আন্তর্জাতিক নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসঃ কুসংস্কার দূর হোক॥ বিকাশ ঘটুক শুভচিন্তার
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: একজন মানুষের পৃথিবীতে আসার সূচনা থেকে শুরু করে পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হওয়ার আগ পর্যন্ত তার সুন্দর-সুস্থ জীবন নিশ্চিত করতে নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেন গর্ভধারিণী মা। সন্তানকে জন্মদান যেমন একজন নারীর পূর্ণতা এনে দেয় তেমনি একজন মানুষকে সুযোগ করে দেয় এই সুন্দর ধরণীতে আসার জন্য। কিন্তু জন্মদানের ক্ষেত্রে মায়েদের কতোটা নিরাপদ রাখতে পারছি সেটা ভাবার বিষয়। মা যে মমতা নিয়ে সন্তানের জন্য সুন্দর পৃথিবীকে সাজান,স্বপ্ন দেখেন, আমরা কি পারছি মা’কে সেই অনুযায়ী সেবা দিতে বা তাঁর মাতৃত্বের নিরাপত্তা বিধান করতে! ‘প্রতিটি জন্মই হোক পরিকল্পিত,প্রতিটি প্রসব হোক নিরাপদ’-এ স্লোগানকে সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উদযাপিত হচ্ছে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস ২০১৫।
২৮ মে আন্তর্জাতিক নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। মা ও শিশুমৃত্যু রোধ এবং তাদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার বিষয়ে সবাইকে সচেতন করার পাশাপাশি এসব সমস্যা প্রতিরোধ করার প্রত্যয়ে ১৯৮৭ সাল থেকে শুরু হয়েছিল ‘নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস’ পালন, যার মূল উদ্দেশ্য নিরাপদ মাতৃত্বকে নারীর অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে মা ও নব জাতকের মৃত্যুহার কমিয়ে আনা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো এই দিবস পালন শুরুর প্রায় তিন দশক পরে এসেও আমরা মাতৃত্বকে নিরাপদ করতে পারিনি। পারলে বছরে হাজার হাজার সন্তানসম্ভাবা নারীকে গর্ভকালীন জটিলতার কারণে এবং উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে প্রাণ দিতে হতো না। কিন্তু একজন গর্ভবতী নারী গর্ভকালীন সেবা, নিরাপদ প্রসবের জন্য যাবতীয় সেবা এবং প্রসব-পরবর্তী সেবা পাওয়ার সব অধিকার রাখে। অথচ বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী এখনো উপরোক্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত। উপযুক্ত চিকিৎসা সেবা পায় না এমন পরিবারের সংখ্যা যেমন বেশি তেমনি চিকিৎসা সেবা নিতে আগ্রহী নয় এমন পরিবারের সংখ্যাও কম নয়। একদিকে চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতা অপরদিকে কুসংস্কার আমাদেরকে এ ক্ষেত্রে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন পৌর এলাকাতে রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো সমস্যার জন্য হাসপাতালে যেতে পারছে না অনেক নারী। হাসপাতালে পৌঁছালেও ডাক্তার না থাকার কারণে মিলছে না চিকিৎসা সেবা। আবার অনেকে পুরুষ ডাক্তারের হাতে প্রসব করাতেও রাজি হয় না। এমনকি তারা মেয়েদের হাসপাতালে ভর্তি করানোর ব্যাপারেও বাধা প্রদান করে। গ্রামীণ, পাহাড়ি জনপদ ও চরাঞ্চলের অবস্থা আরো করুণ। এসব জায়গায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেই কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্র। আর থাকলেও সেখানে ডাক্তাররা থাকতে চায় না। কেউ অসুস্থ হলে স্থানীয় ওঝা, ফকির বা হাতুড়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। নেই কোন স্বাস্থ্য সচেতনতা। ফলে ঘটছে জনবিস্ফোরণ, বাড়ছে মা ও শিশুর মৃত্যু।
