ছিটমহল নিয়ে কিছু কথা
সমর পাল: ছিটমহল নামটি নতুন না হলেও বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৯৫টি ছোট-বড় ছিটমহল রয়েছে, যার মোট আয়তন ১২,২৮৯.৩৭ একর বা ১৯.২০২ বর্গমাইল বা ৪৯.৭৫ বর্গকিলোমিটার। অনুরূপভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের অনেক ছিটমহল রয়েছে। কালের পরিক্রমায় অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিটমহল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের পঞ্চগড়, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার বোদা, দেবীগঞ্জ, হাতিবান্ধা, আদিতমারি, লালমনিরহাট, ফুলবাড়ী ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলার ৯৫টি বিভিন্ন ছিটমহল ভারতের কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ, মাথাভাঙ্গা, শীতলখুচি, দীনহাটা ও তুফানগঞ্জ থানার মধ্যে পড়েছে। ৯৫টি বাংলাদেশি ছিটমহলের মধ্যে পঞ্চগড় জেলায় ২১টি, লালমনিরহাট জেলায় ৪১টি এবং কুড়িগ্রাম জেলায় ৩৩টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিটমলহ হলো লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা, যার আয়তন ৪৬১৬.৮৫ একর বা ৭.২১৪ বর্গমাইল বা ১৮ বর্গকিলোমিটার। ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট ছিটমহল হলো পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলায়, যার আয়তন মাত্র ১৭ শতক।
কোচবিহারের সঙ্গে বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ছিটমহল সংক্রান্ত বিষয় অনেকের কাছেই অজানা বিস্ময়। কীভাবে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে কিছু বলার উদ্দেশ্যে এ নিবন্ধের অবতারণা। যে কোনো আগ্রহী পাঠক সামান্য চেষ্টা করলেই এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারেন বইপত্র খুলে। আমার চেষ্টায় ভুল থাকলে সহৃদয় পাঠক সংশোধনে সহায়তা করবেন বলে আশা করি।
ছিটমহল নিয়ে অনেক আলোচনা, পর্যালোচনা, সমালোচনা হলেও বিষয়টি নিয়ে ইতিহাসবিদ ও প-িতজনের রচনায় কার্যকর গবেষণাপ্রসূত উৎপত্তিকথা পাওয়া কঠিন। ছিটমহলের বিষয়ে অতীতের দিকে তাকানো প্রয়োজন বলে মনে করি।
যে অঞ্চলে ছিটমহলগুলো অবস্থিত তা প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই ছিল প্রাচীন কামরূপের অধীন। এই কামরূপ বা প্রাগ্জ্যোতিষের সীমানা বহুবার পরিবর্তিত হয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে এই বিশাল রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল আসামের পূর্বপ্রান্ত থেকে উত্তরবঙ্গের করতোয়া নদী পর্যন্ত। প্রাচীন কামরূপের চারটি বিভাগ বা পীঠ হলো কামপীঠ, সৌমারপীঠ, স্বর্ণপীঠ ও রতœপীঠ। বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুরের এই অঞ্চল ছিল কামরূপের রতœপীঠ বিভাগের অন্তর্গত। নানা সময়ে নানা বংশের রাজা বা শাসক এই অঞ্চলের খ- খ- অংশে কর্তৃত্ব করেছেন। পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আলোচ্য এলাকা অরাজক অবস্থায় ছিল বলে জানা যায়।
১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.) কামরূপের অন্তর্গত কামতারাজ্য অধিকার করেন। সে সময় করতোয়া থেকে মানস নদী পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল ছিল কামতারাজ্য নীলাম্বরের রাজ্য। হুসেন শাহের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হলে বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুরের বিশাল অঞ্চল অর্থাৎ কামতারাজ্য সুলতানের অধিকারে যায়। পরবর্তী সময়ে কোচরাজ বিশ্বসিংহ (১৪৯৬-১৫৩৩ খ্রি.) অঞ্চলটি জয় করেন এবং ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই এ এলাকা থেকে গৌড়ীয় সুলতানের অধিকার লুপ্ত হয়। অতঃপর দখল ও পুনর্দখলের জন্য এ অঞ্চলে যুদ্ধ ও সন্ধির ঘটনা ঘটেছে।
১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি.) গৌড় দখল করেন। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হন টোডরমল। তখনও উত্তরবঙ্গে মোগল শাসন পাকাপোক্তা হয়নি। টোডরমল উত্তরবঙ্গে আসতে পারেনি। মোগল-পাঠান দ্বন্দ্বের কারণে অঞ্চলটি অশান্ত ও উত্তপ্ত ছিল। এ অবস্থায় বিহারে বসে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে টোডরমল তৈরি করলেন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজস্ব সেটেলমেন্ট। এটি জমা তুমার নামে পরিচিত। আলোচ্য অঞ্চলটি ঘোড়াঘাটের আওতায় দেখানো হয় রাজস্ব সেটেলমেন্টে। অথচ তখনও এখানে মোগল প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
