ইতিহাস ঐতিহ্যে আমাদের সিলেট- পর্ব ১
সিলেট। বাংলাদেশের অতিপরিচিত একটি জেলা। ওলীকুলের শিরোমণি হযরত শাহজালাল (রঃ), হযরত শাহপরাণ (রঃ) ও ৩৬০ আউলিয়ার পদধূলিতে ধন্য হবার কারণেই সিলেটকে বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী বলা হয়ে থাকে। সিলেট অঞ্চলের স্বাতন্ত্র্য ভাষা, বর্ণমালা, সংস্কৃতি ও রীতিনীতির কারণেই বাংলাদেশের অন্যান্ন যেকোন অঞ্চল থেকে সহজেই সিলেটকে আলাদা করা যায়। সিলেট অঞ্চল প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের ভরপুর এছাড়াও প্রবাসী অধ্যুষিত হওয়ার কারণেই সিলেট অঞ্চল বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অর্থনৈতিকভাবেও বেশ সমৃদ্ধশালী একটি জেলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সিলেটের পরিচিতি আজ শুধু বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং বিশ্বের বিভিন্নস্থানে সিলেটের নাম ডাক ছড়িয়ে পড়েছে। সিলেটের সমৃদ্ধশালী প্রাকৃতিক, খনিজ ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার মতোই সিলেটের সুপ্রাচীন হাজার হাজার বছরের ইতিহাসও বেশ স্বচ্ছল ও সমৃদ্ধশালী। বেশ কিছু দিন থেকেই সিলেটের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে একটা ধারাবাহিক লেখা প্রকাশের ইচ্ছা ছিলো কিন্তু নানান প্রতিকূলতায় তা এতোদিন হয়ে উঠেনি। বেশ কিছু বই ঘাঁটাঘাঁটি করে এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমার এই ধারাবাহিক লেখা সাজানোর চেষ্টা করেছি। লেখার শেষ পর্বে বইয়ের নাম ও সূত্রগুলো উল্লেখ করবো।
ইতিহাস ঐহিত্যে ভরপুর সিলেট এক প্রাচীন জনপদ। প্রাচীন কালে বাংলাদেশের বিশাল অংশ যখন সাগরের গর্ভে লীন সিলেট তখনো সভ্য সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছিলো। যদিও একটা সময় সিলেটের ভাটি অঞ্চলও ছিলো অথৈ জলের নীচে কিন্তু উঁচু ও পার্বত্য এলাকায় ছিলো জনবসতি। ঠিক কোন সময়ে সিলেটে জনবসতি গড়ে উঠে তা এখনো সুস্পষ্ট ভাবে জানা যায়নি। ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়েছে খৃষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার অব্দে। ইতিহাস বিজ্ঞানীরা ঐতিহাসিক যুগকে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগে ভাগ করে গেছেন। ইতিহাসের প্রাচীন যুগ থেকেই সিলেটে জনবসতির নানান নিদর্শন পাওয়া যায়। প্রাচীন যুগের ইতিহাস দাঁড়িয়ে আছে পৌরাণিক গ্রন্থাদি, কিংবদন্তী, তন্ত্রমন্ত্র, শিলালিপি ইত্যাদির উপর ভর করে। এসব উৎস ঘেঁটে দেখা গেছে খৃষ্টপূর্ব চার হাজার অব্দেও সিলেটে উন্নত সমাজ ব্যবস্থা চালু ছিলো। বর্তমানে সিলেট চারটি জেলায় (সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ) বিভক্ত, প্রাচীন কালেও সিলেট অঞ্চল বিভিন্ন খন্ডরাজ্যে বিভক্ত ছিলো। এসব খন্ডরাজ্যের আয়তন ও সীমায় বারবার পরিবর্তন হয়েছে, অভিহিতও হয়েছে বিভিন্ন নামে। প্রাচীন কালে সিলেট অঞ্চল ছিলো কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত। কামরূপের