বসন্ত আসুক তোমাদের জন্য…
জবরুল আলম সুমন: একটা সুপার সনিক কম্পিউটারের থেকেও নাকি মানুষের স্মৃতি ধারণ ক্ষমতা কয়েক লক্ষ গুণ বেশী ! মানুষের কার্যক্ষমতা কম্পিউটারের মত তড়িৎ না হলেও কম্পিউটারের চাইতে বেশী বিস্তৃত। আমার মাথার মধ্যে প্রাকৃতিক ভাবেই স্থাপন করা স্মৃতি ভান্ডারের সমস্ত স্মৃতি একত্রিত করে বিস্তৃত ক্ষমতা দিয়ে খুঁজতে লাগলাম কখনো পরিকল্পনা করে করেছি এমন কোন ডাটা খুঁজে পায় কিনা। অনেক ঘাঁটা ঘাঁটির পর মস্তিষ্ক সংকেত দিলো, না এমন কিছু খুঁজে পায়নি। তার মানে আমার যাপিত জীবনে পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়িত হয়েছে এমন কোন তথ্য নেই।
যা হয় তা হয়েই যায়, এর জন্য পরিকল্পনা লাগেনা। আর কোন পরিকল্পনা করলে কিছু দিন যেতে না যেতে পরিকল্পনার পরির পাখা গজায় তারপর কল্পনাকে এতিম বানিয়ে পরী পরপারের জন্য উড়াল দেয়। পড়ে থাকে পরি বিহীন কল্পনা আর কল্পনা ত নিছক কল্পনাই। তবুও আমি পরিকল্পনা করি অনেক কিছুতেই। যেমনটি করেছিলাম তোমাকে নিয়ে নীলগিরিতে যাবো বলে, যাওয়া কি হয়েছে আদৌ ? তেমনি ভাবে হয়নি নৌকায় চড়ে নদীতে ঘোরা অথচ দুজন মিলেই কতই না পরিকল্পনা করেছিলাম।
বসন্ত আসে যায় প্রতি বছর। এ আর নতুন কি। আমার পরিকল্পনায় বসন্ত যেমন এগুবেনা তেমনি আমার জন্য পিছু হটবেও না। তবু আমি পরিকল্পনা করি। করতে হয় বলেই। গত তিন দিন থেকে খচড়া খাতায় তোমাকে নিয়ে কতই না পরিকল্পনা করেছি। যদিও জানতাম আমার আর দশটা পরিকল্পনার মতোই এটাও একটি নিষ্ফল (পরি)কল্পনা মাত্র তবুও তোমাকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগেই বলে ভাবি। বাসন্তি রঙের গাঁদা ফুলে তোমার চুল সাজিয়ে দিয়ে তোমাকে নিয়ে বসন্তের মৃদু মন্দ বাতাস গায়ে মেখে হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়াবো। আরো হাবিজাবি কত্ত কি। কিন্তু আমি জানি তুমি আর দশজন সাধারণের মতো নও। তুমি ঠিক মান্না দের রমা রায়ের মতো সোশ্যাল, নাটক, উৎসব নিয়ে ব্যস্ত। তোমার অত সময় কই আমাকে সময় দেবার ? আমি মেনে নিই, নিতেই হবে। তবুও আমি আমার পরিকল্পনা নিয়ে এগুই মনের জোরে।
বসন্তের সকাল আমার ঘুম ভাঙ্গাতে পারেনি, নৈমিত্তিক নিয়মেই ঘুম ভাঙলো। শকটের প্রকট শব্দে কান ঝালা-পালা পাখির কিচির মিচির শব্দ শোনা হয় না কত দিন। আজ ভেবেছিলাম তোমাকে সাথে নিয়ে পাখির ডাক শুনবো। কৃষ্ণচূড়ার লাল তোমার কপালে ছড়িয়ে দিবো যত্ন করে। এমনি হাজারো ভাবনা মাথায় নিয়ে টুথব্রাশ দাতে ঘঁষছি। নাস্তা সেরে পথে নেমে এলাম যদি তোমার দেখা পাই। হাজারো মানুষ নানান রঙে সেজেছে আজ বসন্তের এই প্রথম দিনে। হৈ হুল্লোড়ে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত। চায়ের ষ্টল থেকে শুরু করে বাবু সাহেবের আলীশান বাংলোতেও আজ বসন্তের গান বাজছে, আহা আজি এ বসন্তে…
আমি ধূলো মাখা পথে হাঁটি একা একা, চারপাশে হাজারো মানুষ অথচ আমার কেউ নেই। যার কেউ নেই তার সিগারেট আছে। সিগারেট নিঃসঙ্গ মানুষের আশ্রয়ও বটে ! সিগারেট ফুঁকে ধোঁয়ার কুন্ডুলী আকাশে ছড়িয়ে দেবার মজাই আলাদা। কুদ্দুসের পানের দোকান থেকে কেনা হয়ে গেলো একটা আশ্রয়। ধরাতে গিয়েই মনে পড়ে গেলো আরে আমি ত ওটা কবেই ছেড়ে দিয়েছি তোমার কড়া নির্দেশে। তোমার নির্দেশ পালন করতে গিয়ে বিষাক্ত সিগারেটটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে চারপাশে ছড়িয়ে দিলাম। তুমি তা দেখোনি দেখেছে আমার পাশে