এপ্রিল ফুল: কেন পালন করছি দিবসটি?

এপ্রিল ফুল: কেন পালন করছি দিবসটি?

মীর আব্দুল আলীম: `April Fool’ অর্থ এপ্রিলের বোকা। বোকা বানানোর দিবস। ধোঁকা দেবার দিন। এ দিনটিতে মিথ্যা বলে, কষ্ট দিয়ে কিংবা প্রতারণা করে হাস্যরস সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। তাই হয়ে আসছে দীর্ঘদিন। প্রশ্ন হলো, দিবসটি এলো কি ভাবে? কারা ছিল এপ্রিলের বোকা? আমরাই বা কেন পালন করছি এ দিবসটি ? দিবসটি পালন মুসলমানদের জন্য কতুটুক যুক্তিক? তবে কি না জেনে, না বুঝেই “এপ্রিল ফুল” পালন করছি আমরা ? যদি বলি এপ্রিল ফুল” মানেই মুসলমানদের বোকা বানানোর দিন; মুসলমানদেও ধোকা দেবার দিন এটি? ১৪৯২ সালের ১ এপ্রিল তাইতো করা হয়েছিলো। হ্যাঁ মুসলমানদের বোকাই বানানোই হয়েছিল এপ্রিলের এই দিনটিতে।
এপ্রিল ফুল মুসলিম ইতিহাসের এক হৃদয় বিদারক ঘটনা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পাশ্চাত্যের কায়দায় মুসলিম দেশগুলোতেও প্রতি বছর কিছু লোক এপ্রিল ফুল ডে পালন করে যাচ্ছে অবলিলায়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আজ বহু মুসলিম সে ইতিহাস ভুলে গিয়ে এপ্রিলের দিনটিকে স্বাচ্ছন্দে অংশ গ্রহণ করছেন এবং প্রচুর কৌতুক ও রসিকতা উপভোগ করছেন। সেদিন ছিল ১৪৯২ সালের ১ এপ্রিল। ইউরোপের বুকে খ্রিষ্টান বাহিনী ধোকা দিয়ে শহরে প্রবেশ করে অসহায় মুসলিম নারী-পুরুষ, শিশুদের মসজিদের ভেতর আটকে রেখে। পরে একযোগে শহরের সমস্ত মসজিদে আগুন লাগিয়ে বর্বর উল¬াসে মেতে ওঠে বিধর্মী হায়েনার দল । ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সে দিন স্পেনের কুখ্যাত ফার্ডিন্যান্ড আল¬াহর ঘর পবিত্র মসজিদের চারি পার্শ্বে আগুন লাগিয়ে নৃশংসভাবে হাজার হাজার নিরপরাধ মুসলমানদেরকে হত্যার মাধ্যমে বিশ্বাস ঘাতকতার পরিচয় দেয় এবং রক্তে রঞ্জিত করে গ্রানাডার রাজপথ এবং তাদেরকে জোরপূর্বক খৃস্টান বানায়। ফার্ডিন্যান্ড সে দিন আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে ছিল “হায় মুসলমান! “অঢ়ৎরষ ঋড়ড়ষ” তোমরা এপ্রিলের বোকা।” স্পেনীয়দের দ্বারা মুসলমানদের বোকা বানানোর এই নিষ্ঠুর বিশ্বাসঘাতকতা বা শঠতা স্মরণীয় রাখার জন্য খৃস্টান জগৎ প্রতি বছর ১লা এপ্রিল খেলে থাকে রসিকতার খেলা, যে খেলা আমাদের কাছে বড় করুণের বড় বেদনার। ইতিহাসের হৃদয়বিদারক ঘটনা ভুলে না গেলে এপ্রিল ফুল কোনো মুসলিমকে আনন্দ দান করতে পারে না। এখন আমরা কি পয়লা এপ্রিল হাসি-আনন্দের সাথে “এপ্রিল ফুল ডে” উদযাপন করব, নাকি ইউরোপের বুকে অসহায় মুসলিম নারী-পুরুষ, শিশুদের নৃশংস হত্যাকান্ডের স্মরণে দুঃখ অনুভব করব, মুসলিম ভাই-বোনেরা ভেবে দেখবেন কি? এপ্রিল ফুল ডের এ মর্মান্তিক ইতিহাস জানারও পর কি আমরা এ দিনটিকে আমোদ-প্রমোদ কিংবা আনন্দের দিন হিসেবে পালন করতে পারি? কক্ষনোই না। এ দিনটি আসলে হওয়া উচিত আমাদের শোকের দিন, ইসলামের শত্রুদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দিন। আরেকটা কথা। মানুষকে ধোঁকা দেয়া, প্রতারণা করা এসব কিন্তু ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী। ১লা এপ্রিলে যেভাবে মিথ্যা বলে রসিকতা করার চেষ্টা করা হয় তা কোনভাবেই মুসলমানদের সংস্কৃতি হতে পারে না। রাসূলে খোদা বলেছেন, “আমি রসিকতা করি ঠিক কিন্তু কখনো মিথ্যা বলি না।” তিনি আরও বলেছেন, “ধ্বংস তার জন্য যে লোক হাসানোর জন্য কথা বলে এবং তাতে সে মিথ্যার আশ্রয় নেয়।” সুতরাং এপ্রিল ফুলের নামে আমরা কেউই কাউকে প্রতারণা করবো না এবং মিথ্যার আশ্রয় নেবো না-এই হোক আজকের দিনের অঙ্গীকার।
কয়েক শ’বছর আগে ঘটনা। ইসলামের শাশ্বত সৌন্দর্য ও কল্যাণে আকৃষ্ট হয়ে বিশ্বের দেশে দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের যে জোয়ার ওঠে সেই ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের মাটিতেও। অষ্টম শতাব্দীতে স্পেনে কায়েম হয় মুসলিম শাসন। মুসলমানদের নিরলস প্রচেষ্টায় স্পেন জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সভ্যতার ক্ষেত্রে বিস্ময়কর উন্নতি লাভ করে । দীর্ঘ ৮০০ বছর একটানা অব্যাহত থাকে এ উন্নতির ধারা। স্পেনে মুসলমানদের ৮০০ বছরের গৌরবময় শাসনের ফলে দেশটিতে তখন অর্থসম্পদ, বিত্ত-বৈভবের অঢেল জোয়ার । মুসলমানরা ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে ভুলে যায় কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা। নৈতিক অবক্ষয় ও অনৈক্য ধীরে ধীরে গ্রাস করে তাদের । এ দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে খ্রিষ্টান জগত্। তারা মেতে উঠে কুটিল ষড়যন্ত্রে । সিদ্ধান্ত নেয়, ‘স্পেনের মাটি থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ করতে হবে ।’ এ চিন্তা নিয়েই পর্তুগীজ রাণী ইসাবেলা চরম মুসলিম-বিদ্বেষী পার্শ্ববর্তী খ্রিষ্টান সম্রাট ফার্দিনান্দকে বিয়ে করেন । বিয়ের পর দু’জন মিলে নেতৃত্ব দেন মুসলিম নিধনের । খ্রিষ্টানদের সম্মিলিত বাহিনী হাজার হাজার নারী-পুরুষকে হত্যা করে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে উল¬¬াস করতে করতে ছুটে আসে রাজধানী গ্রানাডায়। এতদিনে টনক নড়ে মুসলিম বাহিনীর। কখনো সম্মুখ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজিত করতে পারেনি বলে চতুর ফার্দিনান্দ পা বাড়ায় ভিন্ন পথে। তার নির্দেশে আশপাশের সব শস্যখামার জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় শহরের খাদ্য সরবরাহের প্রধান কেন্দ্র ভেগা উপত্যকা । অচিরেই