ব্লগারদের মৃত্যু পরোয়ানা জারিকারীদের কি আইনের আওতায় আনা হবে?
শওগাত আলী সাগর: ‘ব্লগার’- শব্দটার ব্যাপক পরিচিতি পেলো মাত্র সেদিন। আশ্চর্য ব্যাপার, শব্দটার পরিচিতি ঘটলো ভয়াবহ একটা কিছু হিসেবে। ব্লগারদের ব্যাপকভিত্তিক পরিচিতির কৃতিত্ব অবশ্যই কারাগারে থাকা আমারদেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহামুদুর রহমানের। ‘ব্লগার’ শব্দটিকে বিভৎষ কিছু হিসেবে ভাববার জায়গায় নিয়ে যাওয়ার দায়ভাগটাও তার।
তখন শাহবাগের উত্তাল আন্দোলন। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাসিঁর দাবিতে শাহবাগে তারুন্যের সমাবেশের শুরু হলেও সেটি শেষ পর্যন্ত সকল যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য একটি প্রেসারে গ্রুপে পরিণত হয়।সেই প্রেসার গ্রুপের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সারা জাতি। শাহবাগের আন্দোলনটা আসলে রুপ নেয় একটি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের।
সেই সময়টাতেই মাহমুদুর রহমান ঘুরে আসেন মাওলানা শফির মাদ্রাসা। এসেই তিনি আমারদেশ পত্রিকায় কলম ধরেন শাহবাগের আন্দোলনের বিরুদ্ধে। যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্যোগ নেন তিনি। ব্লগাররা সব নাস্তিক’- এই অপপ্রচারের শুরু হয় মাহমুদুর রহমানের হাত দিয়েই। শাহবাগ আন্দোলনের সূচনাটা হয়েছিলো কয়েকজন তরুন ব্লগার এবং অনলাইন এক্টিভিষ্টদের হাত ধরেই। ফলে ব্লগারদেরই টার্গেট করেন মাহমুদুর রহমান।
মাহমুদুর রহমানের অপ্রপচারে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে মাওলানা শফির হেফাজত। ‘নাস্তিক’ ব্লগারদের গ্রেফতারের দাবিতে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে এসে অবস্থান নেয় হাজারো মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। আধুনিক জগত সম্পর্কে ধারনাবিহিীন এই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা ব্লগ কি জানে না, ইন্টারনেট কি জানে না। কোনো এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর ‘ব্লগ দিয়া ইন্টারনেট চালায়’- এমন একটা কৌতূককর উক্তি বেশ প্রচার পেয়েছিলো সেই সময়টায়।
মাওলানা শফির হেফাজত, জামাত শিবির কৌশলে লাখো লাখো মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর মগজে মাহমুদুর রহমানের বয়ানটাই কৌশলেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ‘ব্লগার মানেই নাস্তিক’- আর ‘নাস্তিকদের মেরে ফেলা ঈমানী দায়িত্ব’- এই দীক্ষাও দিয়ে দেওয়া হয় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মননে। সেই দীক্ষায়ই যে মাদ্রাসাগুলিতে ব্লগারদের হন্তারক গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে- তার প্রমান পাওয়া যায়- আশিকের খুনের দায়ে হাতে নাতে ধরা পড়া মাদ্রাসা ছাত্রদের জবানীতে। কি অবলীলায় তারা পুলিশকে বলেছে- ব্লগ কি জানি না, ঈমানী দায়িত্ব পালন করতে খুন করেছি। আশিককে খুন করা যে ‘ ঈমানী দায়িত্ব’ সেই দীক্ষাটা কি মাওলানা শফির হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকেই এসেছে?
রাজিবের খুনের পর, অভিজিতের খুনের পর কতো কথাই না হয়েছে। খুনের পক্ষে প্রকাশ্যে সাফাই গাওয়ার লোকেরও অভাব হয়নি। আশিকের মৃত্যুর পরও একই চিত্র, একই কোরাশের পূণরাবৃত্তি দেখছি। আশিকের খুনটাও পুলিশের চোখে ‘ক্লু ক্লেস’ কিলিং হিসেবে ঘোষিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া ভিন্ন কোনো প্রাপ্তি ঘটবে বলে আশা করার সাহসও এখন আর হয় না।
আমরা ব্লগার হত্যার বিচার চাই, ব্লগারদের নিরাপত্তা চাই। অথচ ‘ব্লগার’দের ললাটে ‘নাস্তিকতার’ চিরকালের সিল মেরে দিয়ে তাদের ‘মৃত্যুপরোয়ানা জারিকারীদের’ ব্যাপারে উচ্চকন্ঠে কিছু বলি না। মাদ্রাসায় মাদ্রাসায় হন্তারক যারা তৈরি করেছে, তাদের ব্যাপারে সোচ্চার হই না।
এতোগুলো মৃত্যুর পরও কি আমরা ব্লগার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারীদের বিচারের আওতায় আনবো না?
[লেখক: শওগাত আলী সাগর, নতুনদেশ ডটকম এর প্রধান সম্পাদক]