থাকা পথ শিশুটা। বসন্তের রঙ তাকে রাঙ্গায়নি, তাকে হাসায়নি কিন্তু আমার ধ্বংসযজ্ঞ তাকে হাসিয়েছে, অবাক করে দিয়েছে। আমি তাঁর আরো কাছে গেলাম, পাশে বসার অনুমতি না নিয়েই ধূলির পিঁড়িতে বসে পড়লাম। তাঁর মায়াবী মলিন চেহারাটা দেখে বড় মায়া লাগলো। নাম জিজ্ঞেস করতেই হাসি মুখে নামটা জানিয়ে দিলো। আমি তাৎক্ষণিক ভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম আমার আজকের সমস্ত পরিকল্পিত আনন্দের পুরোটাই তাঁর হাতে তুলে দিবো। তাকে বললাম তুমি কি আমার সাথে আজ দুপুরে খাবে ? আমি তোমাকে খাওয়াবো তুমি যা খেতে চাও। কথাটা শুনে সে এতোটা অবাক হলো যেন এমন কথা সে কখনোই শুনেনি। কোন উত্তর দিতে পারেনি লজ্জায় আদ্র হয়ে মাথা নীচু করে রইলো। আমি মনে মনে ভাবলাম হয়তো সে বিশ্বাস করতে পারছেনা। ওয়ালেট বের করে এক’শ টাকার একটা নোট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম পাশের দোকান থেকে কিছু কিনে আনো একসাথে এখানে বসে খাবো। সে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে রইলো। আমি তার পিঠে হাত বুলিয়ে আবারো বললাম যাও কিছু কিনে আনো। সে উঠে দাঁড়ালো তারপর জিজ্ঞেস করলো কি আনবো, আমি আবারো বললাম তোমার যা খেতে ইচ্ছে করে নিয়ে এসো। সে দু প্যাকেট চিপস আর কিছু ক্যান্ডি এনে খুচরো টাকা ফেরত দিতে চাইলে আমি বললাম ওটা তুমি রেখে দাও। চিপস খেতে খেতে ঘন্টা খানিক তার সাথে কথা বললাম হাজারো মানুষের ভিড়ে। আমাদের আলোচনায় কোন বিষয়ই বাদ যায়নি রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি আরো কত কি। কথার শেষে তাকে বললাম অনেক হয়েছে এবার চলো রেষ্টুরেন্টে গিয়ে কিছু খেয়ে নিই। মধ্যম মানের একটা রেষ্টুরেন্টে গিয়ে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী খাবার দিয়ে পেট ভরে শান্তিতে খেয়ে বের হয়ে এলাম।
এবার তাকে বিদায় জানানোর পালা। আমি দাঁড়িয়ে আছি সে আমাকে ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে, একটু পর পর পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে এক অসম্ভব বিস্ময় আর ভালোবাসা নিয়ে। এক সময় সে জনারণ্যে মিলিয়ে যায়। অথচ আমি রঙ চঙ্গা হাজারো মানুষের ভিড়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি উপরে ফর্সা বিশাল আকাশ। সূর্য্যটা খানিক ঝুঁকে পড়েছে পশ্চিম আকাশের বুকে আমি আকাশের মতো বিশাল মন নিয়ে বাসায় ফিরছি আর ভাবছি ওদের কথা, যারা একমুঠো খাবারের জন্য সারাদিন পড়ে থাকে ধূলো মাখা রাস্তায় অথচ তাদের দিকে নজর দেবার কারো সময় নেই। আমরা নানান সময়ে নানান উৎসবে মেতে উঠি মনে রঙ লাগাই অথচ ওরা বরাবরের মতোই বেরঙ্গা হয়ে পড়ে থাকে। তিন দিনের খচড়া পাতায় কাঁটা ছেঁড়া করে যে সময়টুকু তোমার জন্য বের করেছিলাম তার থেকে কিছুটা সময় আমি আজ তাদের একজনের জন্য খরচ করে ফেলছি তুমি কি রাগ করেছো ? জানো, ওরা কখনো আনন্দ পায়না, বসন্ত কি তা তারা জানেনা। আমরা যে কোন দিন বসন্ত ফিরিয়ে আনতে পারি যদি তুমি আমার সাথে থাকো। আজকের দিনটি ওদের জন্য দিয়ে দিলাম… শোন তোমরা আজকের দিনটি তোমাদের জন্য, বসন্ত আসুক তোমাদের জন্য…
বিঃ দ্রঃ উল্লেখিত বিষয়গুলির পুরোটাই আমার অনুর্বর মস্তিষ্কের ভাবনা মাত্র, বাস্তবের সাথে এর কোন মিল নেই। কিছু একটা লিখতে হয় বলেই লিখি। আমার সকল বন্ধুদের জানাই আগুন লাগা ফাগুনের শুভেচ্ছা। সবাই ভালো থাকুন নিরন্তর…
[জবরুল আলম সুমন: প্রাবন্ধিক]