শহর এলাকার অবস্থা যে খুব ভালো তাও বলা যায় না। কারণ শহরে স্বাস্থ্যসেবা অনেকটাই বাজারমুখি, ব্যবসাকেন্দ্রিক ও মুনাফাসর্বস্ব। সেখানে স্বাস্থ্যসেবা চড়া দামে কিনতে হয়। কর্মজীবী নারীদের সমস্যাও প্রকট। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, মেয়েদের কমপক্ষে ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটির প্রয়োজন, বিশেষকরে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় সন্তান জন্মদানের পূর্বেই ছুটি নেয়ার নিয়ম আছে। কিন্তু নারীরা এই সুবিধা থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বঞ্চিত। এছাড়া গর্ভাবস্থায় কর্মজীবী নারীদের বিশেষ করে নারীশ্রমিকদের অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয়। ফলে ঝুঁকির মুখে পড়ছে হচ্ছে মা ও সন্তানের জীবন।
আবার গ্রামাঞ্চলের অনেক নারীকে স্বামী এবং স্বামীর পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নির্যাতিত হতে হয় এবং এই নির্যাতন মাতৃত্বকালীন সময়েও চলে। ফলে দেখা যায় মা এবং সন্তানের জীবন হুমকির মুখে পড়ে। অধিকাংশ সময় দেখা যায় গ্রামাঞ্চলে কয়টি সন্তন নেয়া হবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় স্বামী একাই, নারীর শরীর ও মনের কথা মাথায় না রেখেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফলে সন্তান এবং মা উভয়ই রুগ্ন হয়ে পড়ে, ক্ষেত্র বিশেষে তাদের উভয়ের বা একজনকে মৃত্যুমুখে পতিত হতে হয়। আবার বাল্যবিবাহ গ্রামাঞ্চলের প্রধান একটি সমস্যা। ফলে বয়ঃসন্ধিকালে গর্ভবতী হওয়ার সংখ্যা ৬০ ভাগ। বর্তমানে শতকরা প্রতি তিন জন কিশোরীর (যাদের বয়স ১৫-১৯) গর্ভধারণে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। যা এখনও জানান দেয় বাল্যবিবাহের হার কতটুকু বিপদজনক আমাদের দেশে! অপ্রাপ্ত বয়সে সন্তান ধারণ, গর্ভপূর্ব ও গর্ভকালীণ এবং গর্ভ-পরবর্তী সময়ে জরুরী প্রসূতি চিকিৎসার অভাবও মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ। সেই সঙ্গে পুষ্টিহীনতা তো রয়েছেই। আর গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী দরিদ্র। এই কারণেই অত্যন্ত গরিব জনগোষ্ঠীর মধ্যে জটিলতায় ভোগার আশঙ্কা অপেক্ষাকৃত ধনীদের তুলনায় প্রায় ৩০০ গুণ বেশি, এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশে এখনও শতকরা ৮৫ ভাগ প্রসব হচ্ছে বাড়িতে। ১৫ ভাগ হাসপাতাল কিঙবা ক্লিনিকে। ২০০৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী,শতকরা ২১ ভাগ ডেলিভারি দক্ষ হাতে হচ্ছে। ১৯৯০ সালে এর হার ছিল শতকরা ৫ এবং ২০২০ সালের লক্ষ্যমাত্রা শতকরা ৬০ ভাগ। প্রসব-পরবর্তী সেবার হার এখনো শতকরা ২২ ভাগ। বেশির ভাগ মাতৃমৃত্যুই ঘটে প্রসব-পরবর্তী সময়ে। বর্তমানে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারী আছে শতকরা ৫৭ ভাগ। মাতৃমৃত্যু প্রতি এক লাখে ১৯৯০ সালে ছিল ৫৭৪ জন, ২০০৬ সালের পরিসংখ্যানমতে ৩২০ জন। আর মিলেনিয়াম ডেভলপমেন্ট গোল বাস্তবায়ন করতে হলে ২০২১ সালে এই লক্ষ্যমাত্রা ১৪৩ জনে নামিয়ে আনতে হবে, অর্থাৎ তিন-চতুর্থাংশ কমাতে হবে। গত বছর আন্তর্জাতিক ধাত্রী দিবস উপলক্ষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায় ৮৭ শতাংশ মা স্বাস্থ্যকর্মী বা দক্ষ ধাত্রী ছাড়া ও ৯২ শতাংশ মা বাড়িতে প্রসব করায়। এভাবে সচেতনতার অভাবে প্রতিনিয়ত ঘটছে মাতৃমৃত্যু। এর মধ্যে মাতৃমৃত্যুর ২৫ ভাগই ঘটে জন্মের সময় রক্তক্ষরণ,প্রসব পরবর্তী জটিলতা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবের জন্য। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপি) এক হিসাব অনুযায়ী বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন সত্ত্বেও বাংলাদেশের ৭৫ শতাংশ মেয়ের কৈশোরে বিয়ে হয়ে যায়। তাদের মধ্যে ২৬ ভাগ নারী প্রসবজনিত জটিলতায় মারা যাচ্ছে। প্রতিবছর প্রায় ১২ হাজার মা প্রসবজনিত জটিলতার কারণে মারা যায়। বর্তমানে মাতৃমৃত্যু হার প্রতি লক্ষ জীবিত জন্মে ২৯০ জন ও নবজাতকের মৃত্যু হার প্রতি হাজারে ৩৭ জন।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন, মাতৃমৃত্যুর হার বর্তমানের ৩.৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০২১ সালে ১.৫ শতাংশে কমিয়ে আনা হবে। তাঁর এই উক্তি আমাদের আশার বাণী শোনালেও বাস্তবতা হলো এই উদ্যোগকে বাস্তবায়ন করতে হলে যে প্রস্তুতি, প্রশিক্ষণ, উপায়-উপকরণ দরকার তা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌছায় না বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সার্বিকভাবে এই হতাশাজনক পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে হলে নারীদের মধ্যে শিক্ষা বাড়াতে হবে, চিকিৎসা সেবা সবার দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিতে হবে, বাল্যবিবাহ রোধ করতে হবে। আর এই সকল ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলকে প্রাধান্য দিতে হবে, কেননা গ্রামই সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। সরকার এবং দেশের সকল জনগণের মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমেই মায়ের মাতৃত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব। অচিরেই আমরা আমাদের দেশের ভবিষৎ মায়েদের জন্য নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে পারবো এই হোক আন্তর্জাতিক নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের একান্ত কামনা।
জানা যায়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিরাপদ মাতৃত্ব বিষয়ে পরিকল্পনা করা হয় ১৯৮৭ সালে কেনিয়ার নাইরোবিতে উন্নয়ন সহযোগীদের বৈঠকে। ১৯৯৭ সালে শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোয় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন পর্যালোচনা করে এ বিষয়টিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। ১৯৮৭ সাল থেকে আন্তর্জাতিকভাবে এই দিবসটি পালন শুরু হলেও আমাদের দেশে মূলত দিবসটির যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৭ সাল থেকে। সারা বিশ্বে মাতৃমৃত্যু ও মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে প্রকাশিত ডব্লিউএইচওর প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিশ্বে মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে ৪৫ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে গত বছর সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতি ১ লাখে ১৭০ জন মায়ের মৃত্যু হয়েছে। ১৯৯০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫৫০। প্রতিবেদনে মাতৃস্বাস্থ্যের বিষয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়, দেশটি উন্নতি করছে। সরকারি এক তথ্যে জানা গেছে, দেশে মাতৃমৃত্যুর বর্তমান হার ৩.৪ শতাংশ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ১.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। গত কয়েক বছরে দেশে মাতৃমৃত্যু রোধের ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। ২০০১ সালে প্রতি লাখে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল যেখানে ৩২২ জন, ২০১০ সালের পর এ হার নেমে এসেছে ১৯৪ জনে। ২০০১ সালে বাংলাদেশের মাত্র ৯ ভাগ গর্ভবতী নারী সন্তান প্রসবের সময় চিকিৎসক ও পেশাদার ধাত্রীর সহায়তা নিতেন। ১০ বছরের মধ্যে সেই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ শতাংশে। সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা, ২০২১ সালের মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগ গর্ভবতী নারীই সন্তান প্রসবের সময় আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ গ্রহণ করবেন।
ইউনিসেফের তথ্য মতে, বাংলাদেশে নারীদের দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টির হার শতকরা ৩৭ দশমিক ৯। খাবারের অপ্রতুলতা, অপুষ্টি ও সচেতনতার অভাবে প্রতিনিয়ত ঘটছে মাতৃমৃত্যু। অপুষ্টিজনিত মাতৃমৃত্যুর ২৫ ভাগই ঘটে রক্তক্ষরণ ও রক্তস্বল্পতার জন্য, যার একটি কারণ কিশোরী মাতৃত্ব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজেটে, বিশেষ করে মাতৃত্বকালীন পরিচর্যায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও সেবা নিশ্চিত না করা হয়, তাহলে ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার দাঁড়াবে ৩১০ জনে। তাদের মতে, বড় বড় শহরগুলোয় উন্নতমানের বেসরকারি হাসপাতাল গড়ে উঠায় সেখানে কেবল ধনী ও অভিজাত শ্রেণীর লোকজন স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারছেন। ইউনিসেফ, হু, বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রায় ৫০ শতাংশ ডাক্তারের পদই শূন্য। শুধু তাই নয়, গ্রামীণ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৪০ শতাংশ ডাক্তার এবং ৫৫ শতাংশ নার্সই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়মিত যান না। এদিক থেকে চিন্তা করলে, শহরের বাইরে যেসব নারী অবস্থান করছেন, তাদের প্রসবকালীন বা প্রসব-পরবর্তী চিকিৎসাসেবা পাওয়া অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া পারিবারিক অসচেতনতা, ভুল চিকিৎসা, দারিদ্র্য, সর্বোপরি নারীর প্রতি পরিবারের পুরুষদের অবহেলার কারণে নারীরা যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মাতৃত্বকালীন অপুষ্টির কারণে রোগাক্রান্ত মায়েদের স্বাস্থ্যহানি ঘটায় অনেক সময় মা ও নবজাতকের মৃত্যুর আশংকা থাকে। বাল্যবিবাহ, অপরিকল্পিত গর্ভধারণ, কিশোরী মায়ের পুষ্টিহীনতা, রক্তস্বল্পতা, গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণ, সুচিকিৎসার অভাব প্রভৃতি কারণে নারীর নিরাপদে মা হওয়ার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। সুতরাং নবজাতক ও মাতৃমৃত্যু রোধ করতে হলে গর্ভধারণের আগে থেকেই নারীর প্রতি যতœশীল হওয়া উচিত।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার যুগেও অনেক নারীকে মা হওয়ার সময় মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী যার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭০ জন। ২০১৪ সালের তথ্যানুযায়ী, দেশে ১৩২টি উপজেলায় জরুরী প্রসূতি সেবার (ইওসি) অবকাঠামো আছে। এর মধ্যে চালু ছিল ১০১টি। এর বাইরে ৪৮০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিভাগের এই তথ্যের অনেকটাই কাগুজে পরিসংখ্যান। কারণ নিয়ম অনুযায়ী অস্ত্রোপচারের জন্য যে পরিমাণ প্রশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন তার অধিকাংশ পদই শূণ্য। যা তৎকালীন সময়ে খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর’বি) ২৪টি জেলার ইওসি সেন্টারের উপর পরিচালিত জরিপের ফলাফলেও উঠে এসেছে। সরকারের জরিপ ও প্রভাবশালী চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট-এর বিশ্লেষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, মাতৃমৃত্যুর প্রত্যক্ষ কারণ কমলেও গত ১০ বছরে পরোক্ষ কারণে মৃত্যুর হার বেড়েছে ৪৯ শতাংশ। প্রতিদিন গড়ে ২১ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। বাংলাদেশে গর্ভধারণের ৪২ দিন পর্যন্ত দুর্ঘটনা ছাড়া মায়ের মৃত্যুকে মাতৃমৃত্যু বলা হয়।
মৃত্যুর পরোক্ষ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ক্যান্সার, স্থূলতা, যক্ষ্মা, রক্তস্বল্পতা, হেপাটাইটিস- বি, বেশি বয়সে প্রথম সন্তান ও বেশি সন্তান নেয়া, এইচআইভি/এইডস্, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি। এখনো অবহেলিত জনপদগুলো মা হওয়ার ক্ষেত্রে বঞ্চনা আর সীমাহীন কষ্টের অবসান হয়নি। শুধু তাই নয়, সীমাবদ্ধতার মাঝে কোন প্রকারে প্রসব কার্য সমাধা হলেও নতুন করে যোগ হয় অনাকাক্সিক্ষত প্রসব জনিত দীর্ঘস্থায়ী জটিলতা। যা একজন নারীর জন্য সারা জীবনের দুর্ভোগ ও যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর মধ্যে ফিস্টুলা অন্যতম। ইউএনএফপিএ’র আর্থিক সহযোগিতায় পরিচালিত এক সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে প্রসব জনিত ফিস্টুলায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৬৯। আর এ ফিস্টুলার ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায় হল জরুরী প্রসূতি সেবা প্রাপ্তি ও দক্ষ ধাত্রীর অভাব। সচেতনতা আর জ্ঞানের অভাবে সুচিকিৎসার বারতা এদের কাছে অনেকাংশেই অধরা থাকে। এর মাঝে এসকল সমস্যাক্রান্ত মায়েরা শারীরিক সমস্যার কারণে পারিবারিক জীবনে অনেক ক্ষেত্রে নিগৃহীত হয়। অথচ মানব জাতির বিকাশে ও বংশ বিস্তারে মায়েদের অনন্য ভূমিকার কথা কারও অজানা নয়, কিন্তু এই মা হতে গিয়েই একজন নারীর জীবনে ঘটে অপূরণীয় ক্ষতি। সর্বোপরি দেশে তৃণমূল পর্যায় থেকে বিদ্যমান সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোকে কার্যকর করতে দক্ষ স্বাস্থ্য কর্মীর উপস্থিতি, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা উপকরণের সহজলভ্যতা, সেবা ও সেবা কেন্দ্রের প্রচার বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য সচেতনতা মূলক কর্মসূচির সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পারলে অধিকাংশ মাতৃমৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করি। তাই এই ব্যাপারে আমাদের সবাইকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে মা হওয়ার ক্ষেত্রে তথা একজন নারীর জীবনে প্রসবকালীন অনাঙ্খিত অপূরণীয় শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ও জটিলতা এবং মৃত্যুরোধে। একজন মায়ের কাছেই থাকে আগামী দিনের আশার আলো। নারীকে সম্মান করুন, তাদের কষ্টগুলো বোঝার চেষ্টা করুন। নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে হলে সমাজের সব মানুষকে সচেতন হতে হবে। শুভচিন্তার বিকাশ ঘটুক, সব কুসংস্কার দূর হোক। নিরাপদ হোক মাতৃত্বের প্রতিটি মুহূর্ত।
[শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রধান সম্পাদক সাংবাদিক।।]
jsb.shuvo@gmail.com