প্রেসক্লাবের বর্তমান কমিটি-ই বেশি গ্রহনযোগ্যতা পাবে
রেজোয়ান হক: জাতীয় প্রেসক্লাবে যা ঘটে চলেছে তাতে আশ্চর্য হইনি। এটি অনেক আগেই অনিবার্য ছিল। পেশাজীবীদের এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় যেভাবে রাজনৈতিক দলবাজি চলছিল এবং এ প্রতিষ্ঠানটিকে কেউ কেউ যেভাবে তাদের পৈতৃক সম্পত্তি ভেবে আসছিলেন তাতে এটা হতোই। গায়ের জোরে ক্ষমতা দখলের অভিযোগ তুলে এবং এর প্রতিবাদে যারা এখন রোদের মধ্যে কষ্ট করে প্রেসক্লাবের আঙিনায় আন্দোলন করছেন তাদের কারও কারও জন্য করুনা হচ্ছে। কারন ম্যানেজিং কমিটিতে থাকতে এক সময় তারাও গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে গায়ের জোরে যা খুশি তাই করেছেন। তাদের কারনে প্রেসক্লাবে এত পাপ জমেছিল যে, তারই পরিনতিতে আজকের এই পরিস্থিতি।
বিশেষ করে সাংবাদিক নামধারী এক ব্যক্তি, যিনি বহু আগে সাংবাদিকতা বাদ দিয়ে রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন, তিনি এই প্রতিষ্ঠানটিকে নিজের জমিদারী বলে ধরে নিয়েছিলেন। প্রেসক্লাবের ভোটার তালিকায় বিএনপি-জামাত সমর্থক ফোরামের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও এক ধরনের ভারসাম্য ছিল। কমিটিতে সংখ্যালঘু আওয়ামী লীগ সমর্থক ফোরামের সদস্যদের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতেই সদস্যপদ দেয়াসহ ক্লাব পরিচালিত হয়ে আসছিল।
কিন্তু দীর্ঘদিন প্রেসক্লাবে কর্তৃত্ব করতে গিয়ে ওই ব্যক্তি এর মধ্যে এত মধু দেখতে পান যে, ২০০৪ সালে সদস্যপদ দেয়ার ক্ষেত্রে সমঝোতা তো বটেই, ক্লাবের গঠনতন্ত্রকেও বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মূলত: তার উদ্যোগেই তাদের মতাদর্শের সাংবাদিকদের পাইকারীহারে সদস্যপদ দেয়া হয়, যাদের মধ্যে বেশ কিছু অ-সাংবাদিকও ছিল। আওয়ামী লীগ সমর্থক ফোরাম যাতে ভবিষ্যতে কখনো জিততে না পারে এবং ঘুরে ফিরে ওই ব্যক্তি বা তার লাঠিয়ালরা যাতে ক্ষমতায় থাকে সে উদ্দেশ্যে বিএনপি-জামাত সমর্থক ফোরামের শক্তি বহুগুনে বাড়িয়ে দেয়া এই তালিকাটি চূড়ান্ত করা হয়েছিল ক্লাবের বাইরে একটি সংবাদ সংস্থার অফিসে। এই অপকর্ম জায়েজ করতে ফোন করে নতুন সদস্যদের ক্লাবে ডেকে এনে হাতে হাতে সদস্যপদের চিঠি দেয়া হয় এবং সদস্যপদ দেয়ায় ক্লাব কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখে রাখা বিবৃতিতে তাদের সই নেয়া হয়, যা ক্লাবের ইতিহাসে কখনও হয়নি।
