আমিনুল হক বাদশাও কি সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে যাবে?
হেফাজুল করিম রকিব: সাংবাদিক ও লেখক আমিনুল হক বাদশা লন্ডনের কেন্টের অরপিংটনের ফানবারা হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। অথচ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তার প্রতি কি দায়িত্ব পালন করতেছে? নেই হাইকমিশনের দায়িত্ব- নেই তার আপনমানুষগুলো দায়িত্ব। মনে হয় সময়ের বিবর্তনে বাদশা ভাইও হারিঁয়ে যাবে। যে মানুষটি স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে অনন্যা ভূমিকা রেখেছে। সাংবাদিক হিসেবেও রেখেছে অনেক অবদান। তিনি কথা বলতে পারছেন না। হাসপাতাল বেডে তাকে দেখতে গেলে চেতন-অবচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়। অবেচতন অবস্থায় তাকে ডাক দিলে প্রথমে কোনই সাড়া নেই, কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে সামনে দেখে তার সেই পরিচিত হাসি উপহার দেন। এরপর আবারও চোখ বন্ধ। কিছুক্ষণ পর আবারো চোখ খুললে কিছুটা ভালোভাবেই কিছুক্ষণ কথা বলেন। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আমিনুল হক বাদশা দীর্ঘ মাস খানেক ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আরো দুই দুই বার বাইপাস অপারেশন ও হৃদপিন্ডে বাল্ব সংযুক্ত করার পরও আবারও হৃদরোগে আক্রান্ত হন বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রটারির দায়িত্ব পালনকারী সৌভাগ্যবান এই সাংবাদিক। সেই থেকে হাসপাতালই এখন তার আপাতত স্থায়ী নিবাস। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে এসেও আমিনুল হক বাদশাকে দেখতে না যাওয়ার ঘটনায় চলতেছে নানা সমলোচনা। তাহলে কি প্রধানমন্ত্রী জানেন না, তাদের দায়িত্ব তারা কি জানান নাই? নাকি জেনেও আসেন নাই সেই প্রশ্ন ঘুরপাক কাচ্ছে সবার মনে ।
তাকে আমি চিনি ২০১০ থেকে। তখন এটিএন বাংলা ইউকে কাজ করি। হঠাৎ দুপুরে একদিন এটিএন বাংলা ইউকে বাদশা ভাই। উনি অফিসে ঢুকার পর জমজামট আড্ডা শুরু হলো। আমিও সেই আড্ডায় বসার সুযোগ পেলাম। তখনও আমি জানতামনা উনি কোন পর্যায়ের মানুষ। আড্ডার শেষ পর্যায়ে হঠাৎ জিঞ্জেস করলো তুমি কি করো। তখন আমার কলিগ কাদের ভাই পরিচয় করে দিল আমাকে। পরে কাদের ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারলাম উনার গর্বিত জীবনের নানা দিক। এরপর থেকে মাঝে মাঝে বিভিন্ন কমিউনিটির প্রোগ্রামে দেখা হতো বাদশা ভাইয়ের সাথে। উনি যে দল সমর্থন করতেন সে দল দুইবার ক্ষমতায় আসলেও উনি কখনও সুবিধা ভোগ করেননি এবং উনাকে দলও মূল্যায়ন করেনি। তবে মজার একজন মানুষ। নতুন প্রজম্মকে খুব বেশী উৎসাহ দেয়ায় উনার কাজ ছিল। প্রবাসীদের সব সময় শেকড়ের বন্ধনে আবন্ধ রাখতে কাজ করে যেতো কমিউনিটিতে। কমিউনিটিতে বাদশা ভাইয়ের বিচরণ চোখে পড়ার মতো ।
খোন্দকার আমিনুল হক, কিন্তু তিনি বাদশা নামে সবজায়গায় পরিচিত। বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি ও কমনওয়েলত সাংবাদিক এসোসিয়েশন ইউরোপের এর নির্বাহীসদস্য। তিনি একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবার থেকে আসা। পিতা খন্দকার লুতফুল এবং মা সকিনা বেগম । ১৯৪৪ সালের ২৪ অক্টোবর কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছেন তিনি। উনার পিতা একজন আইনজীবী এবং বড় ভাই একজন সাংবাদিক, অভিনেতা এবং মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর অন্যান্য ভাইরা বিভিন্ন পেশায় ছিলেন। বাদশা ভাই ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হউন। সমাজবিজ্ঞানে এম এ সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর কারাগার থেকেও স্নাতক পাশ করেন। ইংল্যান্ডেও সম্পন্ন করেন আরেকটি এম এ। পাকিস্তানি সামরিক শাসক আইয়ুব খানের সময় ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত থাকার কারণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারাগারে থাকতে