অনুভূতি আরো শক্ত করি
প্রভাষ আমিন: ইসলাম ধর্মের ‘অবমাননামূলক’ একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে ‘লাইক’ দেয়ার অপরাধে বগুড়ার শেরপুরে বিপ্লব কুমার নামে এক স্কুল শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে। আমাদের অর্থনীতির প্রথম পাতায় নিউজটি পড়ে অনেকগুলো প্রশ্ন আর বিশাল একটা শঙ্কা মনে এসেছে। কথিত সেই ফেসবুক স্ট্যাটাসে আদৌ ইসলাম ধর্মের অবমাননা হয়েছিল কিনা, সেটা নিয়েই বড় প্রশ্ন। সে প্রশ্নে পরে আসছি। নিউজটা পড়ে দেখলাম কৃষ্ণ কুমার নামের একজনের আইডি থেকে কথিত অবমাননাকর স্ট্যাটাসে লাইক দেয়া হয়েছে। এলাকাবাসীর ধারণা বিপ্লব কুমারই কৃষ্ণ কুমার। আর এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে ‘অপরাধ’ প্রমাণের আগেই বিপ্লব কুমারকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। প্রথম কথা হলো, সেই স্ট্যাটাসে সত্যি সত্যি ইসলাম ধর্মের প্রতি অবমাননামূলক কিছু ছিল কিনা? আর ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসে লাইক দেয়া চাকরি হারানোর মত বড় অপরাধ কিনা বা আদৌ অপরাধ কিনা? যিনি স্ট্যাটাসটি দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে কোনো বিক্ষোভের খবর দেখিনি নিউজে। নিশ্চয়ই সেই স্ট্যাটাসে কৃষ্ণ কুমার একাই লাইক দেননি, আরো অনেকেই দিয়েছেন। কিন্তু নিউজে আর কারো বিরুদ্ধে বিক্ষোভের কথাও নেই। তাহলে বিপ্লব কুমার ওরফে কৃষ্ণ কুমারকেই বলির পাঠা বানানো হলো কেন? তিনি হিন্দু এটাই কি তার অপরাধ?
আমি এমনিতে মানুষের মতপ্রকাশের সর্বোচ্চ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। কিন্তু এও বিশ্বাস করি, স্বাধীনতা মানেই, যা ইচ্ছা তাই করা নয়। কারো অনুভূতিতে আঘাত করা স্বাধীনতা নয়। বাংলাদেশে এখন ইসলামের বিরোধিতা করাই যেন প্রগতিশীলতার মাপকাঠি। আমি এই ধারণার সাথে একমত নই। কিন্তু তাই বলে ধর্মীয় অনুভূতির দোহাই দিয়ে একজন সংখ্যালঘু শিক্ষককে বরখান্ত করার বিষয়টিও মেনে নেয়া যায় না। কদিন আগে নারায়ণগঞ্জে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে শ্যামল কান্তি ভক্ত নামের এক শিক্ষককে কান ধরিয়ে ওঠবস করিয়েছেন স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমান। এটাই এখন প্রবণতা যেন। আমরা সুযোগ পেলেই সংখ্যালঘুদের কোনঠাসা করি, নির্যাতন করি, হেয় করি। তারপর তারা বাধ্য হয়ে দেশ ত্যাগ করলে গালি দিয়ে বলি, মালাউনরা টাকা কামায় এই দেশে, জমায় ঐ দেশে; এটা অন্যায়। এভাবে কমতে কমতে দেশে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। আমরা কি দেশটাকে সংখ্যালঘু মুক্ত করে ফেলতে চাই?
প্রথম কথা হলো, মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি এত ঠুনকো হবে কেন, যা ফেসবুকে একটা লাইকেই ভেঙ্গে পড়বে। ফেসবুক একটি সামাজিক মাধ্যম, এখানে কোনো একটি স্ট্যাটাস পছন্দ-অপছন্দ করার অধিকার সবারই আছে। প্রিয় ভাইয়েরা, আসুন আমরা আমাদের অনুভূতি আরো শক্ত করি, যাতে কথায় কথায় তাতে আঘাত না লাগে। আর মানুষকে ধর্ম দিয়ে, বর্ণ দিয়ে, জাতি দিয়ে বিবেচনা করবেন না প্লিজ। লাইক দেয়াটা যদি সত্যি অপরাধ হয়, তাহলে সেটা নুরুল ইসলামের জন্যও অপরাধ, কৃষ্ণ কুমারের জন্যও অপরাধ। ভিন্ন ধর্মের বলেই কাউকে কোনঠাসা করে ফেলবেন না। আর অপরাধ হলে তো দেশে আইন-আদালত আছে। বিক্ষোভ করে কাউকে বরখাস্ত করে ফেলাটা আইনের শাসন নয়।
আর আপনার অনুভূতিতে আঘাত লাগায়, একজন লোক চাকরি হারিয়েছে। একজন মানুষের পেটে লাথি মেরে, আপনার অনুভূতি কতটা লাভবান হলো। প্লিজ, আপনার অনুভূতিকে আরো মানবিক করুন। আসুন আমরা এমন একটা দেশ গড়ি, যেখানে সবাই নির্ভয়ে তার মতপ্রকাশ করতে পারবে; কেউ কারো অনুভূতিতে আঘাত দেবে না; নুরুল ইসলাম, শ্যামল কান্তি ভক্ত, বিপ্রব কুমার, বিপ্লব বড়ুয়া সবাই সমান অধিকার নিয়ে জীবন-যাপন করতে পারবে, চাকরি-বাকরি করতে পারবে। কবির সুমনের সেই গানটির মত হোক আমাদের দেশ ’আমি চাই বিজেপি নেতার সালমা খাতুন পুত্রবধু, আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু’।
[লেখক: সাংবাদিক।।]