দুর্ভিক্ষ নেমে আসে শহরে । দুর্ভিক্ষ যখন প্রকট আকার ধারণ করলো তখন প্রতারক ফার্দিনান্দ ঘোষণা করলো, মুসলমানরা যদি শহরের প্রধান ফটক খুলে দেয় এবং নিরস্ত্র অবস্থায় মসজিদে আশ্রয় নেয় তবে তাদের বিনা রক্তপাতে মুক্তি দেয়া হবে । সেদিন ১৪৯২ সালের ১ এপ্রিল। দুর্ভাগ্য তাড়িত গ্রানাডাবাসী অসহায় নারী ও মাসুম বাচ্চাদের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে খ্রিষ্টানদের আশ্বাসে বিশ্বাস করে খুলে দেয় শহরের প্রধান ফটক। সবাইকে নিয়ে আশ্রয় নেয় আল¬াহর ঘর পবিত্র মসজিদে। শহরে প্রবেশ করে খ্রিষ্টান বাহিনী মুসলমানদেরকে মসজিদের ভেতর আটকে রেখে প্রতিটি মসজিদে তালা লাগিয়ে দেয়। এরপর একযোগে শহরের সমস্ত মসজিদে আগুন লাগিয়ে বর্বর উল¬াসে মেতে ওঠে হায়েনারা । লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশু অসহায় আর্তনাদ করতে করতে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারায় মসজিদের ভেতর। প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখায় দগ্ধ অসহায় মুসলমানদের আর্তচিৎকার যখন গ্রানাডার আকাশ-বাতাস ভারী ও শোকাতুর করে তুলল তখন রাণী ইসাবেলা হেসে বলতে লাগলো, ‘হায় এপ্রিলের বোকা! শত্রুর আশ্বাস কেউ বিশ্বাস করে ?’ সেই থেকে খ্রিষ্টান জগৎ প্রতি বছর ১লা এপ্রিল আড়াম্বরের সাথে পালন করে আসছে-“অঢ়ৎরষ ঋড়ড়ষ” মানে ‘এপ্রিলের বোকা’ উৎসব।
দুঃখের সাথে বলতে হয় “এপ্রিল ফুল” এর প্রকৃত ইতিহাস সর্ম্পকে না জানার কারনে আমরা আমাদের পূর্বসূরীদের দুর্ভাগ্যকে আনন্দের খোরাক বানিয়ে এপ্রিল ফুল পালন করছি। আমরা আর কতকাল আত্মবিস্মৃত হয়ে থাকব ? নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্য সর্ম্পকে অজ্ঞতার ধরা আর কতদিন আমাদের মধ্যে বিরাজ করবে। অথচ এই অজ্ঞতাই আমাদের জন্য সবচেয়ে মারাতœক কাল হয়ে দেখা দিয়েছে। বেশি দিন আগের কথা নয়। ১৯৯৩ সালের ১ এপ্রিল গ্রানাডা ট্র্যাজেডির ৫০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে স্পেনে আড়ম্বরপূর্ণ এক সভায় মিলিত হয়েছিল বিশ্ব খ্রিষ্ট সম্প্রদায় । সেখানে তারা নতুন করে শপথ গ্রহণ করে একচ্ছত্র খ্রিষ্টীয় বিশ্ব প্রতিষ্ঠার। বিশ্বব্যাপী মুসলিম জাগরণ প্রতিহত করার জন্য গড়ে তোলে ‘হলি মেরি ফান্ড’। আর এরই ধারাবাহিকতায় গোটা খ্রিষ্টান বিশ্ব নানা অজুহাতে একের পর এক মুসলিম দেশগুলোতে আগ্রাসন চালাচ্ছে । অতএব সামনে ভয়াবহ দুর্দিন । এই দুর্দিনে এসব নব্য ইসাবেলাদের বিরুদ্ধে শান্তিকামী শক্তির চাই সুদৃঢ় ঐক্য । আর যদি তা করতে ব্যর্থ হই তবে অচিরেই গ্রানাডার মতো বধ্যভূমিতে পরিণত হবে গোটা মুসলিম বিশ্ব।
[মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট]
newsstore13@gmail.com

অতিথি লেখক