শাহজাহানের (১৬২৭-১৬৫৮ খি.) পুত্র শাহ সুজা (১৬৩৯-১৬৫৯ খ্রি.) বাংলার সুবেদার থাকাকালে টোডরমলের জমাবন্দি কাগজ সংশোধন করে ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে আরেকটি রাজস্ব সেটেলমেন্ট কাগজ প্রস্তুত করেন। ওই সময় ২৪৬টি পরগনা নিয়ে তিনি কোচবিহার গঠন করেন। আলোচ্য স্থান কোচবিহারের মধ্যে ধরা হলো এবং তা মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত বলে গণ্য হলো মোগলদের হিসেবে। সে সময় মোগলদের উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে। সুযোগ বুঝে কোচরাজ প্রাণনারায়ণ (১৬৩২-১৬৬৫ খ্রি.) মোগল অধিকৃত বহু এলাকাসহ ঘোড়াঘাট পর্যন্ত অধিকার করে ঢাকা আক্রমণ করেন।
১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে সুবেদার মিরজুমলা ঢাকা থেকে কোচবিহার আক্রমণে অভিযান পরিচালনা করেন। ওই বছর ডিসেম্বরে তিনি কোচবিহার জয় করেন। এর ফলে আলোচ্য অঞ্চল মোগলদের অধিকারে চলে যায়। কিন্তু ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আবার শায়েস্তা খাঁর (১৬৬৩-১৬৭৮ খ্রি.) সঙ্গে সন্ধির ফলে এলাকাটি মোগলদের হস্তচ্যুত হলো। ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খাঁর ছেলে এবাদত খাঁ ছিলেন ঘোড়াঘাটের মোগল ফৌজদার। তিনি ওই বছর কোচরাজ মহীন্দ্রনারায়ণের (১৬৮২-১৬৯৩ খ্রি.) এলাকায় আক্রমণ পরিচালনা করেন।
রংপুরের সদ্যপুষ্করিণী হয়ে নবাবগঞ্জ, মাহিগঞ্জ অতিক্রম করে এবাদত খাঁ বর্তমান লালমনিরহাট জেলার মোগলহাটে ছাউনি গাড়েন। অতঃপর কাকিনার দিকে অগ্রসর হন। ওই সময় কোচবিহারের অধিকৃত বহু এলাকা মোগলদের অধিকারে চলে যায়। দীর্ঘদিন যুদ্ধবিগ্রহ চলতে থাকে। অবশেষে ১৭১১ খ্রিস্টাব্দে ফৌজদার আলী কুলী খাঁর সঙ্গে কোচবিহাররাজের সন্ধি হয়। সন্ধির ফলে কোচবিহারের রাজা ফিরে পান বোদা, পাটগ্রাম ও পূর্বভাগ চাকলা। উল্লেখ্য যে, আজকের বোদা, দেবীগঞ্জ, তেঁতুলিয়া ও পঞ্চগড়ের নানা অংশ ছিল বোদা চাকলায়; পাটগ্রাম ও হাতিবান্ধার অনেক অংশ ছিল পাটগ্রাম চাকলায় এবং লালমনিরহাট আদিতমারী, ফুলবাড়ী ও ভূরুঙ্গামারীর বেশ কিছু অঞ্চল ছিল পূর্বভাগ চাকলায়।
১৭১১ খ্রিস্টাব্দের এই সন্ধি মোগল কর্তৃপক্ষের পছন্দ হয়নি। মোগল সেনাপতি ইয়ার মোহাম্মদের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে কোচরাজের হস্তচ্যুত হলো ফিরে পাওয়া তিনটি চাকলা। এগুলো দখল করে বিক্ষিপ্ত মোগল সৈন্যদের স্থায়ী অবস্থানের জন্য সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় তাদের প্রতিষ্ঠিত করে মোগল কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থার বিরুদ্ধে কোচবিহারে প্রজাবিদ্রোহ দেখা দেয়। ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে বাংলার নাজিম খানজাহান খান চাকলা তিনটি মোগল অধিকারে নিয়ে নেন পাকাপোক্তাভাবে। ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে আবার কোচ-মোগল সন্ধি হয়।
১৭১৩ খ্রিস্টাব্দের মোগল-কোচ সন্ধির ফলাফলই মূলত ছিটমহল উৎপত্তির প্রধান কারণ। সে সময় লক্ষ করা হয় যে, সীমান্তের কাছাকাছি কোচবিহারের অধিকারভুক্ত বেশকিছু এলাকায় (বোদা, পাটগ্রাম ও পূর্বভাগ চাকলায়) রয়েছে কোচবিহাররাজের প্রতি অনুগত প্রজা ও কর্মচারী। এসব এলাকা রাজগির নামে পরিচয় পেল। সন্ধির ফলে স্থির হয় যে, কোচবিহার রাজ্যভুক্ত মোগল আনুগত্য পোষণকারী প্রজা ও কর্মচারীদের দখলকৃত (মোগলমি) জায়গাগুলোর ওপর মোগল আধিপত্য স্বীকার করতে হবে। অনুরূপভাবে মোগল অধিকারভুক্ত রাজগিরে কোচবিহাররাজের অধিপত্য মেনে নেয়া হবে। মূলত এই সন্ধির ফলাফলই ছিটমহল সৃষ্টির আদিসূত্র।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের দেশ ভাগের সময় কোচবিহার দেশীয় রাজ্য হিসেবে বহাল থাকায় ওই সময় ভারত বা পাকিস্তানের মধ্যে ছিটমহল বিষয়টি আগের মতোই ছিল। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে কোচবিহার রাজ্য ভারত ইউনিয়নে শামিল হলেও তৎকালীন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সমস্যাটি থেকেই যায়।
[সমর পাল: বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন-এর সদস্য।]