কেঁচোর জীবন বনাম শিক্ষার মান
সৈকত রুশদী:কেঁচো যেমন মাটির উপরে সময় কাটানোর চেয়ে স্বল্পায়ু জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটাতে চায় মাটির তলে অন্ধকারে, পৃথিবীর বর্ণাঢ্য বিশাল জগৎ এবং তার বৈচিত্র্য, বিপদ ও সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে চায়না, আমরা, বাংলাদেশের বাঙালিরাও সেরকম হয়ে যাচ্ছি দিন দিন। সামনে যা দেখি কেবল তাই নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তার পিছনের কার্যকারণ নিয়ে ভাবনার সময় আমাদের আর হয়না। ২০১৬ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ অর্জন করা শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের মান নিয়ে বাংলাদেশের মাছরাঙ্গা টিভি’র এই সপ্তাহের প্রতিবেদনটি নিয়ে ঠিক তাই হয়েছে।
কোন সুচিন্তিত ও সর্বাত্মক জরীপের পরিসংখ্যানে পাওয়া ফল ও উপাত্তের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরী করা হয়নি। সারা দেশে ১৬ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে এক লাখের বেশি জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর মধ্যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে মাত্র জনা ছয়েক শিক্ষার্থীর সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতকার নেওয়া হয়েছে। তারপরই শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাতকার থেকে মন্তব্য জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এই সাক্ষাত্কার থেকে কিছু শিক্ষার্থীর মেধার মান সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া গেলেও আর যাইই হোক তাকে সকল জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর প্রতিনিধিত্বশীল বলা যায়না। সাক্ষাতকার দেওয়া ছাত্র-ছাত্রী কোন বোর্ডের ও বিদ্যালয়ের সেই পরিচয় দেওয়া হয়নি। কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক এই ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকের সম্ভবত: অনুমোদনহীন এই সাক্ষাত্কারে তাদের চেহারাটি স্পষ্ট করেই দেখানো হয়েছে।
প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রথম প্রতিক্রিয়া হলো ঐ ছাত্র-ছাত্রীদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা দেখে একটা ধাক্কা খাওয়া। উপহাস করা এবং ঐ ছাত্র-ছাত্রী ও তাদের শিক্ষকদের তীব্র সমালোচনা করা। সর্বোপরি, শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনা করা। একটু পরে দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া হলো, যে প্রতিবেদক ঐ প্রতিবেদনটি তৈরী করেছেন, যিনি এই দায়িত্ব দিয়েছেন এবং যাঁদের নির্দেশনা, সম্পাদনা ও অনুমোদনে এই প্রতিবেদনটি সম্প্রচার করা হয়েছে, সেই সাংবাদিকদের নৈতিকতাবোধ, পরিমিতিবোধ, কম বুদ্ধিদীপ্ত ও অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীর সাক্ষাত্কার গ্রহণ ও সম্প্রচারের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ও তীব্র সমালোচনা।