ওই সময়কার কমিটির সদস্য হিসেবে এসব অপকর্ম দেখার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল। কমিটিতে সংখ্যালঘু হওয়ায় আমাদের প্রতিবাদে কোনো ফল হয়নি। পরেও এর কোনো প্রতিকার না পেয়ে এসব নোংরামি থেকে দুরে সরে আছি, ৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রেসক্লাবের সাথে আমার সম্পর্ক শুধু খাতা-কলমে। বলা বাহুল্য, এতে আমার কিছু এসে-যায়নি। বরং যারা প্রেসক্লাবকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিতে চেয়েছিলেন তারাই এখন রাস্তায়। প্রেসক্লাবের ভোটার তালিকায় অখ্যাত-সাইন বোর্ড সর্বস্ব অনেক তথাকথিত মিডিয়া হাউসের ব্যানারে বহু লোকের নাম রয়েছে যাদের বেশিরভাগই অ-সাংবাদিক। এরাই প্রেসক্লাবের নির্বাচনে দুর্বৃত্তদের শক্তির প্রধান উৎস। অথচ বহু বছর ধরে পেশায় থেকেও সদস্যপদ পাননি-এমন সাংবাদিকদের সংখ্যা তাদের চেয়েও বেশি। এবারের নির্বাচনের আগে দুপক্ষের মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ দেখে আশাবাদী হয়েছিলাম। জাতীয় রাজনীতিতে সমঝোতা চাইলে প্রেসক্লাবে কেন নয়? কিন্তু দেখা গেল সমঝোতা প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থেকেও ওই ব্যক্তিটি সমঝোতার প্যানেল অগ্রাহ্য করে একাধিক পদে মনোনয়নপত্র জমা দেন। তাদের কূটচালে সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তার মানে-যে কোনভাবেই তাকে কমিটিতে থাকতে হবে। সম্ভবত: এই কারনে যে, সাংবাদিক হিসেবে নয়, বহু বছর ধরে প্রেসক্লাবের কর্মকর্তাই তার একমাত্র পরিচয় এবং আয়ের বড় উৎস।
গত ২৮মে’র সাধারন সভায় তারই এক সময়ের সুহৃদ, বিএনপি-জামায়াত সমর্থক ফোরামের অন্যতম নেতা, ক্লাবের সাবেক সভাপতি খোন্দকার মনিরুল আলম পরিষ্কার করেই বলেছেন, ওই ব্যক্তিই প্রেসক্লাবের সকল নষ্টের মূল। এই ফোরামের আরেক নেতা, প্রবীন সাংবাদিক আমানুল্লাহ কবির-ও তাই বলেন। ওই সভার মাধ্যমে যেভাবে বর্তমান কমিটি গঠিত হয়েছে তা কাম্য ছিলনা। কিন্তু নিয়মের মধ্যে থেকে যেহেতু দুর্বৃত্তায়ন দুর করা যাচ্ছিলনা এবং কতিপয় দুর্বৃত্তের কারনে সর্বসম্মত সমঝোতাও সম্ভব হয়নি, তাই অনিয়মই আরেক অনিয়ম ডেকে এনেছে। ওই সভায় আওয়ামী ফোরামের সদস্যদের সঙ্গে বিএনপি ফোরামের সদস্যদের একাংশের উপস্থিতি এবং সেখানে গঠিত কমিটিতে তাদের অংশগ্রহন এই উদ্যোগের যৌক্তিকতাও প্রমান করছে। আর গত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত কমিটির বর্ধিত মেয়াদ-ও ৩০ মার্চ শেষ হয়ে যাওয়ায় তারা এখন আর নিজেদেরকে বৈধ বলে দাবি করতে পারেনা।
এখন সুযোগ এসেছে ভোটার তালিকা থেকে সাংবাদিক নামধারীদের বাদ দেয়া, ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা, রাজণৈতিক সমর্থন না দেখে প্রকৃত সাংবাদিকদের সদস্যপদ দেয়া এবং অতীতের দুর্নীতি-অনিয়মের বিচার করার। বর্তমান কমিটির সবাইকে পছন্দ হয়নি। এ ধরনের কমিটি পুরোপুরি পছন্দসই হয়ওনা। তারপরও এ কমিটি যদি এই কাজগুলো করতে পারে তাহলে নিকট অতীতের নির্বাচিত কমিটিগুলোর চেয়ে এই কমিটিই সাধারন সদস্যদের কাছে বেশি গ্রহনযোগ্যতা পাবে বলে মনে করি।
{লেখক: চীফ নিউজ এডিটর,মাছরাঙ্গা টেলিভিশন।}
[লেখাটি লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে সংগৃহীত।।]