রাজা ছিলেন ভগদত্ত, সিলেটের লাউড় পাহাড়ে ভগদত্তের একটি উপরাজধানী ছিলো। ঐ পাহাড়ের একটি স্থানকে এখনো ভগদত্ত রাজার বাড়ি বলা হয়। “যোগিনীতন্ত্রে” কামরূপের সীমানা বর্ণিত আছে সেই সাথে সিলেটের সীমা সম্পর্কেও রয়েছে একটি শ্লোক। এতে শ্রীহট্ট শব্দের উল্লেখ ছিলো। বিভিন্ন তন্ত্রেমন্ত্রেও সিলেটের উল্লেখ আছে। তন্ত্রের উৎস হচ্ছে বেদ গ্রন্থাদি। বেদের রচনাকাল ২০০০-৮০০ খৃষ্টপূর্ব। তন্ত্রগুলোতে সিলেটকে শ্রীহট্ট, শিরিহট্ট, শিলহট্ট, বা শিলহট বলা হয়েছে। তবে সব তন্ত্রই খৃষ্টপূর্ব সময়ে রচিত নয় তাই অনেকের ধারণা শ্রীহট্ট বা সিলেট অনেক পরে প্রচলিত হয়েছে তবে এক কথা সুস্পষ্ট যে ১৩০৩ খৃষ্টাব্দে হযরত শাহজালালের (রঃ) আগমনের পর সিলেট নামের এই পূণ্যভূমি শিলহট, জালালাবাদ, বা বর্তমান সময়ে সিলেট নামে পরিচিত হয়ে উঠে।
সিলেট নামের উৎপত্তি নিয়ে অনেকগুলো মত আছে। বিভিন্ন মত থেকে যা জানা যায় তা হলো:-
১. এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমানে শিলা, শিল বা পাথর পাওয়া যেত। এখনো পাথর শিল্পে সিলেট অঞ্চল বাংলাদেশের অন্যান্ন অঞ্চল থেকে এগিয়ে রয়েছে। এই পাথরকে সিলেটের স্থানীয় লোকেরা শিল বলেই ডাকতো। বড় বড় আকৃতির শিলের উপরেই বাজার বা হাট বসতো এই শিলা এবং হাট যুক্ত হয়ে শিলা হাট, শিল হাট, শিল হট্ট যা ক্রমে ক্রমে পরিবর্তিত হয়ে সিলেট শব্দে রূপান্তরিত হয়েছে।
২. হযরত শাহজালাল (রঃ) ও তার সঙ্গী সাথীদের পথ রোধ করার জন্য তৎকালীন হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দ তার রাজধানীর প্রবেশ পথে বড় বড় শিল ফেলে রেখেছিলেন। হযরত শাহজালাল তখন “শিলহট” (পাথর সরে যা) বলার সাথে সাথে পাথরগুলো সরে যেত। এই থেকেই শিলহট নামের নামের উৎপত্তি।
৩. গৌড়ের রাজা গুহক তার কন্যা শিলার নামে রাজধানীতে একটি হাট স্থাপন করে নাম রাখেন শিলাহাট। একসময় এই নামই শ্রীহট্টে পরিচিত পায়।
৪. শ্রী শব্দের অর্থ সৌন্দর্য, লাবণ্য বা সম্পদ। শ্রী’র হস্ত বা হাত থেকে শ্রীহস্ত যা রূপান্তরিত হয়েছে শ্রীহট্টে। এখানে উল্লেখ্য যে আলবেরুনীর কিতাবুল হিন্দ-এ “সিলাহাত” শব্দের উল্লেখ আছে। মুসলিম আমলে ‘সিলহেট’ নাম প্রচলিত ছিলো। দশম শতাব্দীর পশ্চিমভাগ তাম্র শাসনে “শ্রীহট্টমন্ডল” উল্লেখ রয়েছে। ইংরেজ আমলে প্রথম দিকে কাগজ পত্রে SILHET লেখা হতো। পরে SILCHAR (বর্তমানে ভারতের শিলচর) থেকে পার্থক্য দেখাবার জন্য SILHET থেকে SYLHET এ রূপান্তরিত হয়ে যায়।
মহাভারতের যুগে জৈন্তাকে নারীরাজ্য বলা হতো। জৈমিনী ভারত গ্রন্থের তথ্য অনুযায়ী ‘প্রমীলা’ ছিলেন জৈন্তা রাজ্যের রাণী। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বিজয়ী যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞের অশ্ব প্রমীলা আটক করেন। খবর পেয়ে মহাবীর অর্জুন চারজন যোদ্ধাসহ ছুটে আসেন জৈন্তায় রাণী প্রমীলার বিরুদ্ধে যুদ্ধের লক্ষ্যে। কিন্তু রমণীর সাথে যুদ্ধে কৃতিত্ব নেই ভেবে রাণীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আপোষ করেন এবং অশ্ব মুক্ত করে ফিরে যান।
