মায়ের কোন তুলনা জগতে নেই
‘বিশ্ব মা দিবস’
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: আজ মে মাসের দ্বিতীয় রোববার । অর্থাৎ আজ বিশ্ব মা দিবস। বিশ্বের সকল মায়েদের প্রতি আমাদের রইল অশেষ শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। প্রতিটি দিবস পালনের অন্তরালে কিছু রহস্যময়ী ঘটনা থাকে। বিশ্ব মা দিবস ও সেই সকল ঘটনার ঊর্ধে নয়। মা দিবসের ঘটনার অন্তরালে রয়েছে বহুবিধ ইতিহাস। সেসকল ইতিহাসের সত্যতা নিয়েও নানান বাগ-বিতন্ডা রয়েছে। কিন্তু এতো সবের পরও, মায়েদের প্রতি সন্তানের অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রকাশের জন্য এই দিনটির আবেদন প্রতিটি সন্তানের কাছে-ই আলাদা এবং আবেগপূর্ণ।
জানা যায়, প্রাচীন প্যারিসে লর্ড যীশু খীষ্ট্রের উপবাসকে কেন্দ্র করে মে মাসের চতুর্থ রোববারে ‘মাদার ইন সানডে’ ঘোষণা করা হয়েছিলো। মূলত মায়েদের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা প্রদর্শন-ই ছিলো এই দিনটি পালনের উদ্দেশ্য। কিন্তু পরবর্ত্তীতে নানান ঝুট ঝামেলায় ভক্তদের সেই উদ্দেশ্য অনেকাংশে বুমেরাং হয়ে যায়। পুরুষশাসিত সমাজে নারী তথা মায়েদের জন্য একটি বিশেষ দিবসের আয়োজনের বিরেধিতায় লিপ্ত হন এক শ্রেণীর পুরুষ গোষ্ঠী। তাদের সেই বিরোধিতায় বিফলতায় পর্যবসিত হয় ‘বিশ্ব মা দিবস’। এর আরো বহু যুগ পরে তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এনা গারভিস নামের সুন্দরী এক তরুণী আত্ম প্রচেষ্টায় স্বাবলম্বী হয়ে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। এনা গারভিস অল্প বয়সে পিতৃহারা হওয়ায় মা’র কাছেই মানুষ হয়েছিলেন। জীবনে চলার পথে প্রতিটি পদক্ষেপে এনা উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন, সমাজে প্রতি পদে পদে নারীদের কতোটা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। এনা নিজের মাকে দিয়ে অবিস্কার করেছিলেন, মায়েদের দুঃখ-বেদনা এবং সন্তানের প্রতি মায়েদের তীব্র স্নেহ-ভালোবাসা। সেই সকল অনুধাবিত জ্ঞানকে বাস্তবে প্রতিফলিত করার জন্য এনা গারভিস তার মা’র স্মরণে একটি জনসচেতনতা মূলক প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি করেন। এনার লক্ষ্য অনুযায়ী ঐ প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কাজ হবে, মায়েদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি এবং মাসের একটি বিশেষ দিনে সমাজের সকল মাকে একত্রিত করে তাদের মধ্যে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। এনা গারভিসের মনে সুপ্ত বাসনা ছিলো বছরের অন্তত এমন একটি দিনকে স্বীকৃতি দেয়া হোক, যেই দিনে একজন মা পাবে তার প্রাপ্য পূর্ণ মর্যাদা ও সম্মান। সেই বিশেষ দিনটিতে মা পাবে তার সন্তানকে স্নেহ-ভালোবাসায় ভরে তোলার অকৃত্রিম সুযোগ। মা’র মন ভরে ওঠবে হাসি আর আনন্দে । চোখ ভেসে ওঠবে আনন্দ অশ্রুতে…! এনা গারভিসের সেই সুপ্ত বাসনা বাস্তবে রূপ লাভ করে ১৯০৭ সালের ১২ মে। দিনটি ছিলো এনার মায়ের মৃত্যু দিন। মায়ের সমাধিস্থল ওয়েস্ট ভার্জিয়ান গ্র্যাস্টেন চার্চে মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে ‘বিশ্ব মা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই সমাধিস্থল থেকে দাবী জনানো হয় এই দিনটিকে আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃতি প্রদানের এবং সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করার। পরবর্ত্তীতে নানান আন্দোলনের মুখে বিশ্বের দরবারে মা দিবসের পরিব্যপ্তি ঘটতে থাকে। ১৯১৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উনন্ড-উর-সন দিনটিকে ন্যাশনাল হলিডে হিসেবে ঘোষণা করেন। এনা গারভিসের ইচ্ছানুযায়ী প্রতি বছরের মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে নির্ধারণ করা হয় সকল মায়েদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য। সম্মান প্রদর্শনের নিদর্শন সরুপ মৃত মায়েদের সমাধিস্থলে সাদা গোলাপ এবং জীবীত মায়েদের জন্য লাল ও গোলাপি গোলাপের শুভেচ্ছাকে নির্ধারণ করা হয়। এরপর সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে সমান্তরালে এই দিনটির প্রচার এবং প্রসার বিশ্বব্যাপি বিস্তার লাভ করতে থাকে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এই দিনটিকে কেন্দ্র করে ছাপানো হয় কার্ড, কাগজের ফুলসহ নানাবিধ উপহার সামগ্রী। প্রকৃত অর্থে এই দিবসটি যে কারণে সৃষ্টি করা হয়েছিলো সেই উদ্দেশ্যের গুড়েবালি পড়ে! ক্রমান্বয়ে এই বিশেষ দিনটি একটি উৎসবমুখর ও ব্যবসায়ী ভিত্তিক দিবসে রূপায়িত হতে থাকে। মাত্র কয়েক বছরে এই দিবসের তাৎপর্যের এরূপ ভিন্ন রূপ দেখে এনা গারভিসের মনে ভীষণ হতাশ এবং ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এনা গারভিস-ই আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন মা দিবসের কার্যক্রম বন্ধ করতে। কোন অনুষ্ঠানের আমেজে এই দিবসটি পালনের যে রেওয়াজ শুরু হয়েছিলো নীতিগতভাবে এনা গারভিস তা মেনে নিতে পারেনি।
আমাদের বাংলাদেশে ১৯৯৩ সালে ভ্যালেন্টাইস্ ডে-এর প্রবর্তনের পর মা দিবস, বাবা দিবস, পরিবার দিবস প্রভৃতি ভিন্ন স্বাদের ভিন্নধর্মী দিবস আয়োজনের সাথে পালিত হয়ে আসছে। বাঙ্গালী জাতি বৈচিত্র্যপ্রেমী। যান্ত্রিক জীবন থেকে কিছুটা এক ঘেয়েমী ভাব দূর করার জন্য-ই হয়তো এই সকল দিনগুলো উচ্ছাস ও উদ্দীপনার আলোকে পালন করা হয়। নতুন প্রজন্মের কাছে এই সকল দিবসের ইতিহাস বিশেষ কোন প্রাধান্য পায় না। অনেকে-ই এসব দিবসের সঠিক কোন ইতিহাস জানেন না এবং জানতে চানও না। কিন্তু কোন দিবস নিয়ে অত্যাধিক মাতামাতির আগে সেই দিবসটি সর্ম্পকে কিঞ্চিত জ্ঞান বা ধারণা থাকা আবশ্যক। সকল কিছুর উর্ধে আমরা এমন একটি দিন আবিস্কার করতে পেরেছি যেটিকে কেন্দ্র করে আমরা পারি আমাদের মা’ কে সম্মান জানাতে। পারি ভালোবাসা প্রদর্শন করতে। এনা গারভিসের সাথে আমার ব্যক্তিগত জীবনের একটি নিদারুণ সাদৃশ্য রয়েছে। আমাকেও এনার মতো অল্প বয়সে পিতৃহারা হতে হয়েছে। আমার বাবা ছিলেন এদেশের একজন বিখ্যাত সাংবাদিক সুনীল ব্যানার্জি। পিতার আকশ্মিক মৃত্যুর পর জীবনের স্বণার্লী দিনগুলো যখন আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়, তখন আমি আমার মায়ের কথা ভাবি। তার অম্লান স্নেহের কথা ভাবি। ভাবি তার প্রতি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য বোধের কথা। আমি চাই, যে কোন কিছুর বিনিময়ে-ই আমার মা সুখে থাক। মায়ের সুখ-ই আমার সুখ। পিতার মৃত্যুর পর মা-ই আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। ২০০৭ সালের ৩১ মার্চ আমার মা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ জনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। পরবর্ত্তীতে তার বিবিধ মারাত্নক সমস্যা দেখা দেয়। অবিলম্বে তাকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করানো না গেলে হয়তো আমাকে ‘‘মা’’ ডাকটি থেকে চিরতরে বঞ্চিত হতে হবে। আমার মায়ের আশু রোগমুক্তি কমনা করে দেশের প্রায় প্রতিটি জাতীয় দৈনিক এবং দেশ-বিদেশের বহু অনলাইন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। মায়ের অসুস্থ্যতার সময় সাংবাদিক মহলের যে সহযোগিতা আমি পেয়েছি তা চিন্তাতীত। প্রয়াত প্রক্ষ্যাত সাংবাদিক নির্মল সেন আমার মায়ের রোগ মুক্তি এবং দেশের মানুষকে আমাকে সাহায্যে করার জন্য একটি জাতীয় দৈনিকের কলামে আহবান জানিয়েছিলেন। তার প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। সর্বোপরি দেশবাসীর কাছে আমার মায়ের আশু রোগ মুক্তির জন্য প্রর্থনা করতে অনুরোধ করছি।
মা তো একদিনের জন্য দিন সর্বস্ব মানুষ নয়। মা প্রতিদিনের নিঃশ্বাস, বেঁচে থাকার কৃতজ্ঞতা। মায়ের ঋণ কি কখনো, কোন কিছুর বিনিময়ে শোধ করা যায়? সর্বশেষ গ্রীস্মের নির্মল ফুটফুটে প্রকৃতি, কৃষ্ণচুড়ার রক্তিম লালে সুসজ্জিত শোভা আমার মা’র জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে করুক আলোকিত। ‘বিশ্ব মা দিবসে’ আমাদের প্রত্যাশা সকল মা-ই যেন থাকে অম্লান ভালোবাসায় প্রতিটি সন্তানের হৃদয় গহীনে। মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হোক এ ধারা…!
[শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।]
jsb.shuvo@gmail.com