‘বিন্দু বিন্দু ভালোবাসা’র সুখ বনাম ‘সিন্ধুসম দুঃখ’
সোহরাব শান্ত: ছেলের ফ্লাইট ছিল সকাল ৮টায়। গন্তব্য ভারতের শিমলা। সেখানে সে পড়াশোনা করে। দেড় মাসের ছুটি শেষে শিমলাযাত্রার সময় এলো। দেশে এই সময়টা খুব উত্তপ্তও বটে। অপরাজনীতির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। যত্রতত্র পেট্রল বোমায় আগুণ লাগছে গাড়িতে। মুহুর্তে তাজাপ্রাণগুলো ছটপট করতে করতে, জ্বলে-কুকড়ে শেষ! এমন নিষ্ঠুর সময়েও অসুস্থ মা তার শিমলাগামী ছেলেকে ফ্লাইটে তুলে দিতে ‘হুইলচেয়ার সমেত’ গাড়িতে উঠলেন, খুব ভোরে। আদরের একমাত্র ছেলেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত পৌঁছে না দিতে পারলে যে তার কষ্ট বাড়বে বৈ কমবে না!
ঢাকার শাহজালাল (র.) আন্তর্জাাতিক বিমানবন্দর থেকে ইস্কাটনের দূরত্ব বেশি নয়। গাড়িতে কতটুকু সময়ই বা লাগে। কিন্তু ছেলেকে বিদায় দিয়ে ফেরার সময়টা যেন ফুরোতে চায় না। বাসায় ফিরে সেই কষ্টের কথা শেয়ার করলেন মা। তাঁর ফেইসবুক ওয়ালে লিখলেন- ‘বুবাই শিমলা চলে গেল। দেড়টা মাস কোনদিক দিয়ে চলে গেল জানিনা! যোগাযোগের এতো মাধ্যম। সন্তানকে চোখের সামনে থেকে দেখার আনন্দ কী এসবে দিতে পারে?’ আহা! মায়েরা, বাবারা সন্তানদের কতটা ভালোবাসেন। বিন্দু বিন্দু ভালোবাসায়, কখন ভালোবাসার মহাসাগর তারা গড়েন- তা যদি সন্তানরা বোঝার চেষ্টা করতাম!
এতক্ষণ যে মা-ছেলের কথা হচ্ছিল তারা হলেন, আমার সাবেক বস শ্রদ্ধেয় রুমা (রেহানা পারভীন) আপা ও তার ছেলে শেখ সামির ইয়াসার (বুবাই)। ভালোবাসাপূর্ণ একটি পরিবার তাদের। বুবাই হয়েছে তার বাবার মতোই। শ্রদ্ধেয় টুটুল (শেখ নজরুল ইসলাম) ভাই স্বল্পভাষি, সৎ ও স্বজ্জন মানুষ। রুমা আপা কিছুটা আমুদে বটে। আপাদমস্তক ভালো ও সৎ মানুষ। তাঁদের ছেলে ‘বুবাই’র আচরণ ২ জনের আচরণের শংকর! খুব চেনা কেউ না হলে আমোদ সামলে রাখতে জানে। নিজের দায়িত্বটাও বোঝে। পরিবারের ৩ সদস্যই যেন অন্য গ্রহের মানুষ। আমার দেখা নানা ধরণের মানুষের সঙ্গে তাদের কোনোভাবেই মেলাতে পারি না। ৬ বছর ধরে চিনি তাদের। বড় বেশি মানবিক। এতটা সময়ে কোনো আচরণ একটুও মেকি মনে হয় নি। ভেতর-বাইরে একরকম। সন্তান বুবাইকে তারা গড়েছেন তিলে তিলে। মানুষের মতো মানুষ করে। বাবা-মার প্রতি বুবাই যতটা ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখায় এ যুগে তা বিরল। নিজের কাজ নিজে করে নিতে তথাকথিত লজ্জা তাকে স্পর্শ করে না। ’অমুক জিনিসটা দিলে এটা করবো, না দিলে তমুকটা