেইল: probhash2000@gmail.com