পৃথিবীর সব ‘শিক্ষক’ একজন বাবা
সুমন্ত আসলাম: বাবা প্রথম যে পেশাকে বেছে নিয়েছিলেন, তা হলো শিক্ষকতা। আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। বৃত্তির তিন মাসের প্রথম নব্বই টাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি তাঁর সামনে। বাবা বারান্দায় বসে আছেন, চোখে দেখেন কম। আমার মেঝ বোন তাঁকে বাবার প্রিয় মাসুদ রানা পড়ে শোনাচ্ছেন। হঠাৎ বয়স হয়ে যাওয়া এক মানুষ পায়ে হাত দিয়ে বসেন বাবার। বাবা চমকে উঠে বলেন, ’কে কে?’ মানুষটা পা চেপে ধরেই বলেন, ’স্যার আমি শোয়েব। ক্লাস সেভেনে ইংরেজি টু বানান লিখতে গিয়ে প্রায়ই টু ডব্লিউ ও-এর বদলে টু ও ডব্লিউ বলতাম। আপনি কখনো বকা দেননি এতে, বরং অনেক মজা করে বুঝিয়ে দিতেন।’
পায়ে রাখা মানুষটার হাতটা বাবা নিজের হাতে নেন। চেহারাটা উৎফুল্ল করে বলেন, ’ইংরেজি অনেক প্রয়োজনীয় একটা ভাষা। প্রত্যেক ছাত্রের ওটা ভালো করে শেখা উচিত।’
মানুষটি বলে ওঠেন, ‘ইয়েস স্যার। ভাষাটা আপনি শিখিয়েছিলেন, আটাশ বছর ধরে চাকরি করছি ওই ইংরেজিতেই, যা কিছু উন্নতি হয়েছে ওটাতেই।’
সারা সন্ধ্যা মানুষটা বাবার সঙ্গে কাটালেন। অনেক বলার পরও রাতে খেলেন না। যাওয়ার সময় সাদা প্লাস্টিকের একটা ব্যাগ থেকে এক জোড়া স্যাণ্ডেল বাবার পায়ে মেলে দিয়ে বললেন, ‘আমি এখন অস্ট্রেলিয়ায় থাকি, আপনার জন্য এক জোড়া নরম জুতো এনেছি। আপনি পরবেন। স্যার—।’ মানুষটা আবার বাবার পায়ে হাত দেন, ‘নামাজ পড়তে পড়তে আপনার পায়ে যে কয়রা [এক ধরনের মাংস ফুলে যাওয়া] পরত, এখনো কি পড়ে? এই জুতোটা পরলে পরবে না।’ মানুষটা পরম যত্নে জুতো জোড়া পরিয়ে দিলেন বাবার পায়ে।
শব্দ করে বাবার দোয়া করার অভ্যাস। এশার নামাজ শেষে বাবা মানুষটার জন্য দোয়া করতে করতে কেঁদে ফেললেন। বাবার কান্না দেখে কেঁদে ফেলেছিলাম বাসার সবাই।
অনেক দিন পর আমার শিক্ষক বাবার জন্য চোখে পানি এসে গেল আমার! সম্ভবত পৃথিবীর সব শিক্ষককে আবার বাবা মনে হয় বলে!
[সুমন্ত আসলাম,এসিসটেন্ট এডিটর,দৈনিক সমকাল।]