করবো’ টাইপের বায়না সম্ভবত ও ধরেনা। আমি যতটুকু চিনি সেই ধারণা থেকেই বললাম। শহরে বেড়ে ওঠা বেশিরভাগ ছেলেমেয়েদের একটা অংশ আজকাল যা করে সেরকম নয় একদমই। শিমলা থেকে নিশ্চয়ই সাফল্যের সঙ্গে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করেই সে দেশে ফিরবে। মা-বাবার ভালোবাসার মূল্যায়ণ যে তাকে রাখতেই হবে।
‘শহরে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়ে’ বলতে আমি যা বুঝালাম তা একটা ‘প্রশ্ন’। নেতিবাচক কিছু ধারণা করে এদের কেউ ক্ষেপে গেলেও অবাক হবো না। সে ব্যাখ্যায় পড়ে আসছি। আগে স্বীকার করে নেওয়া ভালো- ’বোবাই’র মতো অনেক ছেলেমেয়ে এই ঢাকামহানগরীতে আছে। তারা আছে বলেই এখনো আমরা বলছি- ‘শহরে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের একটা অংশ’! সবার কথা নেতিবাচকভাবে বলছি না। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে নেতিবাচক ছোঁয়া গ্রামের ছেলেমেয়েদের মধ্যেও সংক্রমিত হচ্ছে।
ঢাকায় আমার পরিচিত অন্য একটা পরিবারের কথা বলি এবার। মা-বাবা দুজনই নিম্নপদস্থ সরকারি কর্মচারি। ৫ ছেলেমেয়ের ২ জনের বিয়ে দিয়েছেন। ছোট ছেলে এবার এইচএসসি পাশ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সে পরীক্ষায় দেয় নি। ‘জেদ’ ধরেছে- বেসকারী ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। কোত্থেকে টাকা আসবে, কি করে নিয়মিত খরচ আসবে। বাসাভাড়াসহ সাংসারিক অন্যান্য খরচ কোত্থেকে আসবে এসব নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। যেকোনো মূল্যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিতে হবে, এই তার সাফ কথা। উল্লেখ্য, সংসারে তার বিয়ের উপযোগি একটা বোন আছে। অন্য এক বোন এইচএসসি প্রথম বর্ষে পড়ছে। এছাড়া তার বাবা-মার দত্তক নেওয়া অন্য একটি পথশিশুও ওই পরিবারটির সদস্য। বড় ভাই বিয়ের পর থেকে আলাদা সংসার পেতেছেন। এতটুকু বর্ণনা শুনে কেউ ধারণা করতে পারেন- ছেলেটা হয়তো বেয়ারা টাইপ। মা-বাবার অবাধ্য। মোটেও তা নয়। ছেলে খুবই ভালো। কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। তার বন্ধু-বান্ধব প্রায় সবাই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাদের সঙ্গে তার ’স্ট্যাটাস’ মেলানো চাই! মা-বাবাকে চাপে রেখে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মোটা অঙ্কের খরচে’ ভর্তি হওয়ার উদ্দেশ্য ওই সামন্য কারণই! ‘সামান্য’ বললাম বটে। কিন্তু তা আসলেই কী সামান্য?