উভয় পক্ষে জোরালো যুক্তি আছে। আবার একটু ফাঁকও আছে। প্রথমত: এই ধরণের প্রতিবেদন একটি সামগ্রিক জরীপ ভিত্তিক না হলে তাকে প্রতিনিধিত্বশীল বলা যায়না। দ্বিতীয়ত: ওই শিক্ষার্থীদের চেহারাটি আড়াল করে অথবা ঝাপসা করে তাদের ব্যক্তিগত পরিচয়টি উহ্য রাখা অবশ্যপালনীয় কর্তব্য ছিল। তৃতীয়ত: ঐ শিক্ষার্থীরা যে কোন বোর্ড ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে প্রতিনিধিত্ব করে, জিপিএ-৫ পাওয়া সকল ছাত্র-ছাত্রীকে প্রতিনিধিত্ব করেনা, সেটি উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল। প্রতিবেদনের এই দুর্বলতাগুলো অমার্জনীয়। অপর দিকে, যাঁরা এই প্রতিবেদন তৈরী ও সম্প্রচারের পুরোপুরি বিরোধিতা করছেন, তাঁদের অবস্থান সঠিক নয়। এই প্রতিবেদন থেকে শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছু গলদের কারণে যে এক ধরণের শিক্ষার্থীরা খুব একটা জ্ঞান অর্জন না করেই জিপিএ-৫ পাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে বাংলাদেশে, সেটি তো জানা গেল। তার ফলে দেশব্যাপী, এমনকী বিদেশেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জোরালো বিতর্ক সৃষ্টি হলো। আর জ্ঞানের এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কেন কিছু ছাত্র-ছাত্রী সর্বোচ্চ মানের ফল করতে সক্ষম হচ্ছে এবং তার পিছনে ত্রুটিটি কোথায় তা’ খুঁজে বের করার তাগিদ নীতিনির্ধারকদের মধ্যে না হলেও অভিভাবকদের মধ্যে তৈরী হলো।
সুতরাং এই প্রতিবেদনের মূল উদ্দেশ্য যাই-ই হোক, মূল সমস্যাটি যে কোথায় সে সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া গেছে। মূল সমস্যা যে প্রতিবেদক ও সম্প্রচার কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনটি, বা সাক্ষাত্কারে অংশ নেওয়া গুটিকয় ছাত্র-ছাত্রের জ্ঞানের মান নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু, সেটি জানা গেল। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে বর্তমান সরকারের নীতির অন্যতম হলো বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীর সফল হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। কিন্তু সেই সফলতা কী জ্ঞান অর্জন ও পরীক্ষণের সুবিধা বাড়িয়ে করা হচ্ছে, নাকি উপযুক্ত জ্ঞানের চর্চা ছাড়াই ও ঢালাও ভাবে সবাইকে উঁচু মানে পাস করিয়ে দিয়ে অর্জন করা হচ্ছে, সেটি এখন গভীরভাবে অনুসন্ধান করে দেখা অত্যন্ত জরুরী।
আমি মনে করি, শিক্ষার মানের এই প্রতিফলনের জন্য মূলত: দায়ী শিক্ষা নীতি, তার প্রয়োগ ও ব্যবস্থাপনা। অনেকেই শিক্ষা ব্যবস্থা বলতে বিদ্যায়তন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বুঝে থাকেন। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষানীতি, তার প্রয়োগ ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনা অনেক বড় পরিসরের বিষয়। কেবল পাঠ্যক্রম ও পাঠদান নয়, শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি, শিক্ষকের মান যাচাই, সামগ্রিক নৈতিকতা শিক্ষা ও শৃঙ্খলা রক্ষা এবং পাঠদান, তার মান যাচাই, পরীক্ষা পদ্ধতি ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন সবকিছু নিয়েই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। সর্বোপরি রয়েছে, শিক্ষা প্রশাসন, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, পাঠ্যক্রম নির্ধারণ এবং পরিবারের ভূমিকা । সকলে বিষয়টি বুঝলে তো ভালই হতো। নীতি নির্ধারকদের বেশিরভাগই যা বোঝেন না বা বুঝতে চান না, তা’ গরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের কাছে প্রত্যাশা এক দুরাশা মাত্র!
এই কেঁচোর জীবন যদি বাংলাদেশের বাঙালির জীবনের আদর্শ হয়ে দাঁড়ায়, তবে আমরা যেকোন ঘটনাতেই সূতোয় বাঁধা পুতুল নাচের মত নেচে নেচে মজা পাবো। কিন্তু মূল সমস্যার গভীরে গিয়ে তা’ চিহ্নিত করা এবং তা’ নিরসনের ব্যবস্থা থেকে দুরেই থাকবো।
[লেখক: সৈকত রুশদী, প্রবাসী সাংবাদিক।।]
টরন্টো, ২ জুন ২০১৬।