হয়। তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাংগঠিক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধাও। বাদশা ভাই মুজিব নগরের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বাংলাদেশের স্বাধীনতা রেডিও ষ্টেশনের প্রতিষ্টাতা এবং মুজিব নগর বাংলাদেশ মিশনের বাহ্যিক প্রচার বিভাগের ডিরেক্টর ছিলেন। আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সেক্রটারি নিযুক্ত হয়। ইউ কে আসার আগ পর্যন্ত তিনি প্রেস সেক্রটারি ছিলেন। ১৯৭৫ সালের শেষ দিকে তিনি লন্ডনে চলে আসেন। তিনি ভারত, বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ড এর বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া এটিএন বাংলা ইউকে তে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেন। বিবাহিত জীবনে দুটি সন্তান রয়েছে। একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে। তিনি সৎ সাংবাদিকতা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন এবং যেটা বিশ্বাস করতেন সেটার জন্য জীবন দিতেও দ্বিধাবোধ করতেনা। তিনি চারটি বই লিখেছেন এবং অনেক বাংলা ছবিতেও অভিনয় করেছেন। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসের অংশ এই প্রবীণ সাংবাদিক বঙ্গবন্ধু পরিবারের একজন সদস্যের মতোই ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের সেই ঐতিহাসিক জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে যেসব ছাত্রনেতা মঞ্চে ছিলেন তাদেরই একজন আমিনুল হক বাদশাহ। যাকেই শেখ মুজিব অনেক বেশি পছন্দ করতেন ।
লেখক লুৎফুর রহমান তার বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে চায়ের বিজ্ঞাপন! লেখায় লিখেন স্বাধীনতার পর ভারতে বাংলাদেশের যে সমস্ত নোট মুদ্রিত হতো, তার মধ্যে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি পাওয়া গেলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে বঙ্গবন্ধুর ছবিসংবলিত নতুন নোট বাজারে ছাড়া হবে। এ উদ্দেশ্যে দেশের বিশিষ্ট আলোকচিত্রশিল্পীদের কাছে বঙ্গবন্ধুর অনেক ছবি ছিল। তার থেকে একটি ছবি আমি প্রেস ডিপার্টমেন্টে জমা দিই। পরবর্তী সময়ে ছবি নির্বাচন করা হলে দেখা গেল আমার জমা দেওয়া ছবিই মনোনীত হয়েছে। খুশিতে আমার তখন দিশেহারা হয়ে যাওয়ার অবস্থা। আমার নিজের হাতের তোলা বঙ্গবন্ধুর ছবি পাঁচ টাকা ও দশ টাকার নোটে মুদ্রিত দেখতে পেলাম। ওই ছবির সম্মানী হিসেবে নোট মুদ্রণকারী বিদেশি সংস্থা হোটেল শেরাটনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আমার হাতে একটি দামি ক্যামেরা তুলে দিল। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে তার প্রেস সেক্রেটারি আমিনুল হক বাদশা সচিবালয়ে ডেকে নিয়ে আমাকে নগদ ৩ হাজার টাকা তুলে দিলেন। তিনি বললেন, ‘এ টাকার পুরস্কার বড় কথা নয়, তার চেয়ে বড় পুরস্কার সব জায়গাতে সবার হাতে হাতে আপনার ছবি থাকবে।’ বাস্তবিকই তাই। আমার তোলা ছবি সবচেয়ে মূল্যবান জায়গায় স্থান পেয়েছে। একজন ফটোপ্রাফারের জীবনে এর চেড়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে।
কেন একজন জাতীয় সাংবাদিক নয় – লেখাতে মতিউর রহমান চৌধুরী লিখেছেন, পাকিস্তানের কারাগার থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে এলেন ১০ই জানুয়ারী। পরদিনই প্রেস সেক্রেটারি, সাংবাদিক ও লেখক আমিনুল হক বাদশা দিয়ে এবি মুছা ভাইকে ডাকানো হয়। এখানে শুধুমাত্র দুই একটা বিষয় তুলে ধরলাম বাদশা ভাই কি ছিলেন। এভাবে হাজার হাজার লেখাতে বাদশার ভাইয়ের না এসেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বাদশা ভাই কোন অংশে কম নয়। তাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে তিনি উৎপুত ভাবে জড়িত। যে জাতি বা যারা সত্যিকারের বাদশা ভাইদের মুল্যায়ন করতে পারবে না, তাদেরকে কেউ মুল্যায়ন করবে? সেটা আমার বিশ্বাস হয় না। দোয়া করি বাদশা ভাই ভালো হয়ে উঠেন – বাংলাদেশকে আপনি এখনোও অনেক কিছু দিতে পারবেন ।
[হেফাজুল করিম রকিব: প্রবাসী সাংবাদিক]
লন্ডন,১৮/১০/২০১৪.