দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের জন্য এই প্রথম শীর্ষস্থানীয় কোনো আলবদর কমান্ডার হিসেবে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের সর্বোচ্চ শাস্তি বাংলার মাটিতে কার্যকর হলো। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড শুধু কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে ছিল না, এই নীলনকশা এবং চক্রান্ত ছিল আমাদের ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে। না হলে রাজনৈতিক বিজয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের উন্মেষ যখন নিশ্চিত, তখন কেন তালিকা করে ঘর থেকে ধরে নিয়ে এ দেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবী ব্যক্তিগুলোকে মারবার প্রয়োজন হলো? এই বিষয়টি আমাদের স্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে হবে। বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হলেও মন আর মানসিকতায় যেন পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ থাকে- এই ছিল চক্রান্ত স্বাধীনতাবিরোধীদের। যে বুদ্ধিজীবীদের নৃশংসভাবে মারা হলো, তারা শুধু নিজেদের পেশায় সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিই ছিলেন না, তারা ছিলেন সেই মানুষ যাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতির মন ও মননে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতার মহানূভব চেতনা, শোষণহীন সমাজের আকাঙ্ক্ষা, স্বাধিকার ও স্বাধীনতার চেতনার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল।
এই মহান মানুষগুলো স্বাধীন বাংলাদেশকে সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শুধু স্বপ্নই দেখেননি, তা বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাও ছিল তাদের। আমি আমার বাবার কথা বলতে পারি। চক্ষু চিকিৎসক আমার বাবা শহীদ ডা. আলিম চৌধুরী ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলনসহ সব সংগ্রামে এবং মুক্তিযুদ্ধে যেমন অবদান রেখেছেন, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশে গরিব মানুষের জন্য স্বল্প বাজেটে কীভাবে দরিদ্রবান্ধব স্বাস্থ্যব্যবস্থা তৈরি করা যায় তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আমার বাবার ছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তারা বাংলাদেশে সুন্দর একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলবেন তেমন পরিকল্পনাও ছিল তাদের। সুতরাং একজন ডাক্তার আলিম চৌধুরীকে হারানোর ফলে শুধু একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞকেই হারানো হয় না, আমাদের ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারতেন- এমন একজন কাণ্ডারিকেও হারানো হয়। তেমনি একজন ডাক্তার ফজলে রাব্বিকে হারালে স্বাস্থ্য খাতে, একজন সিরাজুদ্দীন অথবা শহীদুল্লাহ কায়সারকে হারালে সাংবাদিকতা জগতে, একজন জহির রায়হানকে হারালে চলচ্চিত্র জগতে, একজন মুনীর চৌধুরী অথবা মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে হারালে শিক্ষকতা অথবা সাহিত্যজগতে শুধু যে এক অপূরণীয় ক্ষতি হয় তা নয়, এই প্রতিটি পেশাগত ক্ষেত্রের ভবিষ্যৎকেও নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়।
এখানেই বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের সবচেয়ে বড় অপরাধ। অর্থাৎ বাংলাদেশের ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে তারা আঘাত হেনেছিল।
সুতরাং শুধু হারিয়ে যাওয়া পিতার প্রতি নয়, আমাদের বাঙালির ঘরে প্রজন্মের পর প্রজন্মে যত সন্তান আসবে, তাদের সবার কাছে কৃত অপরাধের জন্য এই অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার মধ্য দিয়ে আমরা ভবিষ্যতের কাছেও দায়মুক্ত হলাম। কারণ ওরা আমাদের ভবিষ্যৎ গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। ভবিষ্যতের অনাগত সন্তানের জন্য, হারিয়ে যাওয়া পিতার জন্য, লাঞ্ছিত মায়ের জন্য, আমাদের দেশের জন্য এই বিচার অবশ্যকর্তব্য ছিল। এ কারণেই এই অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে একতাবদ্ধ হয়েছি আমরা।
একইভাবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দণ্ডটি শুধু অতীত পাপাচারের জন্য নয়, ভবিষ্যতের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতো দুর্মুখ, দুর্বিনীত, দুরাচার, অসভ্য ও অভদ্র রাজনীতিবিদ বাংলার মাটিতে কখনো এসেছিল কি না সন্দেহ আছে। ক্রমাগত দম্ভোক্তি, আস্ফালন ও অকথ্য ভাষায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা, দেশমাতৃকা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ক্রমাগত পদাঘাত করেছে এই নিকৃষ্ট রাজনীতিবিদ। শুধু তাই নয়, নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে ভাবার মতো স্পর্ধা দেখাতেও সে কুণ্ঠিত হয়নি। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির মধ্য দিয়ে এ কথা ভবিষ্যতের সব প্রজন্মের কাছে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ হলো যে- দেশমাতৃকার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বা বেঈমানির সাজা বাংলার মাটিতে এভাবেই হয় এবং হবে। সেই সঙ্গে এই বার্তা স্পষ্টভাবে আবার উচ্চারিত হলো্- কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, সে যতই ক্ষমতাশালী হউক।
সুতরাং এই দুটি বিচারকার্য ও শাস্তির মধ্য দিয়ে শুধু একাত্তর সালে সংগঠিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারই করা হয়নি, সেই সঙ্গে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে ভবিষ্যতে এমন একটি স্বদেশ গড়ে তোলার পথ প্রদর্শন করা হলো, যেখানে দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, সুশাসন, সুবিচার ও মানবতাবোধ সমুন্নত থাকবে।
কাল রাত থেকে আজ আমি সারা দিন অনেক কেঁদেছি। কাল রাতের পর থেকে আমার মায়ের সঙ্গে এখনো দেখা হয়নি। বারবার মায়ের মুখটি মনে পড়ছে। দীর্ঘ সংগ্রাম, কষ্ট, কণ্টকাকীর্ণ প্রতীক্ষার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মা আজ দেখতে পেলেন তার নিরপরাধ দেশপ্রেমিক মেধাবী স্বামীর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। এত স্বস্তি, এত আনন্দের ভেতরেও চোখের জল বাঁধ মানছে না। এই সেই যুদ্ধাপরাধীরা, যারা এ দেশের বিরুদ্ধাচরণ করার পরেও এই দেশের মন্ত্রী হয়েছেন। আমার অভাগা মা তার স্বামীর হত্যাকারীদের দেখেছেন স্বামীর রক্তে রাঙানো পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে দম্ভভরে চলতে। তাই আমার বুকের কষ্ট আজও পাঁজর ভেঙে দেয়। অথচ কী সামান্য চাওয়া! হত্যাকারীদের বিচার চাই- শুধু এতটুকুই। দেশবিরোধীদের বিচার চাই।
এত বড় অন্যায়, অবিচার ও হত্যাকাণ্ডের বিচার পাওয়ার কথা তো ছিল অনেক আগেই। এটা তো আমাদের সাংবিধানিক অধিকার, নাগরিক অধিকার, সর্বোপরি এ আমার মানবাধিকার। অথচ এই সামান্য অধিকারটুকু পাওয়ার জন্য কী দীর্ঘ প্রতীক্ষার পথ পাড়ি দিতে হয়েছে! কী লাঞ্ছনা, বঞ্চনা ও নিপীড়নের মুখোমুখি হতে হয়েছে! কত আন্দোলন, কত সংগ্রাম, কত উত্তপ্ত রাজপথের মিছিলে পথ হাঁটা! এক বীর শহীদের মা হয়েও শহীদজননী জাহানারা ইমাম তো পরপারেই চলে গেলেন দেশদ্রোহের মিথ্যা অপবাদ মাথায় নিয়ে। কী লজ্জা, কী লজ্জা! সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেশ আজ অন্তত এই অবস্থানে এসেছে যে, আজ আমার মা সেই নিকৃষ্ট যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে দেখে গেলেন। এটুকুই শান্তি। আমার মায়ের হৃদয়ে শেষ বয়সে এতটুকু শান্তি এনে দেয়ার জন্য আমি দেশের প্রতিটি মানুষ এবং সরকার ও সর্বোপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। বাংলাদেশ আজ এক গর্বিত দেশ। বাঙালি বীরের জাতি, সেটা আবার প্রমাণিত হলো। বাংলাদেশ, তোমাকে স্যালুট।
[লেখক: একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আবদুল আলীম চৌধুরীর কন্যা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।]