প্রখ্যাত সাংবাদিক নির্মল সেন-এর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী
নিজস্ব প্রতিনিধি,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা কমরেড নির্মল সেন-এর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী ৮ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার)। বিপ্লবী রাজনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা, প্রখ্যাত সাংবাদিক, কলামিস্ট ও লেখক কমরেড নির্মল সেন ১৯৩০ সালের ০৩ আগস্ট গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার দিঘীরপাড় গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সুরেন্দ্রনাথ সেন গুপ্ত। মায়ের নাম লাবণ্যপ্রভা সেন গুপ্ত। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে নির্মল সেন ছিলেন ৪র্থ। নিজ বাড়ির পাঠশালায় শিক্ষাজীবন শুরু করেন নির্মল সেন। তিনি কোটালীপাড়া ইউনিয়ন ইন্সটিটিউশনে ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত এবং টুঙ্গিপড়ার পাটগাতী এম.ই স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরে বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জের কলসকাঠী গ্রামে তাঁর পিসিমার বাড়িতে চলে যান। সেখান থেকেই ১৯৪৪ সালে কলসকাঠী বি.এম একাডেমী থেকে তিনি প্রবেশিকা পাশ করেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ হলে মা, ভাই বোন সবাই চলে যান ভারতে। কিন্তু তিনি থেকে যান মাতৃভূমিতেই। ১৯৪৮ সালে বিএসসি পড়ার সময় ছাত্র আন্দোলন করতে গিয়ে রাজবন্দী হিসেবে গ্রেফতার হন। পরে জেল থেকে ছাড়া পান ১৯৫৩ সালে। কারাবন্দী থাকার কারণে বিএসসি পরীক্ষা দিতে না পেরে পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে জেলে থেকেই বিএ পাশ করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম. এ পাশ করেন।
১৯৪২ সালে ৯ম শ্রেণিতে পড়াকলীন সময়েই ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শরু হয় নির্মল সেনের রাজনৈতিক জীবন। নির্মল সেন সেই আন্দোলনেই টানা ১৬ দিন স্কুলে ধর্মঘট করেন। ১৯৪৪ সালে তাঁর যোগাযোগ হয় আরএসপি’র (রেভ্যুলেশনারি সোস্যালিস্ট পার্টি) সাথে। ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে প্রথম গ্রেফতার হন। ১৯৫২ সালে জেলে থাকাবস্থায় এম.এ আউয়ালের অনুরোধে পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগে যোগ দেন। তবে নির্মল সেন ছাত্রলীগে যোগদানের শর্ত হিসেবে এম.এ আউয়ালের কাছে পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়ার দাবী করেন। সেই দাবী মেনে নেয়ায় তিনি ছাত্রলীগে যোগ দেন। ১৯৫৩ সালে তিনি বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এ সময় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন পরবর্তীতে বিচারপতি গোলাম রাব্বানী। ১৯৫৪ সালে নির্বাচিত হন পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দপ্তরসম্পাদক। আরএসপি’র নির্দেশে ১৯৫৬ সালে ছাত্রলীগ ছেড়ে ছাত্র ইউনিযনে যোগ দেন। ১৯৬০ সালে নির্মল সেন পূনরায় আরএসপিতে ফিরে আসেন। ১৯৬৯ সালে আদমজী জুট মিলে রুহুল আমিন কায়সার, খান সাইফুর রহমান, নির্মল সেন, ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, নেপাল নাগ এবং সিদ্দিকুর রহমানের নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দল নামে একটি বামপন্থী রানৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি দলের সাধারণ সম্পদক নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের বৃহৎ শ্রমিক সংগঠন সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশন গড়ে তোলায় নির্মল সেন সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নির্মল সেন। সামরিক শাসন-বিরোধী আন্দোলনে গঠিত বামপন্থীদের ৫ দলের নেতৃত্ব দেন কমরেড নির্মল সেন। বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠনেও নির্মল সেন নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২০০৮ সালে গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন। আমৃত্যু তিনি গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
নির্মল সেনের সাংবাদিকতা ও লেখালেখি শুরু হয় ৮ম শ্রেণিতে পড়াকালীন ‘কমরেড’ পত্রিকার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৬ সালে তিনি পেশাদার সাংবাদিকতায় যুক্ত হন। কাজ শুরু করেন দৈনিক জেহাদে। ১৯৬১ সালে ইত্তেফাক পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালের ৬ অক্টোবর দৈনিক পাকিস্তান, পরবর্তীতে দৈনিক বাংলা পত্রিকায় একটানা ৩৩ বছর সাংবাদিকতা করেন। প্রেস ট্রাস্টের এই পত্রিকাটি ১৯৯৭ সালে বন্ধ হওয়ার দিন পর্যন্ত নির্মল সেন এই পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭২-৭৩ সালে নির্মল সেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ও ১৯৭২-৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ফেডালের সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য। এছাড়াও নির্মল সেন প্রায় ৮ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অতিথিশিক্ষক ছিলেন।
দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সাংবাদিকতা জীবনে নির্মল সেন একাধিকবার জেল খেটেছেন। বিভিন্ন দাবী-দাওযা নিয়ে অনশন করেছেন। ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসে নির্মল সেন প্রথম জেলে যান। জেলে থাকা অবস্থায় ১৯৪৯ সালে বন্দিদের বিভিন্ন দাবী নিয়ে নির্মল সেন ৬ দিন অনশন করেন। এর পরে মে মাসে রাজবন্দীদের দুইভাগে বিভক্ত করার প্রতিবাদে নির্মল সেন ২৪ দিন অনশন করেন। সে অনশন ভাঙ্গিয়ে ছিলেন ফকির আব্দুল মান্নান। কিন্তু তার পরেও নির্মল সেনের দাবী না মানায় তনি একই বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ৪০ দিন অনশন করেন। সে অনশন ভাঙ্গিয়েছিলেন মনোরঞ্জন ধর ও ফকির আব্দুল মান্নান। এরপরেও নির্মল সেনের দাবী না মানায় ১৯৫০ সালে তিনিসহ আরও রাজবন্দী ৫২ দিন অনশন করেন। এ সময় তাদের কিছু দাবী মানা হয়। এরপর ১৯৯৭ সালে নির্মল সেন দৈনিক বাংলা বন্ধের প্রতিবাদে এবং সাংবাদিকদের বেতনভাতার দাবীতে অনশন করেন। সরকার সিদ্ধান্ত নেয় প্রেস ট্রাস্টের ৪টি প্রত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার। এ সময় নির্মল সেন সাংবাদিকদের বেতন-ভাতার দাবিতে টানা ৯ দিন অনশন করেন। কিছু সাংবাদিকও তাই চেয়েছিলেন। কিন্তু সংসদে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন ৪টি পত্রিকার সাংবাদিক কর্মচারীদের পাওনা মিটিয়ে দিয়ে পত্রিকাগুলো বন্ধ করা হবে কিন্তু বাস্তাবে তা হলো না। সরকার একটি নতুন তত্ত্ব আনলেন। সেটা হচ্ছে গোল্ডেন হ্যান্ডসেক। তার অর্থ হচ্ছে যেমন খুশি টাকা দিয়ে সাংবাদিক কর্মাচারীদের বিদায় করে দেয়া। এতে নির্মল সেন রাজি হলেন না। সিদ্ধান্ত নিলেন অনশন করবেন। প্রেসক্লাবে অনশন শুরু করলেন। প্রথম রাতেই আর্মি এলো। সাংবাদিকদের প্রতিরোধের মুখে আর্মিরা চলে গেল। ক’দিন পরে ঢাকার হকাররা সিদ্ধান্ত নিলো তাঁর দাবী না মানলে তারা প্রেসক্লাব ঘেরাও করবে। সে দিন রাতে ১২টায় আর্মির গাড়ি এসেছিলো। তারা জোর করে নির্মল সেনকে সিএমএইচ-এ নিয়ে যাবে। তাঁর বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলো সিএমএইচ-এ নয়, পিজিতে নিলে আপত্তি নাই। কারণ পিজি প্রেসক্লাবের কাছাকাছি। তাই নির্মল সেনকে গভীর রাতে পিজিতে নিয়ে গেলেন। ৯দিন অনশন করার পরে সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ নির্মল সেন-এর অনশন ভাঙ্গান। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ৫ দলীয নেতা হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
১৯৭১ সালে স্বাধীকার আন্দোলনে নির্মল সেন সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি আগরতলা ক্যাম্পসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধচলাকালীন সময়ে তিনি একাধিকবার আগরতলা থেকে ঢাকায় এসে তরুণদের সংগঠিত করেন এবং ভারতের আগরতলায় আরএসপির সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন। সাংবাদিকদের নেতা হিসেবে নির্মল সেন ভারত, জার্মান, রাশিয়া, হাঙ্গেরি, নেপাল, যুগোস্লোভিয়া, চেকোস্লোভেকিয়া ভ্রমণ করেন। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, সুইজারল্যান্ড, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, চীনসহ বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন। তাঁর ‘মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্র’, ‘বার্লিন থেকে মস্কো’, ‘পুর্ববঙ্গ-পূর্বপাকিস্তান-বাংলাদেশ’, ‘মা জন্মভূমি’, ‘লেনিন থেকে গর্ভাচেভ’, ‘আমার জবানবন্দী’, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’ ও ‘আমার জীবনে ৭১-এর যুদ্ধ’ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। ২০০৩ সলের ১১ অক্টোবর নির্মল সেন ব্রেইনস্ট্রোকে আক্রান্ত হন। তাঁর জীবনের শেষ ইচ্ছা নিজ বাড়িতে একটি মহিলা কলেজ স্থাপন করা। কলেজটির নামকরণ করা হয়েছে সাংবাদিক নির্মল সেন মহিলা কলেজ। জীবদ্দশাতেই তিনি কলেজটির জন্য তাঁর বাড়ির ১ একর ৫০ শতক জায়গা রেজিস্ট্রি করে দিয়েছিলেন।
নির্মল সেন কয়েক দিন হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জালড়ে গত ৮ জানুয়ারি ২০১৩, সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিটে পরলোক গমন করেন। চিকিৎসাশাস্ত্রের উৎকর্ষে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতার জন্যে মৃত্যুর আগে তিনি নিজ দেহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করে গেছেন।