সাংবাদিকতার ঘোর কলিকাল
লুৎফর রহমান হিমেল:
এক.
এক পথচারি এক বাসায় গিয়ে পানি চাইল। বাসার এক কিশোর বারান্দায় এসে…
কিশোর : পানি নেই। লাচ্ছি চলবে?
পথচারি : অবশ্যই। অনেক শুকরিয়া। লোকটি ৫ গ্লাস লাচ্ছি সাবাড় করে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের বাসায় কেও লাচ্ছি খায় না নাকি?
কিশোর : জী খায়।। কিন্তু আজ লাচ্ছিতে টিকটিকি পড়ে গেছে, তাই কেউ খায়নি!
এ কথা শুনে পথচারির হাত থেকে গ্লাস গেলো পড়ে! কিশোর কাঁদতে কাঁদতে বলল, ইনিই গ্লাসটি ভেঙ্গে ফেলেছেন! এখন কুকুর দুধ খাবে কিসে!
দুই.
সাংবাদিকতাকে মহান পেশা বলা হয়। যখন মহান শব্দটার অর্থই বুঝতাম না, তখন সেই ছোটকাল থেকে শুনে আসছি এটা। তবে এখন বুঝি, পেশাটাকে মহান রাখতে গেলে সাংবাদিককেও মহান হতে হয়, এটাই এক এবং একমাত্র শর্ত। এর অন্য কোনো শর্ত নেই। তবে বর্তমানে বেশিরভাগ সাংবাদিকের একমাত্র এই শর্তপূরণের যোগ্যতা নেই। (সংবাদ লেখার যোগ্যতা সাংবাদিকের মৌলিক যোগ্যতা। তাই এ নিয়ে এখানে আলোচনা করে লেখার কলেবর বড় করলাম না। এটা যার নেই, সে তো সাংবাদিকই না।)
যাই হোক, সাংবাদিকদের বিরাট একটি অংশের কারণে আজ এ পেশার প্রতি সবার শ্রদ্ধা কমে গেছে। এখন লোভ-মোহ-স্বার্থহীন সাংবাদিক খুঁজতে হারিকেন লাগে। আমি পিআইডির একটি গবেষণা কাজের জন্য ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল নাগাদ এ দেশের সকল পত্রিকার উল্লেখযোগ্য ক্লিপিংস পড়ার বিরল সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই ক্লিপিংসগুলো পড়ে পাকিস্তানি আমলেও অনেক সাংবাদিকের নির্মোহ, নির্ভীকতার নমুনা দেখেছি নিউজ কিংবা সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয়তে। তাদের লেখার বিশাল ভক্তশ্রেনী তৈরি হয়েছিল তখন। তাদের উপ-সম্পাদকীয়গুলোও ছিল এক কথায় ক্ষুরধার, তুলনাহীন। তাঁদের নির্ভীকতায়, তাঁদের চিন্তার স্বচ্ছতায়, তাঁদের প্রাঞ্জল লেখায়, তাঁদের জ্ঞানের গভীরতায় মুগ্ধ হতো পাঠক।
৮০’র দশকে মফস্বলের এক সাংবাদিকের লেখনীতে গোটা দেশের পাঠককূল যারপর নাই আকৃষ্ট হতেন। পাঠকরা তখন উন্মুখ হয়ে থাকতেন তার লেখা পড়ার জন্য। ৯০’র দশকেরও নির্ভীক-সৎ-দাপুটে সাংবাদিকরা এ ক্ষেত্রে বিচরন করেছেন। আর এখন শাদা মনের নিবেদিতপ্রাণ, সৎ সাংবাদিকের সংখ্যা হাতের কড় দিয়ে গোনা যায়। (আমাকে আবার জিজ্ঞেস করবেন না, তারা কারা। সবাই জানেন তাদের সম্পর্কে।)
এখন সব সাংবাদিকের কাছে শাদা রঙ শাদা দেখায় না। কেউ তা দেখেন ধুসর, কিংবা কালো; আবার কেউ দেখেন নীল, হলুদ! এখন শাদাকে শাদা দেখনেওয়ালা, কালোকে কালো বলনেওয়ালা সাংবাদিকের বড্ড দরকার। যাঁরা অন্যায় দেখলেই তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন, সমালোচনা করবেন। কিন্তু অদ্ভূত এক মন্ত্রবলে সবাই পুতুল এখন। রাজনৈতিক বীট ও অর্থনীতি বিটের কথাই ধরুন। রাজনৈতিক বীটের সাংবাদিকেরা একেকজন যেন দলীয় কর্মী। অর্থনীতি বীটের রিপোর্টার একটি বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির নিউজ করলে, সে আর ফলোআপ দেয় না। এখানেই ঘাপলাটা। অনেক পাঠকই তখন বুঝে যান, বিষয়টা সমঝোতায় গড়িয়েছে। কূটনৈতিক বীটের অবস্থাও তথৈবচ। কেউ বিদেশ সফরের উপঢৌকনে, কেউ সামাণ্য মাসোহারার বিনিময়ে, কেউ প্লট-ফ্ল্যাট লাভের মাধ্যমে নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছেন। যারা বিক্রিত, তাদের থেকে আপনি ‘মহান পেশার’ সার্ভিস আশা করতে পারেন না।
পুণশ্চ:
উপরের গল্পের লাচ্ছি খাওনেওয়ালা পথচারির মতো সাংবাদিকের সংখ্যাও দিনকে দিন বাড়ছে।
অনুশোচনা :
সবকিছুতেই পজেটিভ কিছু খুঁজি আমি। গ্লাসের আধেকটা খালি থাকলেও ভরা অংশটাই দেখতে পাই। ইদানিং এ পেশা নিয়ে ”মন্দের ভাল”র মতোও কিছু পাই না। পেলে আবারও লিখব, কথা দিচ্ছি।
[লুৎফর রহমান হিমেল: সম্পাদক,পরিবর্তন ডট কম এবং বার্তা সম্পাদক,দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন]