ডিজিটালকরণে কম্পিউটার সাক্ষরতা অপরিহার্য
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: বিশ্ব কম্পিউটার সাক্ষরতা দিবস আজ। ২০০১ সালের ২ ডিসেম্বর থেকে বিশ্বব্যাপি দিবসটি পালন করা হয়। বিশ্বের বিদ্যমান ডিজিটাল ডিভাইড দমন করার লক্ষ্যে-ই এই দিবসটির মূল উপাত্ত। এছাড়া এই দিনে ‘ডিভাইড’ সচেতনতা বৃদ্ধি এবং অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্য তথ্য প্রযুক্তি প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়। প্রযুক্তি’র উত্থানের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে আইসিটি কিংবা ‘গ্লোবাল ভিলেজ’। তথ্য ও যোগাযোগ আদান-প্রদানে ইন্টারনেটের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আইসিটি এখনও একটি ভারসাম্যহীন সম্প্রদায়। বিশেষত ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট এক্সেস।
চলতি বছরের ৬ জুলাই মন্ত্রিসভা বৈঠকে ‘জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা-২০১৫’ অনুমোদিত হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রযুক্তির প্রয়োগ ও প্রসারে পালনীয় নির্দেশিকা হিসেবে ২০০৯ সালে প্রথম ওই নীতিমালাটি প্রণীত হয়েছিল। গত ছয় বছরে দেশে আর্থসামাজিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন,তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভূতপূর্ব সম্প্রসারণ ও নব নব উদ্ভাবনীর কারণে নীতিমালাটি হালনাগাদ করার প্রয়োজন হয়েছে। এজন্য এ প্রক্রিয়ায় আগের ৩০৬টি করণীয় বিষয়ের স্থলে এখন ২৩৫টি করণীয় বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছে সময়ের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে। আগেই এ নীতিমালাটি প্রণয়নকালে যৌক্তিক ভিত্তি হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করা এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের নীতিকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। নীতিমালার ভাষ্যমতে,সংবিধানের এ মূল্যবোধ সঞ্চারে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। তাই সমাজে কোনোরূপ Digital Divide যেন না থাকে সে কথা মনে রেখেই রাষ্ট্রের সব পরিকল্পনাবিদ, নির্বাহী এবং একইসঙ্গে বেসরকারি খাত ও সুশীল সমাজের সবাই ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে জনসেবা প্রদানের জন্য এ নীতিমালাটি অনুসরণীয় নির্দেশিকা হিসেবে ব্যবহার করবেন।
বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের কারণে তা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও মানুষের আগ্রহ ও উৎসাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত মোবাইল প্রযুক্তি এক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে। বিটিআরসি’র তথ্যানুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ৭৪ লাখ এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৪ কোটি ৮৩ লাখ। দেশের ৫ হাজার ২৭৫টি ইউনিয়ন,ওয়ার্ড ও পৌরসভায় ডিজিটাল সেন্টার স্থাপনের মধ্য দিয়ে প্রযুক্তির সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়েছে। এছাড়া ডাক বিভাগের সাড়ে ৮ হাজার ডাকঘর পর্যায়ক্রমে ডিজিটাল সেন্টারে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। অধিকন্তু সরকারি দফতরের ২৫ হাজার ওয়েব পোর্টাল তৈরি,বিভিন্ন ধরনের সরকারি সেবার মোবাইল অ্যাপস উন্নয়ন,শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও কম্পিউটার ল্যাব স্থাপনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। দেশের সচিবালয় থেকে শুরু করে জেলা ও উপজেলা পর্যন্ত ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল লাইন স্থাপনের কাজ প্রায় সম্পন্ন। এছাড়া এগিয়ে চলেছে হাইটেক পার্ক স্থাপনের কাজও। গত ৬ বছরের অগ্রগতির জন্য বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। বাংলাদেশ পেয়েছে South South Award, South South Co-operation Visionary Award, WITSA Ges WSIS Award. বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তিতে উন্নতির নির্ণায়ক আন্তর্জাতিক এসব স্বীকৃতি। সুতরাং ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অভিযাত্রায় এরকম নজরকাড়া উন্নতির প্রেক্ষিতকে সামনে রেখে আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশায় ২০০৯ সালের নীতিমালা হালনাগাদ করে ২০১৫ সালে নতুন নীতিমালা প্রণীত হয়েছে। এ নীতিমালায় রয়েছে একটি রূপকল্প,১০টি উদ্দেশ্য,৫৪টি কৌশলগত বিষয়বস্তু এবং ২৩৫টি করণীয় বিষয় ও কর্মপরিকল্পনা। রূপকল্প ও উদ্দেশ্যকে জাতীয় লক্ষ্যের (Goal) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে কৌশলগত বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা হয়েছে। কর্মপরিকল্পনাগুলোকে আবার স্বল্পমেয়াদি,মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি করে যথাক্রমে ২০১৬,২০১৮ ও ২০২১ সাল পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। নীতিমালার রূপকল্প ও উদ্দেশ্যগুলো সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে।
মহাজোট সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের মূল হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষায় ডিজিটালকরণে কম্পিউটার সাক্ষরতাকে অপরিহার্য করণীয় হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ব্যক্তি থেকে সরকারি পর্যায়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে এ আন্দোলনে স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ প্রয়োজন। দেশে নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে সাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন করতে গণস্বাক্ষরতা আন্দোলন এবং বিভিন্ন কর্মসূচি হয়েছে। সরকারের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় ১৯৯১ সাল থেকে এ আন্দোলন শুরু হয়। মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষা কার্যক্রম,মন্দিরভিত্তিক গণশিক্ষা কার্যক্রম এমনকি পাড়ায়-মহল্লায় গণশিক্ষা স্কুল প্রভৃতি কার্যক্রমের মাধ্যমে এ স্বাক্ষরতা আন্দোলনে প্রাণ পায় । সরকারি ওয়েবসাইট তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশ স্বাক্ষরতায় ২৪ শতাংশ থেকে ১০০ ভাগ পর্যায়ে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের হাজার লোক নিরক্ষর থেকে স্বাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন হয়েছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে আজ সেই জনগোষ্ঠীকে প্রযুক্তিগত শিক্ষায় দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন কম্পিউটার সাক্ষরতা। কম্পিউটার সাক্ষরতায় ব্যাপকভাবে জনদক্ষতা তৈরিতে অতীতের মতো সাক্ষরতা আন্দোলন করা যেতে পারে এবং সেটা হবে কম্পিউটার বা প্রযুক্তিগত শিক্ষার ওপর। কম্পিউটার বা প্রযুক্তিগত শিক্ষাক্ষেত্রে মৌলিক যে সকল বিষয় জানতে হবে,তা হলো কম্পিউটার পরিচিতি,কম্পিউটারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ পরিচিতি,কম্পিউটারে বিদ্যুতের ব্যবহার,কম্পিউটার পরিচালনা, মাউস এবং কির্বোড ব্যবহার,ইংরেজি লিখন,বাংলা লিখন,সহায়ক অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার,মাইক্রোসফট অফিস প্রোগ্রামসমূহের ব্যবহার, ইন্টারনেট সংযোগ ও ব্রাউজিং,ইন্টারনেটে তথ্য অনুসন্ধান ও ব্যবহার, ই-মেইল যোগাযোগ, সামাজিক যোগাযোগ ও আন্তঃকম্পিউটার নেটওয়ার্কিং প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন প্রয়োজন। পাশাপাশি কম্পিউটার সংশ্লিষ্ট কিছু ইংরেজি টার্মস জানাও জরুরি। জনগণের অধিকাংশ কম্পিউটার সাক্ষরতা অর্জন করতে না পারলে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই থেকে যাবে। গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে জাতীয় ই-সেবা পদ্ধতি, অব্যবহূত থেকে যাবে জাতীয় ই-তথ্যকোষ,অকার্যকর হয়ে পড়বে শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি। অকার্যকর হয়ে পড়বে অনলাইন আউট সোর্সিং-এর মাধ্যমে বেকারত্ব দূরীকরণ ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিকল্পনাও। যতক্ষণ পর্যন্ত কম্পিউটার সাক্ষরতা বা কম্পিউটার বিষয়ে কোনো জ্ঞান অর্জন সম্ভব না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষায় ডিজিটালকরণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কাজেই জাতিকে ডিজিটালে রূপান্তর করার ক্ষেত্রে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে জনসাধারণের মধ্যে কম্পিউটার সাক্ষরতা তথা কম্পিউটার জ্ঞানে পারদর্শিতা ও সচেতনতা সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তবেই দেশকে প্রকৃত অর্থে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এ রূপান্তর সম্ভব হবে।
[শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।]
jsb.shuvo@gmail.com