সিলেটের নদ-নদীও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কাছে অতি পবিত্র। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থেও সিলেটের বিভিন্ন নদ-নদীর নাম উল্লেখ রয়েছে। কিরাত রাজ্য নামে একটি রাজ্যের কথা জানা যায় বিষ্ণুপুরাণে। কিরাত ভূমিতে সিলেটের হরিপুরের তপ্তকুন্ড প্রস্রবন ও গরুঢ় পুরাণে কিরাত দেশের মনু নদীর কথা আছে। এছাড়া হিন্দুশাস্ত্র গ্রন্থসমূহে সিলেটের নদ-নদীর নাম পাওয়া যায়। রাজমালার বর্ণনায় জানা যায় যে আদিযুগে মনু যে নদীর তীরে বসে শিবপূজা করতেন সেটিই আজকের মনু নদী যা সিলেটের উল্লেখযোগ্য নদীগুলোর একটি। বরবক্রের (বরাক) উল্লেখ আছে তীর্থ চিন্তামণিতে আছে, আর এই বরাক উপত্যকা থেকেই বাংলাদেশের সবচে গভীরতম নদী কুশিয়ারা জন্ম। কুশিয়ারা হচ্ছে সিলেটের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী। অমরকোষ অভিধানে বর্ণিত “শরাবতী”-কে কেউ কেউ সুরমা মনে করেন। এসব নদীর পানি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে অতি পবিত্র। সিলেট অঞ্চল সেই রামায়নের যুগেও পবিত্রভূমি রূপে চিহ্নিত ছিলো। আর্যরা বাংলার বিশাল অংশকে অপবিত্র বলে অভিহিত করলেও সিলেট অঞ্চল ছিলো এই আওতার বাইরে। এর মূল কারণ হচ্ছে সিলেটে রয়েছে দুটি পীঠস্থান। উপমহাদেশের ৫১টি দেবী পীঠের মধ্যে দুটির অবস্থান সিলেটে। সিলেট শহরের খাদিমনগরের ‘কালাগোল’ নামক স্থানে রয়েছে গ্রীবাপীঠ এবং অন্যটি জৈন্তার ফালজুরে বামজঙা পীঠ অবস্থিত। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এই বিশ্বাস প্রচলিত যে এসব পীঠস্থান দর্শনে পাপ মোচন ও পুণ্য অর্জন হয়।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছেও সিলেট এক পবিত্র ভূমি হিসেবে পরিচিত। বৌদ্ধগ্রন্থ মতে সিলেট শহরেই ছিলো জাগ্রত বৌদ্ধতীর্থ। সাধনমালা গ্রন্থে ওড়িয়ান, পুর্ণগিরী ও কামাখ্যার সাথে সিলেট সিদ্ধপীঠের উল্লেখ আছে। গোপীচন্দ্রের গীতিকায় ভবানীদাস বৌদ্ধদের আদ্যমাটির বর্ণনায় লিখেছেন “…আর আছে অদ্যামাটির তরপের দেশ” বর্তমান হবিগঞ্জকে তখনকার সময় তরপের দেশ বলে ডাকা হতো। ডাকার্নব গ্রন্থে উল্লেখিত ৬৪টি তান্ত্রিক পীঠের একটি হরিকোল বা হরিকেল। প্রাচীন কালে বাংলাদেশ বিভিন্ন জনপদে বিভক্ত ছিলো। গৌড়, পুন্ড্র, হরিকেল, সমতট ইত্যাদি। হরিকেল এই সিলেটেরই একটা নাম বলে গবেষকদের অভিমত।
চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন। সপ্তম থেকে দশম শতাব্দির মধ্যে বৌদ্ধ সিদ্ধার্থগণ চর্যাপদ রচনা করেন। চর্যার ভাষা, শব্দ প্রভৃতি বিশ্লেষণ করে গবেষক অধ্যাপক আসাদ্দর আলী প্রমাণ করেছেন যে চর্যার একাধিক পদকর্তা ছিলেন সিলেট অঞ্চলের লোক। এই সব বর্ণনা থেকে সহজেই এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে সিলেট অঞ্চল হচ্ছে বাংলাদেশের প্রাচীনতম জনপদের একটি। বিভিন্ন গ্রন্থের বর্ণনা মতে সূদূর অতীতেও সিলেট পবিত্র ভূমি রূপে বিবেচিত হয়েছে।
চলবে…