আমার ফেইসবুক দুনিয়ায় নানা বয়সী লোকের বিচরণ। আমার ফেইসবুক বন্ধুদের বড় একটা অংশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া। তাদের প্রায় সবাই মেধাবী ও ভালো। কিন্তু মূল সমস্যা এই ’স্ট্যাটাস জনিত’। অমুকের এটা আছে, আমার নেই কেন? তমুক ওটা করছে আমি করবো না কেন- করতে পারবো না কেন? এ ধরণের আত্মজিজ্ঞাসায় ভোগে তারা। কোনো বিষয় চাওয়ামতো না হলেই মা-বাবার সঙ্গে চলে মনোমালিন্য, উচ্চবাচ্য। প্রশ্ন যখন টাকার, তখন তারা ভাবতে চায় না, মা-বাবার সামর্থ ও বাস্তবতার কথা। একটা সময় তা রূপ নেয়, ঔদ্যত্ত্বে। ভালো ছেলেটি বা মেয়েটি হয়ে ওঠে মা-বাবার দুশ্চিন্তার কারণ। পরিবারের ইচ্ছা-সামর্থ ও সম্মানের চেয়ে ছেলেমেয়ের ‘নেতিবাচক জেদ’ যখন বড় হয়ে ওঠে, তখন বিন্দু বিন্দু ভালোবাসায় গড়ে ওঠা বিশ্বাস ও আবেগের জায়গায় চলে আসে ‘সিন্ধুসম দুঃখ’।
কোনো মা-বাবা এমন দুঃখ বয়ে বেড়াতে পছন্দ করেন না। কিন্তু প্রযুক্তির ভালোদিকটাকে পায়ে ঠেলে নেতিবাচকভাবে যখন ব্যবহার করা হয় তখন তার শিকার হতেই হয়। মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগের অনলাইনভিত্তিক মাধ্যমগুলো মানুষের দুঃখবোধ বাড়িয়ে দিচ্ছে। মনের অজান্তেই আমরা হয়ে পড়ছি ’ভোগবাদি’। শিশু-কিশোর ও তরুণরা এর সহজ শিকার। সারাক্ষণ ফেইসবুকে দেখছে অমুক নতুন জামা পড়ে ছবি পোস্ট করলো। অমুক এ সপ্তায় দু’বার রেস্টুরেন্টে খেলো। আমি গত একমাসেও পারি নি। ধূর, এটা কোনো জীবন। অমুক সুন্দরী ’জিএফ’ জুটিয়ে কী সুন্দর ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার বেলায় কেন নেই? তমুকের ’বিএফ’ কী স্মার্ট আর টাকাওয়ালা, আমারটা ম্যারম্যারা!- এ ধরণের চিন্তায় সৃষ্টিশীল চিন্তা করার সময় বের করাই অনেকের জন্য কঠিন।
এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ুয়া কোনো মেয়ে যখন ফেইসবুকে তথ্য গোপন করে ‘শিকার’ করে দেশের নামকরা কোনো পাবলিক বিশ্বাবিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষককে, তাও যিনি তার দ্বিগুণ বয়সী-তখন কী ব্যাখ্যা আছে মনোবিদদের কাছে! মেয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পড়ছে- এমন তথ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকও খুশিতে আটকানা হয়ে বন্ধুদেরকে মেয়ের ছবি দেখিয়ে বেড়িয়ে, পরে লজ্জায় পেড়েছেন। এই ঘটনা কোনো গল্প থেকে নেওয়া নয়, আমার পরিচিত গন্ডিতেই (ফেইসবুক) এদের বিচরণ। শুধু তাই নয়, দেখা গেল ঘটনা ‘ত্রিভূজ প্রেমের’ জটিলতায় রূপ নিল। পূর্বের প্রেমিকের সঙ্গে সম্পকৃ থাকাবস্থাতেই মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে পটিয়ে প্রেমে ফেলে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষন তার প্রকৃত প্রেমিকের চেয়ে তুলনামূলক প্রতিষ্ঠিত ও বেশি টাকার মালিক। প্রকৃত প্রেমিক ঘটনা জানার পর উচ্চবাচ্য শুরু করলে মেয়ের বাবা হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হন। তিনি মেয়ের পক্ষ হয়ে ‘প্রকৃত প্রেমিকের’ কাছে ক্ষমা চান। কতটা লজ্জায় মেয়েটি তার ডাক্তার বাবাকে ফেলেছে ভাবা যায়? বলা হয়ে থাকে- ‘পিতার কাধে সন্তানের লাশ সবচেয়ে ভারী বস্তু’। সন্তানের অপকর্মে বাবা-মা কারো কাছে ক্ষমা চাইতে হলে তাও সম্ভবত ততটাই ভারী কাজ। আর এ ধরণের ঘটনায় বাবা-মার মনে যে ‘সিন্ধুসম দুঃখ’ ভর করে, তা থেকে তারা সম্ভবত কখনোই মুক্তি পান না! সকল মা-বাবা যেন সন্তানদের নিয়ে গর্ব করতে পারেন এই আমাদের প্রত্যাশা।
[সোহরাব শান্ত : সাংবাদিক ও লেখক]
sohrabshanto@gmail.com